ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

ভালবাসার শব্দহীন অনুভূতি

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৪
ভালবাসার শব্দহীন অনুভূতি

প্রতিদিন সকাল ঠিক সাতটায় সাবওয়ের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ব্লন্ড হেয়ার ও নীলাভ চোখের মধ্যবয়সী মহিলাকে। দু’জনার কাজের সময় একই হওয়াতে প্রতিদিন সকালে সাবওয়ের একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মহিলার সাথে দেখা হয় অনিতার।

অনিতাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মহিলার নীলাভ চোখ দু’টো সকল নীরবতা ভেঙে সরব হয়ে সাদর আমন্ত্রণ জানায় অনিতাকে। তাঁর ঠোঁটের কোণে দেখা দেয় একখণ্ড হাসির ঝিলিক। অনিতার মনে হয় কত আপন সে তার। কত কাছের মানুষ তার। ভাষাহীন চোখের নীরব চাউনিতে যে কাছে টানার এমন প্রবল আকর্ষণ থাকে তা এই মহিলার চোখের দৃষ্টি না দেখলে কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

অনেকদিন অনিতা ভেবেছে মহিলার সাথে পরিচিত হতে। ঠিক আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আবার দ্বিধা করেছে। বার বার মনে হয়েছে বাঙালিরা অকারণে যেচে কথা বলে বিশেষ করে বিদেশিদের দেখলে বিষয়টি আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। তাই বারবারই নিজেকে সংযত করেছে প্রবলভাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কৌতূহল তাকে পেয়ে বসেছে। অনিতার মনে এই মহিলার জন্য একটি বিশেষ স্থান তৈরি হয়। একটু একটু করে সেই স্থান শক্ত হতে থাকে।

একদিন ট্রেন এসে পড়লে দরজার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন ভেতরে প্রবেশে উদ্যত হলে মহিলাটি নিবিড় মমতায় তার ডান হাতটি বাড়িয়ে অনিতাকে আগে প্রবেশে স্বাগত জানায়। আরেকদিন ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অনিতার বার বার কাশি আসছিল। তাকিয়ে দেখে মহিলাটি ব্যাগ থেকে রিকোলার একটি ক্যান্ডি বের করে এগিয়ে দিছে অনিতার দিকে। ছোট্ট একটি ধন্যবাদ জানিয়ে তা সে গ্রহণ করে। এমনি আর একদিন কিছুতেই ট্রেন আসছে না; যাত্রীরা এদিক সেদিক করছে। মুখে অবশ্য কোনো কথা নেই। কোনো ঘোষণাও নেই কেন ট্রেনের বিলম্ব তা জানিয়ে। অনিতার মনে হয় যদি হতো ঢাকার কোনো স্টেশন তাহলে ততক্ষণে শত কথায় আর চেচাঁমেচিতে বেঁধে যেতো হট্টগোল গণ্ডগোল। অথচ এখানে স্টেশনে পিনপতন নীরবতা। কারো মুখে কথা নেই। নেই কোন উচ্চবাচ্য। নেই কোন উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। অথচ সকলেই অফিস যাবে- যাবে নানা কাজে। দেখা গেল এক সময় অনেকে উপর থেকে নীচে নামতে শুরু করেছ। হয়তো বাস ধরবে অথবা পায়ে হেঁটে বা ভাড়া গাড়িতে যাবে গন্তবে। ইতিমধ্যে আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামার সকল লক্ষণ স্পষ্ট।

অনিতা চিন্তা করছে কী করবে সে; নীচে গিয়ে বাস ধরবে, না ট্রেনের জন্যে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। বাঙালির চিরন্তন অভ্যাস পরিত্যাগ করে অর্থাৎ কোনোরূপ শব্দ উচ্চারণ না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভেতরে ভেতরে ছুটফট করতে লাগলো। এক পর্যায়ে যখন অনিতা নীচে নামতে শুরু করেছে ফিরে তাকিয়ে দেখে মহিলাটিও তার পেছন পেছন নামছে। নীচে নেমে এসে দেখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে। মহিলাটি তার ব্যাগ থেকে একটি ছাতা বের করে অনিতাকে দেয়। তখন হাত বাড়িয়ে অনিতা মহিলার কাছ থেকে ছাতাটি নেয় এবং তাকে ছোট্ট একটি ধন্যবাদ দেয়। মহিলার ঠোঁটের কোণে সেই এক চিলতে হাসির ঝলক। বাস এসে পড়ায় অনিতা দ্রুত তাতে উঠে পড়ে। কিন্তু মহিলাটি যে বাসে ওঠেনি তা সে চারিদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হয়। মনে হতে থাকে অনিতার কেন সে ছাতাটি নিয়েছে ওই মহিলার কাছ থেকে। যাকে সে চেনে না জানে না যার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেনি এমনকি একটি বাক্যও বিনিময় হয়নি পরস্পরের। অযাচিতভাবে একের পর এক জিনিস গ্রহণ করায় অনিতার খারাপ বোধ হয়।

দু’ সপ্তাহের ছুটিতে অনিতা কানাডা বেড়াতে যায়। সেখানে গিয়েও তার বার বার মহিলাটির কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে ঘড়িতে সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখার একটি আকুতি তার ভেতরে কাজ করতে থাকে। ছুটি শেষে অনিতা যেদিন কাজে যোগ দেয় সেদিনও সাবওয়েতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। উপরে উঠতেই দেখা সেই মহিলার সঙ্গে। অনিতাকে দেখা মাত্রই তার দু’চোখের তারা যেন মুহুর্তের মধ্যে নেচে ওঠে। প্রচন্ড ব্যাকুলতা তার দু’চোখে। অনিতার মনে হয় এই বুঝি মহিলাটি এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করবে কোথায় ছিলে এতদিন? অসুখ করেনি তো? অথবা কোন সমস্যা-সংকট না মহিলাটি দাড়িয়ে থাকে স্থির ভাবে। চোখ ও মুখের অভিব্যক্তি দিয়েই যেন সে বুঝিয়ে দিতে চায় তার মনের গভীরের সকল অনুভূতি। ভাষা সেখানে নিতান্তই গৌণ। অনিতার মনে হতে থাকে সে কেন মহিলার পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করে না কেমন ছিল সে এতদিন? কী নাম তার? কী তার পরিচয়? কোথায় থাকে সে? বাঙালির এই অকারণ কৌতূহল যা প্রায়শই সাধারণ সৌজন্যের সীমা লংঘন করে যায়,  তা করতে অনিতাকে ভেতর থেকে কে যেন প্রচণ্ড বাধা দেয়। মন তার আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। কিন্তু অনিতাও স্থিরচিত্রের মত নির্ধারিত ফ্রেমে বাধা পড়ে থাকে।

আরও একদিন অনিতা উর্ধ্বশ্বাসে ছোটে সাবওয়ের দিকে। তার দু’হাতে দু’টি ব্যাগ। ব্যাগ দু’টি ভর্তি তারই হাতে তৈরি নানান খাবারে। অনিতার ছোট বোনের একমাত্র কন্যা স্বল্পকালীন ছুটি শেষে ফিরে যাচ্ছে তার কলেজের ডরমে। থাকে সে ফিলাডেলফিয়ায়। আদরের ভাগ্নীর জন্য তার পছন্দের কিছু খাবার নিয়ে যাচ্ছে অনিতা তাদের বাসায়। খাবারের কিছু যদি সে খায় আর কিছু যদি সঙ্গে করে নিয়ে যায় এই আশায়। কখন কোন খাবার তার পছন্দ তা বলা মুশকিল। সবই নির্ভর করে তার মন-মেজাজের ওপর। তাই অনিতা তৈরি করেছে রকমারি খাবার। আর তাতেই ভারী হয়ে গেছে ব্যাগ দু’টি।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখা সেই মহিলার সঙ্গে। সময় তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। অনিতা তো আর আজ অফিস যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনের সকালের সময় মাফিক তার উপস্থিতি ঘটেনি। মহিলার দু’চোখ আর সারা মুখ জুড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে। তার ব্যাকুলতা দেখে আবারও অনিতার মনে হয়েছে আজ সত্যি সত্যিই মহিলা তাকে প্রশ্ন করবে কেন দেরি হল? কোনো সমস্যা হয়েছিল কী? নাহ মহিলা তার নির্ধারিত জায়গাটি ছেড়ে এক পাও সরে আসেনি। চোখের ভাষায়ই সে অনিতাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার নীরব উৎকণ্ঠার কথা। ট্রেনে প্রবেশের পর দেখা গেল দু’জন বিপরীতমুখি সিটে বসেছে। এদিকে অনিতার একটি ব্যাগ গিয়েছে ছিঁড়ে। নীচু হয়ে অনিতা ব্যাগটিতে একটি গিট লাগিয়ে মাথা তুলতেই দেখে নিজের আসন থেকে নেমে এসে মহিলাটি অনিতাকে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিচ্ছে। এতটুকু অন্যথা না করে অনিতা একইভাবে ব্যাগটি নিয়ে তার ছেঁড়া ব্যাগটি ফেলে দেয়। মহিলার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা তৃপ্তির হাসিটিও অনিতার দৃষ্টি এড়ায় না। অনিতার মাথায় একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কেন সে একের পর এক মহিলাটির সাহায্য নিয়ে চলেছে, অথব তার সাথে তার কোনো পরিচয়ই নেই। অনিতা এবার মনে মনে শপথ করে যে করেই হোক মহিলার সাথে পরিচিত হতেই হবে। হয় পরিচিত হবে আর না হয় আগামীতে কোন সাহায্যই সে আর তার কাছ থেকে নেবে না--- এটাই হোক তার আজকের প্রতিজ্ঞা। লেবার ডে’র ছুটি কাটিয়ে অনিতা যথারীতি সাবওয়ে ধরতে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠে দেখে মহিলাটি তার নির্দিষ্ট স্থানটিতেই দাঁড়িয়ে আছে। নজরে পড়ে অনিতার মহিলার চোখ দু’টোতে আজ আর হাসির ঝিলিক নেই, আনন্দের সাদর অভ্যর্থনা নেই। কেন যেন মলিন ও বেদনায় ভরা তার চোখের দৃষ্টি। অনিতা ভাবতে থাকে সে বোধ হয় ভুল দেখছে। বাড়ি থেকে মেয়ের সাথে রাগ করে বেরিয়েছে তাই বোধ হয় নিজেরই মন খারাপ। আর সে কারণেই সে এমনটি দেখছে ও ভাবছে। বার কয়েক দৃষ্টি বিনিময়ের পর অনিতার মনে হতে থাকে আজ মহিলার চাউনিতে আর মুখের অভিব্যক্তিতে বিষন্নতা ছেয়ে আছে। ধীরে ধীরে দু’জনে ট্রেনে প্রবেশ করে।

আবারও একবার দেখে নেয় মহিলাকে অনিতা। দৃষ্টি তার উদাসীন, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত। অনিতা ভাবে আজও হল না তার সাথে পরিচিত হওয়া। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিতে থাকে অনিতা। পরিচয় থাকলে তাকে আজ জিজ্ঞেস করতে পারতো কন তার মন খারাপ। তাতো হবার নয়। প্রতিদিনের মত তিনটি স্টেশন পর মহিলাটির নেমে যাওয়ার পালা। হঠাৎ করেই মহিলাটি এগিয়ে আসে অনিতার সামনে এবং তার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়। তার দু’চোখে পানি।

সেটা দিয়ে নিমিষেই নেমে যায় ট্রেন থেকে। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে সে। অনিতা চলতি ট্রেন থেকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। হঠাৎ নজরে পরে হাতের চিরকুটের দিকে। খুলে পড়তে থাকে অনিতা। ইংরেজীতে লেখা চিঠির মমার্থ হচ্ছে প্রিয় বন্ধু, আজ ফিরে যাচ্ছি ফ্লোরিডায়। ন’মাসের ট্রেনিং গতকাল শেষ হয়েছে। গত ৯টি মাস আমার একবারও মনে হয়নি এই নিউইয়র্ক শহরে আমি একা। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি মনে হয়েছে পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাকে প্রথম দেখাতেই আপন বলে মনে হয়। সেখানে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা কোনো কিছুই বড় হয়ে দেখা দেয় না। তাইতো ধীরে ধীরে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা, আস্থা ও মমত্ববোধ জন্মেছে। হয়তো জীবনে আর কোনোদিন তোমার সাথে দেখা হবে না। প্রতিদিনই ভেবেছি তুমি হয়তো আমার সাথে কথা বলবে পরিচিত হবে। তোমার অনেক কাছের মানুষ হতে পারবো। তা আর হল না। জানি তুমি বলবে আমাকে যদি এত ভালই লেগে থাকে তবে কেন আমি তোমার সাথে আলাপ করিনি- পরিচিত হইনি। সে কথা জানাতেই তোমায় আমার এই পত্র লেখা। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কখনই পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেন না।

কোথাও একটি অপূর্ণতা রেখে দেন। কেন তা করেন সেটি তিনিই জানেন। আমিও তা থেকে বাদ পড়িনি। স্রষ্টা আমাকে একটি পাওনা অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। আর তা হল আমি কথা বলতে পারি না। সেই সংকোচ আমাকে কেবলি পিছু টানে। আশা করি আমায় ক্ষমা করবে। তোমার এলিজাবেথ।

চিঠি পড়তে পড়তে কখন অনিতার দু’চোখ বেয়ে ঝর্ণা ধারার মত অশ্রু নেমে এসেছে খেয়াল করেনি, তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিজেকে সামলে নেয় অনিতা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ