ঢাকা, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

শুভ জন্মদিন মেনন ভাই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫২ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১২
শুভ জন্মদিন মেনন ভাই

আজ দেশের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, বাম রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল রাজনীতির পথিকৃৎ, অগ্রপথিক সেনানী, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের ৬৯তম জন্মবার্ষিকী। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর-ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামে তার পিতৃভূমি।

যদিও ১৯৪৩ সালের ১৮ মে তার জন্ম হয়েছে ফরিদপুর শহরে। পিতা বিচারপতি আব্দুল জব্বার খানের কর্মস্থল উপলক্ষে তাদের পরিবারটি সেখানে থাকতেন।

বাংলা সাহিত্যের অমর কবি, ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ সহ আরও অনেক বিখ্যাত কবিতার স্রষ্টা প্রয়াত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান এবং  হলিডে সম্পাদক প্রয়াত এনায়েতউল্লাহ খান তার বড় ভাই। আরেক ভাই শহীদুল্লাহ খান বাদল দেশের অন্যতম স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, ডেইলি নিউ এজ’র প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক। বোন সেলিমা রহমান বিএনপির বিশিষ্ট নেত্রী।

কিন্তু রাশেদ খান মেনন তথা আমাদের প্রিয় মেনন ভাইয়ের পরিচয়টি স্বনামে। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে স্বরচিত-সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এ সংগ্রামের শুরু, যা এখনও চলছে। ১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর ভিপি, ১৯৬৪-৬৭ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। পরবর্তীতে মস্কো না পিকিং এই দু’ধারার দ্বন্দ্বে তৎকালীন বাম রাজনীতির মতো ছাত্র ইউনিয়নও মতিয়া-মেনন এই দু’জনের নেতৃ্ত্বে-নামে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে দু’জনেই ছিলেন সামনের কাতারে। কাকতালীয়ভাবে এই দু’জনই আবার এখন এক ব্যানারে! একই ছায়াতলে! আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী কেবিনেট সদস্য। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মহাজোটের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। মেনন-মতিয়া দু’জনেই গত নির্বাচন নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন!

সাংবাদিকতা জীবনে মেনন ভাইয়ের সঙ্গে অনেক স্মৃতি। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিচিন্তার মাধ্যমে আমরা যখন মিডিয়ায় আনকোরা নতুন একদল সৃষ্টি সুখের উল্লাসী তরুণ কাজ শুরু করি, তখন চোখের সামনে রাজপথ কাঁপিয়ে বেড়ানো মেনন-ইনু-রনো-আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না, খালেকুজ্জামান, আব্দুল্লাহ সরকার, নির্মল সেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শিরীন আখতার, মুশতাক হোসেনসহ সেই সময়ের সব উজ্জ্বল নেতাদের ইন্টারভ্যু করে করে হাত পাকিয়েছি। ওয়ার্কার্স তৎকালীন যুবনেতা নূরুল ইসলাম ছোটন ভাইয়ের সঙ্গে বিচিন্তা পরিবারের বন্ধুদের সম্পর্কের কারণেও তোপখানা সড়কের ওয়ার্কার্স পার্টি অফিসে আমাদের যাওয়া আসা ছিল নিয়মিত। তোপখানা সড়কের পাশাপাশি দুটি গলিতে ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলসহ বেশ কয়েকটি বামপন্থী দলের অফিস ছিল। সেখানকার একটি সস্তা ভাত খাবার হোটেলের নাম হয়ে গিয়েছিল হোটেল পলিটিক্স!

শেখ হাসিনার নেতৃ্ত্বাধীন আট দল ও খালেদা জিয়ার নেতৃ্ত্বাধীন সাত দলের সঙ্গে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বাদ দিয়ে তখনো মাঝে মাঝে কাইজ্যা বেঁধে যেত। তখন সেই বড় দু’জোটকে আন্দোলনে ধরে রাখতে রেফারির ভূমিকা নিতো মেনন-ইনুদের পাঁচদলই জোট। আমরা যারা তখন এরশাদের বিরুদ্ধে একাট্টা আন্দোলন চাইতাম, তাদের সে কারণেই তখন পাঁচদলীয় জোট তথা মেনন ভাই-ইনু ভাইদের সঙ্গে বিশেষ একটি নৈকট্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তারা আমাদের বিশ্বাস করতেন। আন্দোলনের ধারা-প্রকৃতির অনেক এক্সক্লুসিভ তথ্য আগাম দিতেন। এক্সক্লুসিভ রিপোর্টের জন্য সোর্সের সঙ্গে যে কোনো রিপোর্টারের এমন সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ।

গণ আন্দোলনের চাপের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে স্বৈরাচারী এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হলে দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়ে যায়। প্রেস ক্লাবের সামনে তখন হাজার হাজার মানুষ! ড. কামাল হোসেন, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুসহ আরও অনেকে সেখানে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা শেষে সামনে দাঁড়ানো দেখে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেন মেনন ভাই, ইনু ভাইসহ আরও অনেকে। মেনন ভাই জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘বারী তুমিও কিন্তু রাজপথে-মিডিয়ায় অনেক পরিশ্রম করেছো। ’ আমাদের দু’জনের চোখেই তখন আনন্দাশ্রু। সে রাতটির কথা ভোলার নয়। সারারাত আন্দোলনের নেতা-কর্মী-মিডিয়ার মানুষেরা যে যাকে যেখানে পেয়েছি, যেন পরষ্পরকে ঈদের খুশির আনন্দে পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরেছি!

কিন্তু সেই আন্দোলনের বিজয়ও কিনা ধীরে ধীরে হাইজ্যাক হয়ে গেলো! ১৯৭৯ সালে বাবুগঞ্জের আসন থেকে মেনন ভাই প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে একই আসন থেকে পুননির্বাচিত হন তিনি। খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় এসে তাকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের সঙ্গে আলোচনা-আত্মসমর্পণে কাজে লাগায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়া চলাকালে ১৯৯২ সালের ১৭ আগস্ট তাকে তার তোপখানা সড়কের অফিসের সামনেই গুলিতে হত্যার চেষ্টা করা হয়। গুলিবিদ্ধ মূমূর্ষু রাশেদ খান মেননকে প্রথমে চিকিৎসা দেওয়া হয় সিএমএইচে। পরে তাকে ব্যাঙ্ককে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন।

খালেদা জিয়ার শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সঙ্গে যে শান্তি আলোচনা শুরু করা হয়, সেখানেও তিনি ছিলেন অন্যতম মুখ্য চরিত্র। আবার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃ্ত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে আন্দোলন শুরু হয়, সে আন্দোলনের পুরোভাগেও তিনি ছিলেন। শেখ হাসিনা, আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুরা ছিলেন সে আন্দোলনের কর্মী। তখন সেখানকার সবার নেত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

সর্বশেষ মেনন ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে লন্ডনে। লেবানন যুদ্ধ কাভার করে আমি লন্ডন গিয়ে উঠেছি ওয়ার্কার্স পার্টির প্রবাসী নেতা, সাংবাদিক ইসহাক কাজলের বাসায়। ইউরোপ ঘুরে লন্ডন পৌঁছে মেনন ভাইও একই বাসায় গিয়ে ওঠেন। হিথরো বিমান বন্দরে রিসিভ করতে গিয়ে তাকে প্রথম সার্ট-প্যান্ট পরা অবস্থায় দেখি। এ নিয়ে সেদিন তার সঙ্গে বেশ মজা করেছি।

তিনি বয়সে আমার অনেক অনেক বড়। আমার জন্মেরও অনেক বছর আগে ডাকসুর ভিপি হয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো যে কোনো কিছু শেয়ার করা যেত-যায়। রাজনীতিকদের এটিই বুঝি অনেক গুণের একটি।

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা লেখালেখি করেন রাশেদ খান মেনন তাদের অন্যতম। তার লেখাগুলো নিয়ে এরমাঝে পাঁচটি বই বেরিয়েছে। আমাদের দেশের বাম রাজনীতিবিদদের মতো তারও অনেক সমালোচনা আছে। এসব নেতাদের কাছে গুণমুগ্ধ মানুষের অনেক অনেক প্রত্যাশা থেকেই এসব সমালোচনার সৃষ্টি। যে দেশে রাজনীতি আজ পর্যন্ত পেশা হিসাবে স্বীকৃত না, সে দেশে এসব সমালোচনা থাকবেই।

তার মাপের মানুষ, যিনি ষাটের দশকে ডাকসুর ভিপি হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের অনেক কিছুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলেন, তিনি চাইলে ব্যক্তিগত বিষয়-সম্পদ কত কিছুই না করতে পারতেন! তাকেতো আমি নিজে তার ছোট ভাই শহীদুল্লাহ খান বাদলের বাড়ির ছাদের ওপরের একটি বাসায় দীর্ঘদিন পরিবার নিয়ে থাকতে দেখেছি। ভাবী তখন একটা চাকরি করতেন।

এসবের চেয়েও বড় রাশেদ খান মেননদের রাজনৈতিক সংগ্রামের দীর্ঘ জীবন। তাদের সংগ্রামের ধারাবাহিকতার সর্বোত্তম সৃষ্টি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যে কারণে দেশে-বিদেশে আমরা সবাই গর্বিত বাংলাদেশি বাঙালি।

শুভ জন্মদিন, মেনন ভাই। সুস্থ-বেঁচে থাকুন, অনেক অনেক বছর। আর লিখুন আপনাদের সময়ের পোড় খাওয়া তারুণ্যের সংগ্রামের বৃত্তান্ত। যা পড়ে-জেনে সংগ্রাম শিখবে নতুন প্রজন্ম।

ফজলুল বারী : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় : ১৪৪৫ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১২

সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।