ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আর নামতা শেখাবেন না, এক এক্কে এক....

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৯ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১২
আর নামতা শেখাবেন না, এক এক্কে এক....

অক্সফোর্ড ডিকশনারী অনুযায়ী ইংরেজি MASTER শব্দের প্রচলিত অর্থ হলো, নিয়ন্ত্রণকারী, মালিক বা প্রভু, কোন বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তি এবং পুরাতন ব্যবহার হিসেবে প্রাইভেট স্কুলের পুরুষ শিক্ষক। ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার কারণে হয়ত ইংরেজি ভাষাটা বরাবরই আমাদের কাছে সমীহ পেয়ে এসেছে।

এখনও গ্রামে দু’একটা ইংরেজি জানা লোকের কদরই আলাদা। শহরেও চাকরি পাবার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বাড়তি যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়। সেকারণে হয়ত স্কুলের শিক্ষকদের ইজ্জত করে অনেক জায়গায় মাস্টার ডাকা হয়।
 
অনেক নামীদামী  লোকদের কাছে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা সবচেয়ে সম্মানের স্থানে। কারণ শিক্ষার ভিত্তিটা তারাই তৈরি করে দেন।
 
তখন আমি ফরিদপুর পুলিশ লাইন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। এখন সেখানে কারা পড়ান জানি না। তবে সেই সময়ে পুলিশ বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের ভিতরে যারা একটু মেধাবী ছিলেন তারা বাচ্চাদের পড়াতেন। একদিন আমার এক শিক্ষক ছাত্রদের কি যেন বোঝাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে পুলিশের এক বড় কর্তা পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে স্যার তাকে স্যালুট ঠুকতে পারেননি। কারণ তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন বাচ্চাদের পড়ালেখার কাজে। খেসারত হিসেবে তাকে স্কুল থেকে সরিয়ে সাধারণ ডিউটিতে ফেরত নেওয়া হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীদের সামনে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করা হয়েছিল। এরপর আমার সেই শিক্ষক বন্দুক হাতে যখন পাহারা দিতেন, আমাদের হেঁটে যেতে দেখে মুখ লুকাতেন। স্যারকে দেখে আমরা সালাম ঠুকতাম। তিনি মলিন কন্ঠে অনুরোধ করতেন, তোরা এ পথ দিয়ে আর আসিস না। শিক্ষার্থীদের সামনে তিনি যে অপমানটা হয়েছিলেন, সেটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। স্যারের সেই লজ্জা আজ এতো বছর পরে মনে পড়লেও খুব কষ্ট হয়।
 
আরেকটা ঘটনা। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে মোল্লাহাটে গেলাম। সে সময়ে মোল্লাহাট ছিল নিতান্তই এক গাঁও-গেরাম। সেখানকার এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের কথা। স্যার অসুস্থ্। সাইকেল চালিয়ে এক বিকেলে স্যারকে দেখতে গেলাম। জরাজীর্ণ একটা কুঁড়েঘরের মতো হবে তার বাড়িটা। যাবার পরে স্যার ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলেন কোথায় বসতে দেবেন সেই ভেবে। একটা পাটি বিছিয়ে দিলেন। স্পষ্ট মনে আছে, স্যার সবুজ রঙের একটা লুঙ্গী পড়া ছিলেন। মাঝখানটার ছেঁড়া অংশটা অতি যত্নে সেলাই করা। অবাক হয়েছিলাম, একজন শিক্ষকের অবস্থা কি এই হতে পারে? ছোটবেলার সব বীরেরা থাকে কল্পনার জগতে অনেক উঁচুতে। আমার শিশুরমনের ভাবনায় সে সময়কার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা ছিলেন হিরো, ফিলোসফার। আমার হিরোর টানাপোড়নের জীবন আমাকে হতবাক করেছিল। আজও তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
 
সেই শিক্ষকরা তাদের কিছু দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। প্রায় সব খবরের কাগজে দেখলাম একজন বৃদ্ধ শিক্ষককে তার ছেলের বয়েসী দু’জন পুলিশ জামার কলার ধরে টানতে টানতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন পুলিশের পিটুনি খেয়ে পরে মারা যান। শিক্ষক মো: আজিজুর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে আজিজুর রহমানদের ত্যাগ এবং বীরত্বে গড়া দেশের বুকে দাঁড়িয়ে, স্বাধীনতার ফলভোগকারী নতুন প্রজন্মের তারই সন্তানতুল্য কোনো পুলিশ সদস্যের পিটুনিতে অসুস্থ্ হয়ে পরে মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী ``মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই”। একজন মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক ঠিক সেভাবেই মরে আবারও প্রমাণ করলেন যে, মসির চেয়ে অসির শক্তি অনেক, অনেক বেশি। পিটুনি খাওয়া শিক্ষকরাতো বটেই, সারা জাতি তাদের প্রকৃত মাস্টারকে (মালিক, নিয়ন্ত্রণকারী এই অর্থে) চিনতে পেরেছে। এই মাস্টাররা সাংসদ পিটিয়ে প্রমোশন পায়, এই মাস্টাররা মানুষ ধরে থানার ভিতরে ঝুলিয়ে পিটিয়ে মডেল (!) থানায় বদলি পায়। শিক্ষক পেটানো এবারের হিরোরা কি পুরস্কার পেতে যাচ্ছে, কে জানে!

প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে পুলিশের কিই বা করার থাকে। কথাটা এক অর্থে হয়তো ঠিক। কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবেছি, আমাদের কোন ন্যায্য দাবিটা কোন সরকার তাদের আমলে আপসে, যুক্তির বলে মেনে নিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজকে এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে, ভাংচুর, বিশৃঙ্খলা করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই কেউ কোন দাবি মেনে নেয় না। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরাতো ধ্বংসাত্নক কোনো পথে যাননি। চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একজনকে স্মারকলিপি দিতে। শিক্ষকরা বেঁচে থাকার জন্য এর বাইরে গান্ধীজীর নীতি অবলম্বন করলে কি হতো? হয়তো বা সংবাদপত্রের খবরও সেটা হতো না।

পুলিশরা কি একবারও ভেবেছিল, এই যে তারা শিক্ষক পেটাচ্ছে, টেলিভিশনের পর্দায় তার সন্তানেরা দেখবে সে দৃশ্য। হয়তো পিটুনি খাওয়া সেই শিক্ষকদেরই ছাত্রছাত্রীরা অসহায়ভাবে টিভি পর্দায় দেখবে তাদের সম্মানের স্থানটাকে খানখান করে ভেঙ্গে যেতে। তারপর? ঐ কোমলমতি শিশুরা কি কোনোদিন পারবে পুলিশদের ভাল নজরে দেখতে? কিংবা ঐ পুলিশদের সন্তানদের প্রতিক্রিয়াই বা কি হতে পারে? হতে পারে শিক্ষক পেটানো বাবার প্রতি ঘৃণা জন্ম নেবে। হতে পারে কচি মনেই গেঁথে যাবে, যারা আমার বাবার হাতে মার খেল, তাদের কথা শুনা বয়েই গেল! বাবার হাতে পিটুনি খাওয়া শিক্ষকরা কি শিক্ষা দেবেন তাদের সন্তানদের?

যে শিক্ষকরা আমার-আপনার সন্তানদের মানুষ করার মহান ব্রতে আছেন তাদের সংসারের খবর আমরা ক’জন রাখি। আমাদের সমাজে সব কিছুতেই বৈষম্য। বেতন কাঠামোতে বৈষম্য, আইনের ব্যবহারে বৈষম্য। বৈষম্যপূর্ণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত এই সমাজ কাঠামোতে এক শ্রেণীর মানুষের দিন আনতে পান্তা ফুরায়। অন্যদিকে, আরেক শ্রেণী অন্যের টাকা মেরে দিয়েও দিব্যি হজম করে ফেলে। টাকার প্রবাহ যখন অবৈধ হবে তখন সেটার ভুক্তভোগীতো কাউকে না কাউকে হতেই হবে। সেই ভুক্তভোগী সমাজেরই মানুষ আমাদের একেকজন শিক্ষক।
আজ হঠাৎ করে মনে পড়ল প্রথম স্কুল-জীবনের স্মৃতি। অতো ছোটবেলার ঘটনা খুব ঝাঁপসা মনে হয়।
চোখ বুজলে আজো সেই নামতা কানে ভেসে আসে, এক এক্কে এক, দুই এক্কে ………..

এক দল ছেলেমেয়ে সুর করে পড়ে যাচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটি স্বপ্ন গড়ার কারিগর। অথচ তার নিজের স্বপ্নই প্রতিদিন বাজারে গেলে খরচার খাতা খুলতেই, খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।

এখনো আমার সেই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের মতো সারা দেশের আনাচে কানাচে দরিদ্র, বঞ্চিত শিক্ষকরা, তাদের জীবনের একমাত্র সম্বল বিদ্যা দিয়ে কচি শিশুদের মনে শিক্ষার আলো জ্বেলে চলেছেন। তাদেরই একজন গত মঙ্গলবার রাতে মারা গেলেন পুলিশের পিটুনি খেয়ে অসুস্থ্ হয়ে।

জামালপুরের সেই আজিজুর রহমান, জীবনে আর কোনোদিন কোনো শিশুকে নামতা শেখাবেন না।

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ০৮৫৬ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১২
এমএমকে

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 

[email protected]
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।