ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাহারা`র ‘স্যাটেলাইট শহর’ ও ঢাকার ভবিষ্যৎ

ফয়সাল কবীর শুভ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৩ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১২
সাহারা`র ‘স্যাটেলাইট শহর’ ও ঢাকার ভবিষ্যৎ

পত্রিকায় যখন প্রথম এই খবর দেখলাম যে ভারতীয় বহুমুখি কোম্পানি ‘সাহারা’ ঢাকার উপকন্ঠে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে স্যাটেলাইট শহর বানাবে তখন প্রথমেই  দুটি প্রশ্নআমার মাথায় আসে- এক, ঢাকার উপকন্ঠে স্যাটেলাইট শহরে (উপশহর) করার জায়গা কোথায়- এটা কি রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) এর বাইরে না ভিতরে? আর, দুই, নিম্ন আয়ের মানুষদের আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্যে রাজউক/ সরকার বিদেশি ডেভেলপারের সাথে চুক্তি কেন করলো?

প্রসঙ্গত বলে রাখি- স্যাটেলাইট শহর বা উপশহর বলতে একটি বড় মেট্রোপলিটান শহরের কাছাকাছি এমন একটি শহর বোঝায় যা সেই শহরের অধিবাসীদের জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজ যেমনঃ চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বাজার, খেলাধুলা ইত্যাদির জন্যে সেই মেট্রোপলিটান শহরের উপর নির্ভর করবে না। ইন্টারনেটে গুগল এ অনুসন্ধান চালালেই পৃথিবীর অনেক দেশেই স্যাটেলাইট শহরের উদাহরণ পাওয়া যাবে।

তবে বাংলাদেশের মত জন ঘনবসতিপূর্ণ এবং তীব্র আয়বৈষম্যের দেশে উপরোল্লিখিত সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘স্যাটেলাইট শহর’ গড়ে তোলা বিভিন্নভাবেই দুঃসাধ্য। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মত শহর যেখানে কাজের সুবাদে ‘সেন্টার-পেরিফেরি’ সম্পর্ক এতো বেশি, সেখানে উত্তরার মত পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর পুরোপুরি সফল না হবার পরও নতুন স্যাটেলাইট শহর সফল হবার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমার মাথায় প্রথম যে প্রশ্ন এসেছে সেটার কারণ হলো- যে ধরনের স্যাটেলাইট শহরের কথা সাহারার কর্তাব্যক্তি এবং আমাদের সরকারের লোকজন বলছেন তার জন্যে ঢাকার উপকন্ঠে কয়েক হাজার একর জমি লাগবে। যদি ড্যাপের বাহিরে থেকে এই জমি লাগে তাহলে নিঃসন্দেহে তার বেশিরভাগ আসবে কৃষি এবং নিম্নভূমি থেকে যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদন এবং বৃষ্টির পানি ধারণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর। আর যদি ড্যাপ এলাকার মধ্যে হয়- তাহলে যে বিশাল পরিমাণ জমির দরকার পড়বে তার মূল্য পরিশোধপূর্বক সাহারা গ্রুপ যদি সেই প্রজেক্ট থেকে মুনাফা করতে চায় তাহলে নিঃসন্দেহে এর চাপ পড়বে সম্ভাব্য ভোক্তাগ্রুপের উপর।

প্রশ্ন হলো- তারা নিম্ন আয়ের মানুষ বলতে কাদের বোঝাচ্ছে যাদের কাছে থেকে তারা এই মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে? পুরো ব্যাপারটাতে তাই একটা শুভংকরের ফাঁকি থেকেই যাচ্ছে। এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের আবাসন সমস্যা সমধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ইতিপূর্বে নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি সফল হয়নি--- সেটাও বিবেচনা করা দরকার। এবং সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যতই বলা হোক এটা ‘নিম্ন-আয়ের’ মানুষের জন্য, সেটা শেষপর্যন্ত অন্য সব আয়ের মানুষের জন্য হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে যে থাকে না, সেটা নিশ্চিত।  

আরেকটা প্রাসঙ্গিক ব্যাপার, যদিও ঢাকার উপকন্ঠে জমির দাম নিয়ে আমার তেমন ভালো ধারণা নেই, তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, একটা ‘টাউনশিপ’ গড়ে তোলার জন্যে যে পরিমাণ জমির দরকার পড়বে তার দাম সাহারা’র সম্ভাব্য লগ্নির প্রস্তাবিত অর্থ থেকে বেশি হবে। সেইক্ষেত্রে তারা কি অতিরিক্ত টাকা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেবে?

এরপরের প্রশ্ন যেটা মাথায় এসেছে সেটা হলো ঢাকায় বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষদের বর্তমান জীবনযাত্রা নিয়ে। ঢাকার বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের মানুষ ঢাকা শহরের সীমানার দিকে থাকে; কারণ শহরের ভিতরের দিকের বাসাগুলো অনেক বেশি দামি হয়। যেগুলোতে থাকা তাদের ক্ষমতার বাইরে। তাই কষ্ট করে হলেও তারা গণপরিবহনে করে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহরের কেন্দ্রের দিকে (মতিঝিল, কাওরানবাজার ইত্যাদি) তাদের কর্মস্থলের দিকে আসে। এখন তাদের জন্যে যদি ঢাকা শহরের উপকন্ঠে স্যাটেলাইট শহর করা হয়, তাদের এই কর্মস্থলগুলাও সেখানে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যেটা বাস্তবে অসম্ভব। আর সেই কর্মস্থলগুলো যদি সরিয়েও নেয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এই কর্মস্থলগুলাকে ঘিরে বৃত্তাকার (কাল্পনিক) জায়গাগুলা দামি হয়ে উঠবে যেমনটা ঢাকা শহরে এখন হয়েছে। এবং কোনো স্থান নিয়ে যখন বিভিন্ন আয়ের মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে সবচেয়ে যে বেশি দাম দেবার জন্যে প্রস্তুত থাকবে সে/ তারাই সেই জায়গা পাবে- এটাই বাস্তবতা। এই অবস্থায় ঢাকার উপকন্ঠে  নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে স্যাটেলাইট শহর গড়ার কথা বলা হলেও আদতে এটা একসময় উচ্চ আয়ের মানুষের বসবাসের শহর হয়ে যাবে এবং ঢাকা শহর আয়তন এবং আকারে অহেতুক বাড়বে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন শহরেই এইরকম অবস্থা দেখা যায়।

জোয়ানা ব্যারোস নামে একজন নগরবিদ ২০০৪ সালে তার পি এইচ ডি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মূল শহরের প্রান্তের দিকে যখন কম-মূল্যের জমিতে বসবাসকারী নিম্ন-আয়ের মানুষদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া শুরু করা হয় (আপগ্রেডেশন), তখন ধীরে ধীরে জায়গাগুলো উচ্চ-মূল্যের জমিতে পরিণত হয়। নিম্নআয়ের মানুষেরা সেখানে আর থাকতে পারে না। ঐ জায়গাগুলো তখন শহরের ভিতরে যেসব উচ্চ-আয়ের মানুষেরা আগে থেকে থাকতো তারা এসে দখল নেওয়া শুরু করে। এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে মূল শহরে একধরনের ‘ক্ষয়’ দেখা গেলেও শহরগুলো অযাচিতভাবে বাড়তে থাকে।

উচ্চ আয়ের মানুষেরা যখন শহরের বাইরের দিকে থাকা শুরু করবে, প্রতিদিন পিকটাইমে সেটার প্রভাব পড়বে শহরের প্রবেশপথগুলাতে। উচ্চ আয়ের মানুষদের ব্যক্তিগত বাহনের উপর নির্ভরশীলতা, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা ইত্যাদি কারণেই শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে যখন শহর আরো বাড়তে থাকবে। তাই এই মুহূর্তে ঢাকার উপকন্ঠে স্যাটেলাইট টাউনশিপ কোনো সমস্যার সমাধান তো করবেই না বরং সমস্যা আরো বাড়বে। সমস্যা হলো আমাদের দেশে নগর পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলাতে কখনোই ২০-২৫ বছরের একটা মডেল প্রাক্কলন করা হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন শহর কর্তৃপক্ষ অতীত এবং বর্তমান অবস্থার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মডেল এবং সিমুলেশনের মাধ্যমে  শহরের বিভিন্ন ডায়নামিক চরিত্রের (যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়) একটা প্রাক্কলন করে; এ থেকে শহরের আকার বৃদ্ধি এবং তার প্রভাব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। অথচ আমাদের দেশের ‘তাৎক্ষণিক’ সমস্যা সমাধানে জোর বেশি দেওয়া হয়। আর এইজন্যেই আমাদের কর্তাব্যক্তিরা সাহারা গ্রুপের মত একটা ‘বেনিয়া’ কোম্পানির বাংলাদেশে অর্থলগ্নিতেই খুশি হয়ে যায়।   কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করে না যে, যে খাতে তারা এতো উৎসাহ দেখাচ্ছে তা আদতে আমাদের জন্যে কতখানি উপকারী?

পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা পরিবেশগত ব্যাপারকে একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। অথচ ‘টেকসই উন্নয়ন’ বা ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের’ অন্যতম অংশ হলো পরিবেশ সুরক্ষা। আর এই জন্যে যে কোনো ধরনের ভূমি উন্নয়নমূলক প্রজেক্টে ‘পরিবেশগত সমীক্ষা’ বা ‘এনভায়োরনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসম্যান্ট (ই আই এ)’ অতীব জরুরি। তাই ঢাকা শহরের উপকন্ঠে এইরকম টাউনশিপ এর পরিকল্পনার আগে ‘ই আই এ’ অবশ্যই করা উচিত।

আমি এরই মধ্যে আমার পরিচিত কয়েকজন পরিকল্পনাবিদ, স্থাপত্যবিদ, প্রকৌশলী যারা শিক্ষকতা কিংবা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে কাজ করছে তাদের সাথে কথা বলেছি এবং কেউই এই টাউনশিপের ব্যাপারটা কারিগরি কারণেই মেনে নিতে পারছে না। দু:খজনক হলেও সত্য যে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন যেমন- ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স, রিহ্যাব,  ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস অব বাংলাদেশ প্রমুখেরা এখনো এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। এই ক্ষেত্রে সম্ভাব্য দেশি যে সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেই রিয়েল এস্টেট কোম্পানিদের সংগঠন ‘রিহ্যাব’ এর কর্তাব্যক্তি একজন জনপ্রতিনিধি। তাই সরকারি সমঝোতায় সাহারার বিনিয়োগে যদি তিনি তার ব্যক্তিগত রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে লাভবান করাতে পারেন, তাহলে অবশ্যই অন্য কিছুর ধার ধারবেন না।

সাহারা অনেক বড় কোম্পানি হতে পারে, কিন্তু এরই মধ্যে তাদের অনেক অনিয়মের খবরই পত্রিকায় পাওয়া গিয়েছে সুতরাং এটা কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে টাউনশিপ সেক্টরে তাদের অর্থলগ্নি আমাদের দেশের জন্যে বড় কল্যাণ আনবে। কিন্তু সেসবের চেয়েও বড় ব্যাপার হলো টেকসই উন্নয়ন। অতীতে এই ‘টেকসই’ ব্যাপারটা শহর উন্নয়নে কখনোই অগ্রাধিকার দেইনি বলেই রাজধানী শহরে এতো এতো সমস্যা। তাই এক্ষেত্রে অন্য পেশাজীবীদের এই ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। বিশেষ করে যারা নগর বা ঢাকা শহর নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের উচিত হবে নিয়মিত বিরতিতে এই রকম টাউনশিপের সম্ভাব্য খারাপ প্রভাব সম্পর্কে প্রচার করা।  

হয়তো অনেকেই মনে করবেন যে, তাহলে কি ঢাকা শহরের নিম্ন-আয়ের মানুষদের আবাসন সমস্যার সমাধান অধরাই রয়ে যাবে? আমি এর জবাবে বলতে চাই- হয়তো শুনতে বিদ্রূপাত্মক লাগবে কিন্তু ঢাকা শহরে এই সমস্যার সমাধান হওয়া খুবই কঠিন বিষয়। এইজন্যে শহর ব্যবস্থাপনায় একটা আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক কাঠামো তাতে এই সমস্যার সমাধান একমাত্র পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপেই সম্ভব। আমি দু:খিত, এই সমস্যার সমাধান হয়তো আমি সঠিকভাবে এখানে বলতে পারবো না; তবে এইটুকু বলতে পারি এই সমস্যার সমাধানে ‘স্যাটেলাইট টাউনশিপ’--- তাও একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে-- কোনো ভালো ফলাফল আনবে না।

ফয়সাল কবীর শুভ
নগর পরিকল্পনাবিদ, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে উচ্চ শিক্ষারত।
[email protected]

সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ- [email protected];
জোয়েল মাজহার,
কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।