ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ইনি মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকারের প্রথম প্রমোটার!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৭ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১২
ইনি মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকারের প্রথম প্রমোটার!

এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের লন্ডন বক্তৃতার খবর আমি প্রথম অনলাইনে পাই। সিলেটিদের নিয়ে তার কথাগুলোর চুম্বক অংশ ফেসবুক স্ট্যাটাসে দিয়েছিলেন ঢাকাবাসী সিলেটি এক সাংবাদিক।

এই লোকটার অনেক কিছু জানি বলে প্রথমে গুরুত্ব দিতে চাইনি।

টাকার জোরে আজকাল পর্যাপ্ত লেখাপড়া-না-জানা অনেক ‘গাড়ল’ অথবা ‘ক্লাউন’ও ঢাকায় মিডিয়ামালিক বনে গেছে! আমার মতো হাজার হাজার সাংবাদিক তাদের অধীনে চাকরি করছে বা সংসার চালানোর জন্য তাদের চাকরি করতে হচ্ছে! বিলাতপ্রবাসী সিলেটি বা দেশে সরকারের প্রশাসনে ও রাজনীতিতে সিলেটিদের প্রভাব-প্রতাপের  নেপথ্যের কারণ জানতে যে পরিমাণ পড়াশুনা অথবা জানাশুনা থাকা দরকার, তা এই লোকটার নেই।

সব জেলার লোকজনের মধ্যে ভালোমন্দ মিলিয়ে থাকে। এই লোকটি অর্বাচীনের মতো তার স্বভাবসুলভ জঘন্য ভাষায় দেশের একটি অঞ্চলের মানুষজন সম্পর্কে যে বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছেন, তার  মাশুল তাকে কড়ায়গণ্ডায় দিতে হবে। এর মাঝে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে তার বর্ণবাদী বক্তব্যের স্বাভাবিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ``এটিএন বাংলা`` ও  ``অবিরাম বাংলার মুখ`` এখন সিলেটছাড়া!

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ক্যাবল অপারেটররা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে এটিএন বাংলা এবং এটিএন নিউজের সম্প্রচার বন্ধ করেছেন। প্রতিবাদ হচ্ছে গোটা সিলেট জুড়ে। বলা হয়েছে সিলেটে গিয়ে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আসতে হবে।

আমি তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আরেকটু যোগ করে বলছি, এই সুযোগে মিডিয়াকে এসব গাড়লমুক্ত করতে হবে। সিলেটবাসী যদি তাকে মাফও করে দেয় তাহলেও যেন গানের নামে এসব অখাদ্য-অসভ্য ভাঁড়ামো বন্ধের শর্ত দেয়। মানুষ টাকা দিয়ে টিভি চ্যানেল দেখবে, আর আপনি টাকাওয়ালা-টিভিওয়ালা বনে গেছেন বলে মানুষকে যা খুশি অখাদ্য দেখতে বাধ্য করবেন। মিডিয়ার নামে এসব ফাজলামো চলবে না।

সাগর-রুনিকে নিয়ে তিনি কি জঘন্য সব কথাবার্তা বলেছেন, তার ভিডিও রেকর্ড আছে। আবার ফ্যাসাদে পড়ে অন্য কথা বলবেন, রুনিকে কন্যাসম বলে পার পাবার ফন্দি করবেন, সবকিছু কি এতই সরলরেখায় চলে? সাংবাদিক সংগঠনগুলো, এটিএন হাউসের হেড অব নিউজ জ ই মামুন এক্ষেত্রে যে সাহসী ভূমিকা দেখিয়েছেন, এর জন্যে কৃতজ্ঞতা।
এটিএন নামের এই মিডিয়া প্রতিষ্ঠানটি এর কর্মীদের শ্রমে-ঘামে আজকের অবস্থানে এসেছে। প্রয়োজনে এটিএনকর্মীরা আপনাদের  হাউসকে বাঁচাতে চাইলে এর কর্তৃত্ব আপনাদের নিয়ন্ত্রণে নিন। তবু এই গাড়লের হাতে আপনাদের অর্জন ছেড়ে দেবেন না। কারণ সে আপনাদের-আমাদের বোন রুনিকে অপমান করেছে!
 
সিলেটের এমসি কলেজ (মুরারিচাঁদ মহাবিদ্যালয়) ভারতবিভাগ পূর্ববর্তী আসাম অঞ্চলের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে পাশাপাশি দু’টি কলেজ। একটি ইন্টার মিডিয়েট, অপরটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। গোটা এলাকার একমাত্র উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হওয়াতে এক সময় আসাম-মেঘালয়-ত্রিপুরা অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরাও সিলেট এমসি কলেজে পড়তে আসতেন। এ কারণে দীর্ঘদিন আসাম-মেঘালয়ের রাজ্যসভার বিধায়ক-প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ছিলেন এমসি কলেজের গ্র্যাজুয়েট।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুরু করে আজকের বাংলাদেশের প্রশাসনসহ নানাক্ষেত্রে এক সময় সিলেট অঞ্চলের লোকজনের প্রাধান্য ছিল। ফরেন সার্ভিস থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রের হিসাব নিলে তা বেরিয়ে আসবে। দেশের অন্যসব অঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে মাঝে সিলেট অঞ্চলে পড়াশুনার ঝোঁক কমেছিল। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতিও পাল্টেছে। সিলেট অঞ্চলের পড়াশুনায় অগ্রগতির বিষয়টি উঠে আসছে দেশের নানা পরীক্ষার পরিসংখ্যানে! আর কোথা থেকে ``ডক্টরেট`` উপাধি কিনে আনা মাহফুজুর রহমান সিলেটের মানুষজনের পড়াশুনা আর ভদ্রতা-ভব্যতা নিয়ে কটাক্ষ করেন! যেন আগে সিলেটের কেউ পড়াশুনা করতো না, এখনই শুধু  করছে! বিলাতে তিনি যে এটিএন চালাচ্ছেন, এর বিজ্ঞাপনসহ এগুলোর অর্থের উৎস কোথায়?

প্রবাসী সিলেটি অর্থাৎ বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রায় চৌদ্দ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে বিলাতে। এর মাঝে নবীগঞ্জের আমিন আলীর মালিকানাধীন রেডফোর্ট রেস্টুরেন্টটি বিলাতের টপ টেন রেস্টুরেন্টের একটি। এসব রেস্টুরেন্টের গুণাগুণ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নথিতে আছে “ফিফটি ফাইভ পার্সেন্ট ব্রিটিশ পিপল আর এডিকটেড বাই দিস ফুড”! অর্থাৎ এখন বেশিরভাগ খাস বিলেতি-বিদেশি সপ্তাহে অন্তত তিনদিন এসব রেস্টুরেন্টের খাবার খান। ম্যানচেস্টারের ইবকো শিল্পগ্রুপের মালিক ইকবাল আহমদ সারা বিলাতের সেরা ধনকুবেরদের একজন। অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করা রোশনারা আলী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। বিলাত-আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ার নানা প্রান্তে প্রবাসী সিলেটি বাংলাদেশিরা প্রতিষ্ঠিত স্ব স্ব যোগ্যতায়। আর এই লোকটি বিলাতে ব্যবসা করতে গিয়ে কিনা তার অডিয়েন্সকে কটাক্ষ করে কথা বলে! গাড়ল ছাড়া তাকে আর কি বলা যায়?

এই লোকটি যে কী বলতে পারে, তা নিয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতা আছে। অনেকের হয়তো মনে আছে, ইনি হচ্ছেন দেশের মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকারের প্রথম প্রমোটার! বাচ্চু রাজাকারকে নিয়ে যখন এটিএন বয়ান প্রচার শুরু করে তখন ফরিদপুর অঞ্চলে একাত্তরে তার হাতে নির্যাতিত অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এসব নিয়ে মাহফুজুর রহমানকে ফোন করলে মুখের ওপর বলেন, “আমি ব্যবসায়ী, ব্যবসা করতে নামছি, যা যা করলে ব্যবসা হইবো তাই আমি করমু। আপনারা যা খুশি করেন গিয়া!”

তখন আমি তাজ্জব বলে যাই তার কথায়। মিডিয়াও একটা ব্যবসা, কিন্তু এটিতো আর দশটা ব্যবসার মতো না, বা আলু-পটলের ব্যবসাও না! কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতাসহ স্বচ্ছ কিছু বিষয় জড়িত এর সঙ্গে। আসলে গত বিএনপি আমলে একুশে টিভি বন্ধ করে দিলে সেখানকার সাংবাদিক কর্মীদের বড় অংশ এটিএন’এ যোগ দিলে এ চ্যানেলটি কিছুটা দেখার মতো হয়। এর আগের পুরোটাই ছিল অখাদ্য! সঙ্গে ছিল ইভা রহমান নামের অত্যাচার। এর সঙ্গে আবার গানের নামে তার নতুন অত্যাচার শুরু হয়েছে।

ঢাকার মিডিয়া এর আগে আরেক তথাকথিত ডক্টরেটধারী মিজানুর রহমান মিজানের অত্যাচার সহ্য করেছে। এখন সে স্থান নিয়েছে মাহফুজুর রহমান!

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর কিছু মিডিয়ায় যখন মেয়ে বলে আমাদের প্রিয় ছোটবোন রুনি’র চরিত্র হনন করে রিপোর্ট হচ্ছিল, তখন চমকে যাই। রাস্তায় সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছে, তখন ওই ক্রাইম রিপোর্টাররা কি সাংবাদিক কমিউনিটির বাইরের কেউ ছিল নাকি? ঢাকার মিডিয়ার দায়িত্বশীল একাধিক বন্ধুকে ফোন করে অবাক হয়ে শুনি এসব রিপোর্ট করানোর পিছনে নাকি এটিএন হাউসের একজন নারী সাংবাদিকের হাত রয়েছে! সত্যি বলতে কি, এটা বিশ্বাস করতে চাইনি।

কিন্তু এখন খোদ মাহফুজুর রহমানের বক্তব্য শুনেতো দু`য়ে দু`য়ে চার মিলে সব জলের মতো পরিষ্কার! কর্তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা  নড়ে না! সে রাতে সাগর কেন ২টার মধ্যে বাসায় ফিরেছেন সে প্রশ্ন তুলেছেন মাহফুজুর রহমান, যা কিনা এর আগে একাধিক ক্রাইম রিপোর্টার দিয়ে করানো রিপোর্টে ছিল।

এর আগে অনলাইনে কিছু লোক সাগর-রুনি’র খুনের পেছনে মাহফুজুর রহমানের ভাইয়ের সম্ভাব্য সম্পর্ক নিয়ে প্রচার চালিয়েছে! আর এখন মাহফুজুর রহমান বলছেন, তার প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সাংবাদিক রুনি’র চরিত্র ভালো ছিলো না! এর জন্যে কি তিনি তাদের খুন করিয়েছেন? এর জবাব তার কাছে থেকে বের করতে হবে। এই যে একটা ক্লাউন তার প্রতিষ্ঠানের চাকুরে মৃত রুনি’কে আবার দ্বিতীয় দফায় হত্যা করলো এর দেশকাঁপানো তীব্র প্রতিবাদ আর বিচার হতে হবে আগে!

 জ ই মামুন মাহফুজুর রহমানের বক্তব্যকে প্রেসক্লাবের সমাবেশে এসে কুরুচিকর বলে নিন্দা জানিয়েছে বলেছেন, এর সঙ্গে এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরা মামুনের বক্তব্যকেই গ্রহণ করেছি। মামুনের বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, আজগুবি মিথ্যা বলেছেন মাহফুজুর রহমান! এমন দুশ্চরিত্র একজনকে এই সুযোগে দেশের মিডিয়া থেকে বের করে দিতে হবে। এমন একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা গেলে অন্তত সতর্ক হবে দেশে মিডিয়ার অবশিষ্ট সব গাড়ল!

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় : ২১০৮ ঘণ্টা, ০৭ জুন, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।