ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

হরতাল নিয়ে মন্ত্রী জিএম কাদেরের ওয়ান্ডারফুল তথ্য!

সাকির আহমদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১২
হরতাল নিয়ে মন্ত্রী জিএম কাদেরের ওয়ান্ডারফুল তথ্য!

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী জিএম কাদের। তার পূর্ণ নাম গোলাম মোহাম্মদ কাদের।

তিনি তো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়শীল গরীব দেশ নামে পরিচিত বাংলাদেশের মন্ত্রী। কিন্তু হুট করেই মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুর দিন হরতাল নিয়ে জাতিকে একটি নতুন আর  ওয়ান্ডারফুল তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন  ‘হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি হয় না, শুধু বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। ‘

মহাজোট সরকার গঠন করার শুরুতেই জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতা জিএম কাদের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। বর্তমানে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী। গত ৮ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, ‘হরতালে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে হরতাল বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। বাংলাদেশের সঙ্গে যারা ব্যবস্যা করেন তারা এখন এটা বুঝতে পারছেন যে হরতাল কোনো সমস্যা নয়। পরিবহনে কিছু সমস্যা হলেও বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। ’

হরতাল নিয়ে মন্ত্রী অনুগ্রহ পূর্বক যে তথ্য জাতিকে অবহিত করেছেন সে পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের এই লেখা। আর এ জন্য ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হচ্ছে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পশ্চিমাদের (পশ্চিম পাকিস্তান) শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের আন্দোলনের অন্যতম অস্ত্র ছিলো হরতাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা  ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বত:স্ফুর্তভাবে দিনের পর দিন হরতাল করেছে এদেশের আপামর জনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা নিরস্ত্র বাঙ্গালী নিধন শুরুর আগ পর্যন্ত হরতাল হয়েছে।

স্বাধীনতার পর তিন দফা ক্ষমতার পালাবদলে রাজনৈতিক দল বা জোটের ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে জাতি হরতাল পালন করেছে। প্রথমটি হচ্ছে, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সারাদেশে সামরিক শাসন জারির পর। সে সময়কার সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (এইচ এম এরশাদ) তার নেতৃত্বে এক রক্তাপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বুটের তলায় গণতন্ত্রকে পিষ্ঠ করে ক্ষমতা দখল করেন। পরে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সেনানিবাসের বাসভবনে বসেই গঠন করেন রাজনৈতিক দল। সকল রাজনৈতিক দল একদিকে আর এরশাদ অন্যদিকে। হরতাল আর আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচরী এরশাদের পতন হয় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।

দ্বিতীয়টি নব্বই পরবর্তী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে। বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে একই দাবিতে জামায়াতে ইসলামীও রাজপথে নামে। শেষ পর্যন্ত জনগণের দাবির কাছে মাথানত করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়। তৃতীয়টি ২০০১ সালে--- বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন সে ইস্যুতে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একের পর এক হরতাল ও অবরোধে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়লে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়েছে প্রধানত হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি হয় না মন্ত্রীর এমন কথার কারণে। হরতালের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রীর কাছে সবিনয়ে জানতে ইচ্ছে করছে কোনো সরকার বা সরকারের মন্ত্রী কি আপনার আগে এমন কথা বলেছিলেন? স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ইতিহাস বাদ দিলে স্বাধীনতা-পরবর্তী হরতালের সময় কোন সরকারের মনেই হয়নি যে হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি হয় না?

এসব প্রশ্নের জবাব এমন হতে পারে যে, আপনার মত কোনো বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মন্ত্রী কোনো সরকারেই ছিলেন না। যদি থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই তারা হরতাল নিয়ে আপনার মত করে মন্তব্য করতে পারতেন। ভাগ্যিস আপনার আগে কোনো সরকার বা সরকারের মন্ত্রী এমন তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরে স্মরণীয় হননি। আর এক্ষেত্রে আপনি মন্ত্রী হয়ে যে তথ্য দিলেন তাতে করে একটি কথা বলতেই হচ্ছে যে, দেশ ও জাতির কাছে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
 
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী তার গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হওয়ার ইস্যুতে ১৮ দলীয় জোট হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করে। দু’দফায় টানা পাঁচদিন হরতাল হয়েছে। এদিকে ১৮ লীয় জোটের শরিক আরেকটি দল ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী গত ৯ মে ঘোষণা দিয়েছেন, ১৮ মে’র মধ্যে তাদের দাবি মানা না হলে হরতালের ডাক দেবেন।

জিএম কাদের নিজের বড় ভাই এরশাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির (এ) প্রথম সারির একজন নেতা। আর মহাজোটে যোগ দেয়ার কারণে মন্ত্রী। মন্ত্রী হিসাবে মাস গেলে বেতন পাচ্ছেন। এর বাইরে বাসা-বাড়ি, গাড়ি, চালক ও তেল সরকার দিচ্ছে। চলেন পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ভাড়া বাড়িতে যারা বসবাস করেন হরতাল কি এবং কেমন তারা ঠিকই হাড়ে হাড়ে টেন পান। তাছাড়া যারা দিন-এনে-দিন-খান তারাও বুঝতে পারছেন হরতাল ক্ষতি নাকি ভাবমূর্তি নষ্ট করে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ বা আমজনতা পাঁচদিনের হরতালে যে ধাক্কা খেয়েছে তা কাঠিয়ে উঠতে পেরেছে বলা যাবে না।
 
হরতালের কারণে রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের কাঁচাবাজারের চিত্র কি ছিলো তা সবাই জানেন। রাজধানীতে শাক-সবজির দাম হাইজাম্প দিয়েছিলো। আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় সারাদেশের লোকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। যারা ভাড়াবাড়িতে বসবাস করেন তাদেরকে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বাড়িওয়ালার হাতে বাড়িভাড়ার টাকা তুলে দিতে হয়। একইভাবে বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুদি দোকানির পুরো মাসের বকেয়া পরিশোধ করতে হয়। স্কুল-কলেজের বেতন, প্রাইভেট শিক্ষকদের (যারা সন্তানদের প্রাইভেট পড়ান বা কোচিং করান) বেতনও দিতে হয় একইভাবে। এইচএসসি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা পাঁচ দিন পিছিয়ে দেয়াতে ক্ষতিটা আর যাদেরই হোক না কেন মন্ত্রীর তো হয়নি। মাসের শেষে টানা হরতালের কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এপ্রিল মাসের বেতন নির্ধারিত সময়ে কেউই পায়নি। এ কারণে বাড়িওয়ালা ও দোকানির সাথে মন কষাকষি যে হয়নি তা হলপ করে কেউ বলতে পারবেন না।

গত ২৫ এপ্র্রিলের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দু’টি খবরের কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। ‘হরতালের কারণে কাঁচাবাজারে সবজি ও মাছের সরবরাহ কমেছে। সেই সঙ্গে দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে’। ‘সচিবালয়ে আইএমএফ’র ডেপুটি ডিভিশন চিফ ডেভিড জি কয়েনের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘’হরতাল অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজন’।

অপরদিকে হরতালের কারণে কি ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত। তিনি বলেছেন,  ‘প্রতিদিন জিডিপিতে ২ হাজার কোটি টাকা যুক্ত হয়। একদিন করে পাঁচদিনের হরতালে ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে’। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য হরতালের বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অনুরোধ জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। এ সংগঠনের সাবেক সভাপতিরা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে হরতালের ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, ‘আন্দোলনের জন্য আর হরতাল নয়, অন্যকিছু ভাবুন। ‘
 
বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের হরতাল নিয়ে যে মূল্যায়ন করেছেন তা সঠিক হলে জাতি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচিতে সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত রাখে কেন? ভোর রাত তিনটার দিকে পুলিশ ও র‌্যাবের ব্যারাকে ঘুমন্ত সদস্যদের ডেকে ওঠানো হয়। এক ঘন্টা সময় দিয়ে সবাইকে প্রস্তুত হতে বলা হয়। এরপর পুবের আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই তাদের পৌঁছে দেওয়া হয় ডিউটির নির্ধারিত জায়গায়।

হরতালের কর্মসূচিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ও ব্যত্যয় ঘটে। রাত তিনটায় ঘুম থেকে ডেকে ওঠানোর কারণে রাত ১০টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত না ঘুমিয়ে সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত থাকে আরকেটি গ্রুপ। আর সকাল হতে না হতেই দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে হয়। তাছাড়া এ সবের জন্য এতো ব্যয় করার কোনো অর্থই হয় না। তারপরও সরকার কেন করছে?

একই সরকারের দুই মন্ত্রী হরতাল নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে দু’ধরণের কথা বললেন। অর্থমন্ত্রী বললেন, হরতাল অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। আর বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, হরতালে ক্ষতি অর্থনীতির নয়, ভাবমূর্তির। মন্ত্রী যা বলেন তাতো সরকারেরই কথা। তাহলে কোন মন্ত্রীর কথা সরকারের কথা, সেটা  জাতির জানা উচিত।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত যে হিসাব দিয়েছেন সে প্রসঙ্গ টেনে আজকের লেখা শেষ করছি। নিশ্চয়ই এটুকু বলা বাড়াবাড়ি হবে না যে, কত হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হলে বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরের দৃষ্টিতে মনে হবে হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি হয়?

লেখক : সাকির আহমদ, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক।

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।