ঢাকা, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

ভয়ানক বিপজ্জনক পুলিশ!

মানিক মুনতাসির, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১২
ভয়ানক বিপজ্জনক পুলিশ!

গল্পটা অনেক দিনের পুরনো। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি।

দিন তারিখ ঠিক মনে নেই। তবে এমন খরতাপের দিনই হবে। ঠাকুরগাঁও শহরের চৌরাস্তা এলাকায় আমার এক বন্ধুসহ বাইসাইকেলে করে যাচ্ছি। চৌরাস্তার মোড়ে দেখলাম একটি বড় বাস থেমে আছে। মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে দেখি কেউ কেউ কান্নাকাটি করছেন। একজন মানুষ চোখে পড়লো। তার ডান হাতটি ঝুলছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি খুলে পড়লো। বাম হাতে ধরে আছে লোকটি নিজেই। সে অবস্থায় তিনি রিক্সায় উঠে হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বাসটির পেছনে একটি ট্রাক। এইবার বুঝলাম ট্রাকটি যাত্রীবাহী বাসটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে। আমরা দুইজন ঘটনাস্থল ত্যাগ করার আগে ট্রাকের পেছন সাইডে গেলাম। ট্রাকের পেছনে একটা লেখা চোখে পড়ল “১০০ গজ দূরে থাকুন” আর বাসের পেছনে দেখলাম লেখা আছে “নিরাপদ দূরত্বে থাকুন” লেখাটা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। কেননা ট্রাকের ধাক্কায় বাসের পেছনটা দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে।

সেদিন ঐ লোকটি বেঁচেছিল কি-না জানি না তবে সে দুর্ঘটনায় তিনজন মানুষ মারা গিয়েছিল ঘটনাস্থলেই। কিন্তু ট্রাকটি নিরাপদেই ছিল। পরদিন পত্রিকা পড়ে জানতে পারি ট্রাকের চালকও নিরাপদে পালিয়ে বাঁচে। পুলিশ বা জনতা কেউই তাকে ধরতে পারেনি। ধরলেই বা-কি হয়তো পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে জামিন পেয়ে যেত।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যেসব ট্রাক চোখে পড়ে প্রত্যেকটির পেছনে লেখা থাকে “১০০ গজ দূরে থাকুন” অথবা লেখা থাকে “নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন”। অর্থাৎ মানুষকে বোঝানো হয় যে, কাছে গেলে বিপদ হওয়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনা এড়াতে দুটি গাড়ি পরস্পর থেকে যেন প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রাখে সেজন্য এটা লেখা হতেই পারে।

সিএনজি অটোরিক্সার গায়ে লেখা থাকে “আমি ছোট আমাকে মারবেন না” বা “পেছনে ইঞ্জিন ধাক্কা দেবেন না”। এরপরও অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হচ্ছে। অসহায় দিন যাপন করছেন দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ। ঘাতক চালকেরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অনায়াসেই---আইনের দুর্বলতা ও অপর্যাপ্ততার সুযোগ নিয়ে। পাবেই তো! স্বয়ং নৌমন্ত্রী যেখানে চালকের মুক্তির জন্য তদবির করেন তখন কী আর করা। তদবির তো করবেন-ই তিনি তো আর জনগণের মন্ত্রী নন, তিনি হলেন পরিবহণ শ্রমিকদের মন্ত্রী। তিনি হয়তো ঠিক কাজটেই করছেন!

বিদ্যুতের খাম্বায় যেখানে ট্রান্সফরমার থাকে সেখানে একটি কঙ্কালের ছবির সঙ্গে লেখা থাকে “বিপদজনক”। অর্থাৎ এটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার আবহান জানানো হয়েছে। এরপরও মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। এ ব্যাপারে অবশ্য কারো কোনো অভিযোগ থাকে না। কেননা এখানে বিদ্যুৎ মানুষের কাছে যায় না। মানুষই বিদ্যুতের কাছে যায়।

সড়ক দুঘটনায় নিহত সাংবাদিক বিভাস, দীনেশ দাস, শহীদুজ্জামান আর পা হারানো নিখিল ভদ্র এরা সবাই নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন। কিন্তু ঘাতক বাস এসে তাদের পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন,আহত হয়েছেন দুর্ঘটনাকবলিতরা। চালকরা কিন্তু নিরাপদে পালিয়েছে ঠিক-ই। তাদের বাসের গায়েও লেখা ছিল “নিরাপদ দূরত্বে থাকুন”। অথচ বাসগুলোই চালকের সহায়তায় তাদের ধাক্কা দিয়েছে। এখানে কিন্তু দুর্ঘটনাকবলিতরা কোনো বাসকে ধাক্কা দেন নি। তাহলে নিরাপদ দূরত্বে থাকার ফল কি দাঁড়িয়েছে সেটা সবারই জানা। দায়ী চালকদের কারোরই কিছু হয়নি। জেলহাজতও তাদের আটকাতে পারেনি।

নিখিল ভদ্র বাকি জীবন পঙ্গুতের অভিশাপ নিয়ে কাটিয়ে দেবেন। আর সেই ঘাতক চালক বুক ফুলিয়ে রাজপথে গাড়ি চালাবেন এটা যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীনেশ দাসের অবুঝ মেয়েটি একদিন জানবে তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। একদিন হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে এর কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না। এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে গণ্য করতে হবে।  

সাংবাদিক সাগর-রুনি দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিজেদের বেডরুমে ঘুমিয়েছিলেন। সেখানেও তাদের হত্যা করা হয়েছে। অবশ্য তাদের ভবনে হয়তো লেখা ছিল না “নিরাপদ দূরত্বে থাকুন”। থাকেলই বা-কি ঘাতকের চোখ তো আর তা দেখে না। ভয় ও পায় না। ঘাতকরা তো পালিয়েছেই। সঙ্গে অবুঝ শিশু মেঘের ভাগ্যটাকেও সাগরে ভাসিয়ে গেছে। তবে এই ঘাতকরা হয়তো ঘাতক চালকের চেয়ে একটু ভালো। কেননা তারা অবুঝ শিশুটির গায়ে একটি আঁচড়ও কাটেনি। এই নিরাপদ বেডরুমে বর্বরোচিত হ্যতাকান্ডের ব্যাখ্যা মেঘ জানতে চাইলে কেউ কি তা দিতে পারবে ? কারও কি সময় আছে এসব নিয়ে ভাবার!

সর্বশেষ গত রোববার আগারগাঁও এলাকায় একটি দৈনিক পত্রিকার তিন সাংবাদিক নিরাপদ দূরত্বে থেকেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। অথচ পুলিশ তাদের নির্বিচারে পিটিয়েছে। লাথি মেরেছে। বন্দুকের বাট দিয়ে মেরেছে। রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছে। সেদিন কিন্তু সাংবাদিকরা পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া বাধায় নি। সেদিন কেন, কোনোদিনই সাংবাদিকরা এমন কাজ করেনি। করবেও না। তবুও কেন এমন ঘটনা ঘটে এটার কি জবাব আছে কারো কাছে ? আদালত চত্বরে পুলিশ কর্তৃক যুবতীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করায় সাংবাদিকদের পেটানো হয়েছে। এতে কি আদালতকে অপমান করা হয়নি?

এদিকে রাতে মহাখালীতে বিডিনিউজের অফিসে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ছুরি মেরে পিটিয়ে তিন সাংবাদিককে গুরুতরভাবে জখম করে। সেদিনও কিন্তু সাংবাদিকরা নিরাপদ আশ্রয় নিজ কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখানেও তাদের পেটানো-কোপানো হলো। বিচার কি হবে কে জানে!  

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। হ্যাঁ ভালোই তো। সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে পুলিশ এখন অনেক তৎপর। পুলিশ জনগণের বন্ধু না হয়ে সরকার ও সরকারি দলের বন্ধু হয়ে গেছে। এটা হয়তো প্রশাসন দলীয়করণের ফল। যেখানে মেধাবী নয়, দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। এজন্য জনগণের কল্যাণে নয় পুলিশ এখন কাজ করছে রাজনৈতিক সরকারের কল্যাণে। আর সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব সৃষ্টি করতে সহায়তা করছে সরকার।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছেন, সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। তিনি এক ধরনের আহবানই জানিয়েছেন। এবার কে কি জবাব দেবেন জানি না। তবে এ কথা বলা যায় যে, পুলিশ হয়তো দিন দিন হিংস্র, ভয়ানক আর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। আগে রাস্তায় যে কোনো ধরনের বিপদ হলে মানুষ পুলিশের শরণাপন্ন হতেন। পুলিশও সহায়তা দিতো। এখন হয়তো মানুষ সেটা চায় না। বরং পুলিশ থেকে দূরে থাকতে চায় হেঁটে গেলে, বাইকে গেলে, প্রাইভেট গাড়িতে বা রিক্সায় গেলেও মানুষ কামনা করে যেন পুলিশ না আটকায় । অর্থাৎ মানুষ এখন মনে মনে ধরেই রাখে পুলিশ ধরলেই হয়রনি। অযথা ঝামেলা-দুর্ভোগ। পুলিশ অবশ্য এর প্রমাণও দিয়েছেণ বহুবার। শুধু সাধারণ মানষই নয়, এবার পুলিশ থেকে দূরে থাকতে হবে সাংবাদিকদেরও। অবশ্য পুলিশ তার প্রয়োজনের সময় বলে থাকে  ‘’সাংবাদিক-পুলিশ ভাই ভাই’’ কেননা পুলিশ ও সাংবাদিক একই সঙ্গে রাজপথে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু গত ক’দিনে পুলিশ ভাইদের যে চেহারা চেহারা দেখা গেছে তাতে তাদের কাছে যাওয়াই তো বিপজ্জনক!

মানিক মুনতাসির, সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।