ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গোলাম আযমের ক্ষমার খায়েশ!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫১ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১২
গোলাম আযমের ক্ষমার খায়েশ!

ঢাকা: দেশের নানান খারাপ খবরের মাঝে ভালো খবরটি হলো একাত্তরের ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযমের বিচার শুরু হয়েছে। আর তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের দিনে তিনি দাবি করেছেন তিনি নাকি দালালদের মিছিলে ক্ষমাপ্রাপ্ত! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, ইত্যাদি!

তা বঙ্গবন্ধু মুজিব ক্ষমা করেছিলেন কাদেরকে? এই গোলাম আযমরা কী সেই ক্ষমতার আওতায় পড়েন? এই গোলাম আযম কী তখনও দেশের বাইরে বসে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের’ স্বপ্নে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন না? সারাদিন এরা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকার নিয়ে চিল্লায়, কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের সংজ্ঞাটিও তারা কী পড়েছে কখনও? নাকি পড়ে- জেনেও না জানার ভান করে বসে আছে?

বাংলাদেশে একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয়েছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্র এ ধরনের অপরাধ ক্ষমা করতে পারে না।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে স্বদেশবাসীর বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকার কথা কি ভুলে গেছে গোলাম আযম গং?

রোববার কোর্টে আরেকটি কথা বলেছেন ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযম! তাহলো ২০০১’র আগে নাকি কেউ এই বিচারের কথা বলেনি। ২০০১ সালে নির্বাচনে হেরে গিয়ে নাকি আওয়ামী লীগ এই বিচারের কথা বলা শুরু করেছে, ইত্যাদি!

তা চল্লিশ বছর ধরে যে আমরা আমাদের স্বজন হারানোর বিচার দাবি করে আসছি, তা কী কোনো দাবি না? নাকি আমরা শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাদের কাছে মানুষ না? বা আমাদের তারা মানুষের খাতায় গোনেন না?

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমান যখন দালাল আইন বাতিল করে জেলখানায় আটক একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দিলেন, সেই সুযোগে পাকিস্তানি পাসপোর্টে দেশে ফিরে এলেন গোলাম আযম, আর গেলেন না! এরপর থেকে জিয়া-এরশাদের ধারাবাহিক যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার তোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শুরু করা কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান-শাহরিরায় কবিরদের আন্দোলন কি কিছুই না? তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশকেন্দ্রের ব্যানারে প্রকাশিত ‘একাত্তরের দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থের মাধ্যমে গোলাম আযমসহ ঘাতকদের অবস্থান চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। এরপর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে মিশে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের শত্রু এই ঘাতককূলের বিচারের দাবি থেকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা একদিনের জন্যেও সরে আসেনি।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের বিজয়ে উল্লসিত জাতি যখন উৎসবে ব্যস্ত সেই সুযোগে নিজেকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করেন পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম! সেই তখনো শহীদ পরিবারগুলোর পক্ষে প্রথম প্রতিবাদ ঘোষণা করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। সেই প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় আজ শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। গোলাম আযমসহ একাত্তরের শীর্ষ খুনি যুদ্ধাপরাধীরা আজ গরাদের ভিতরে!
 
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃ্ত্বাধীন সেই আন্দোলন পণ্ড করতে সেদিন এই খুনি গোলামরা বিএনপিকে ব্যবহার করে দেশ জুড়ে কী তাণ্ডবই না চালিয়েছে তা কী আমরা ভুলে গেছি? খালেদা জিয়া-মির্জা ফখরুলরা আজ বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের বিরু্দ্ধে সোচ্চার কথাবার্তা বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত শহীদ-জননীর ওপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে নির্দয় নির্যাতনের সেই বৃত্তান্ত কী তারা ভুলে গেছেন? শহীদ-জননী কী কখনো ক্ষমতায় যেতে চেয়েছেন? না শুধু চেয়েছিলেন এই ঘাতকদের বিচার? তার নেতৃ্ত্বাধীন গণআদালত বানচালের খায়েশে  এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল কে? কারা শহীদ-জননীসহ ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়েছিল?  (এ সংখ্যাটি আসলে ২৩ জন হবে। সেই ২৪ জনের মধ্যে একজন ছিলেন অনুপ্রবেশকারী, যিনি পরে তার আসল জায়গা অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত শিবিরে ফেরত গেছেন)।

যে শহীদ-জননীর সন্তানের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে দেশ, সে দেশে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়ে মরতে হয়েছে! এই প্রথম রাষ্ট্র আমাদের এই বিচারের দাবি অফিসিয়ালি মেনে নিয়ে সে বিচার শুরু করেছে। আর ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম শোনাচ্ছেন তিনি নাকি ক্ষমাপ্রাপ্ত দালাল! উনিতো সাধারণ কেউ না, পালের গোদা, তার বিচারটিও হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। কারণ বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের কান্নার জন্য এই পালের গোদা দায়ী।

নানান অজ্ঞাত কারণে এই সরকারও এই পালের গোদা গোলাম আযমকে গ্রেফতারে দেরি করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর দু’বছরেরও বেশি সময় পর এসে তাকে গ্রেফতার করা হয়। যিনি এখন জামাই আদরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে আছেন! পাছে আবার ওজন কমে যায় এ আশংকায় খানাপিনাসহ সবকিছুই তাকে মর্জিমাফিক দেওয়া হচ্ছে!

সব দেয়া হোক, কিন্তু আমরা চাই অতি দ্রুত এই বিচার যেন শেষ করা হয়। শাস্তি যাতে কার্যকর করা হয়। কত শহীদ মাতা, শহীদ জায়া এখনও এই বিচার দেখে যাবার আশায় অপেক্ষায় বেঁচে আছেন। সেই অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত যেন না করা হয়।

জাতির বিশেষ এই মূহুর্তে শহীদ জননীকে শ্রদ্ধা জানাই। তার আন্দোলনের ভ্যানগার্ড সৈনিকদের অভিনন্দন। কিন্তু সাবধান। সামনে আরও অনেক প্রতিকূলতা সৃষ্টির ফন্দি-ফিকির হতে পারে। এসব সামাল দিয়ে সামনে আরও অনেক পথ যে আমাদের যেতে হবে সাঁঝের মিশ্র আলোতে। ঘাতকদের ফাঁসি ছাড়া বিকল্প দাবি নেই। ফাঁসির নিচে মানবো না কিছু।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ০৯৪৯ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১২
এমএমকে

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 

[email protected]
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।