ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপন্যাস

মিছিলের মুখ | ফয়সল নোই

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৮ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৪
মিছিলের মুখ | ফয়সল নোই স্কেচ: এরিক ফ্রেইটাস

ফোনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে ওঠে মিরপুর থানার ওসি মাহবুব হোসেনের। রাস্তার মোড়ে টানানো ‘পুলিশ আপনার বন্ধু, বিপদে স্মরণ করুন’— এই বিলবোর্ড থেকে নিয়েছে বোধ হয়।

প্রকাশ্যে টানানো থাকলেও সাধারণত কেউ ফোন করতে সাহস করে না। কিন্তু সকাল থেকে এই ছোকড়া আট-দশবার ফোন দিয়েছে। বারবার একই কথা বলছে।

ফোন ধরে তিনি বুঝলেন, এবারও একই কথা।

‘একদম গরীব লোক ছিল স্যার। দিনমুজুরি করে চলতো। পার্টি ক্ষমতায় স্যার। তারপরও যদি কোনো নেতা না আসে স্যার মানুষ কী বলবে বলেন! এমপি আমাদের ফোন ধরে না স্যার। আপনি বলেন স্যার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এলাকাবাসি খুব উত্তেজিত। স্যার আপনি চলে আসেন। এমপি সাহেবকে জানান যে এলাকাবাসির দাবি তিনি এসে যাতে বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব নিয়েছেন এই ঘোষণা দেন। ’
‘আপনার নাম কী?’
যুবকের কথার তুবড়ি থামিয়ে প্রশ্ন করেন মাহবুব হোসেন।
‘স্যার আমি এই এলাকার স্যার। স্যার আপনি বিরক্ত হবেন না দয়া করে। ’
‘আচ্ছা, আপনি ফোন ছাড়ুন। ’
‘স্যার, গরমে স্যার, লাশ ফুলে উঠছে স্যার। মারা গেছে কাল রাতে। এখন চারটা বাজে। জানাজা হবে এমপি সাহেব আসলে স্যার। আমরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি স্যার। ’
‘আপনারা চেষ্টা করুন। আপনি বুঝতে পারছেন না, বিষয়টা আমার এখতিয়ারের বাইরে। খুন খারাবি হলে একটা কথা ছিল। ’

ও প্রান্তে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসে কলিংবেল টেপেন মাহবুব। প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই পাশের রুম থেকে এসে উদয় হন ডিউটি অফিসার।

‘শোনো সবুজ, এমপি সাহেবের পিএসকে আর ফোন দিয়েছো? কী বলেন তিনি? এমপি সাহেব আসবেন? না আসলে ফোর্স পাঠিয়ে লাশ দাফন করতে তাগাদা দাও ওদের। রাজি না হলে পোস্ট মর্টেমের ভয় দেখাও। ’
‘জি স্যার। এখনই ব্যবস্থা করছি। পিএস সাহেব জানিয়েছেন স্যারের স্বাস্থ্যটা একটু খারাপ। ভালো বোধ করলে আসবেন। ’
‘আচ্ছা, বুঝতে পারছি। তুমি ফোর্স পাঠাও। ’

ফোনটা আবার বেজে উঠলে মেজাজ চরমে উঠে যায় ওসির। কিন্তু, ধমক দেয়ার আগেই কথা শুরু করে দেয় ওই যুবক।

‘স্যার আপনি এমপি সাহেবকে জানান লোকজন রাস্তা বন্ধ করে দেবে। গাড়ি চলবে না। তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন স্যার। এলাকার বদনাম হয়ে যাবে স্যার। এমপি সাহেব অপমানিত হবেন। ’

ওসি কোনো কথা বলার আগেই ফোনের লাইন কেটে যায়।

‘ওখানে ঝামেলা হবে সবুজ দ্রুত ফোর্স পাঠাও। ’

আবারও ফোন বেজে উঠলে এবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা মুশকিল হলো ওসির।
‘স্যার বাচ্চাগুলোর কান্নায় আল্লার আরস কাইপ্পা উঠছে স্যার। ওরা খাটের পাশে গড়াগড়ি করছে। কেউ চোখে পানি রাখতে পারছে না স্যার। আপনি শোনেন স্যার ... একটু লাইনে থাকেন স্যার ...’

ওসি ছেলেটিকে থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে ফোন কান থেকে সরিয়ে হাতে নিয়ে হাঁটছে মনে হয়। অষ্পষ্ট তার তাড়াহুড়া ভরা কণ্ঠ শোনা যায়। এই সরেন সরেন...। লোকজনের উত্তেজিত কণ্ঠও ভেসে আসে কানে। স্যার শুনেন...

মেজাজ খারাপ করে লাইন কেটে দেন ওসি। ছেলেটা মাথা ধরিয়ে দিয়েছে একেবারে। অস্থির লাগছে। ইন্টরকম টিপে ডিউটি অফিসার সবুজ আনোয়ারকে রুমে আসতে বলেন।
‘কী হয়েছে বলো তো। খোঁজ নিয়েছো কিছু?’
‘হ্যাঁ স্যার। মারা গেছে হাসপাতালে। নাম রহিম মিয়া। বয়স ত্রিশ। পার্টির মিছিল মিটিংয়ে যেত। সে-রাতে আড়াইশো টাকা চুক্তিতে পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ব্যানার লাগাচ্ছিল। গোল চক্করের মাঝের গাছ থেকে পড়ে আহত হবার পর ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায় পার্টির লোকেরাই। কালকে রাত সাড়ে তিনটার দিকে মারা যায়। গোলারটেক বস্তিতে থাকতো। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি। খোঁজ না পেয়ে তার স্ত্রী থানায় এসেছিলেন। মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে থানায় ফোন দিয়েছে। ভর্তির সময় সঙ্গের লোকরা বস্তির ঠিকানা লিখে রেখেছিল। এসআই রমিজ সেহেরির পর টহলের সময় তার পরিবারের কাছে খবর দিয়ে এসেছে। ’

ফোনটা বেজে ওঠে আবার ।

‘শোনেন স্যার...’

ফোন কানে ধরে স্তম্ভিত হয়ে যান ওসি মাহবুব হোসেন। ‘বাবাগো আমারেও সাথে লইয়া যাও। ’ বারবার বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে পাঁচ-ছয় বছরের একটা শিশু। রহিমের বড় মেয়ে বোধহয়। আরো কয়েকজনের বিলাপের শব্দ কানে আসে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। বন্ধ না করেই কান থেকে নিচে নামিয়ে রাখেন ফোন। কী যেন বলছে ছেলেটা এখনো। একসময় অস্পষ্ট শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।

‘ঠিক আছে সবুজ তুমি যাও। ’
‘স্যার কিছুক্ষণ আগে বস্তির লোকজন রাস্তা আটকে দিয়েছিল। আমরা পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ’
‘এরা কারা?’
‘পার্টির লোকই স্যার। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে টের পেয়ে আগেই তৈরি হয়েছিল। আপনি চিনবেন স্যার জসিম ভাইয়ের ছেলেরা সামাল দিয়েছে। ’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ড্রাইভারকে গাড়ি লাগাতে বলো। ’

ওসি গোলারটেক পৌঁছতে পৌঁছতে রহিম মিয়ার জানাজা শেষ হয়ে গিয়েছে। পঞ্চাশ-ষাটজন লোক খাটিয়া নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের গাড়ি আসছে দেখে কয়েকজন দৌড়ে গলিতে ঢুকে গেল। এরা রাস্তা বন্ধ করেছিল বোধহয়।

মাহবুব হোসেন এগিয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘রহিমের স্ত্রী, বাচ্চারা কোথায়?’
ভীড় থেকে এক বুড়ো জবাব দেন, ‘ওরা গ্রামের বাড়ি রওনা হয়ে গেছে। ’
‘আমাকে ফোন করেছিলেন কে?’

কেউ জবাব দেয় না। একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে এদের কেউ তাকে ফোন দেয়ার সাহস রাখে বলে মনে হলো না তার।

সারাদিন যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছে তাতে ফোন দিলেও কেউ ধরে না। একবার ধরে একজন জানালেন এটা গোলারটেকের একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ