ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রিয় শিক্ষকের কাছে খোলা চিঠি: ম্যাডাম আজও ভুলিনি তোমায়

সেলিনা আফরোজ বৃষ্টি, বাংলানিউজ পাঠক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪২ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১২
প্রিয় শিক্ষকের কাছে খোলা চিঠি: ম্যাডাম আজও ভুলিনি তোমায়

প্রিয় ম্যাডাম মাহফুজা খানম,

অবশেষে দীর্ঘ নয় বছর পর তোমার কাছে লিখতে বসলাম। এভাবে লিখতে পারবো এটা কখনও ভাবিনি আমি।

তবে অনেক ভেবেছি তোমার কাছে আমার লেখা দরকার।

তোমার কাছে অনেক দিন পর লিখতে বসেছি। কিভাবে, কি দিয়ে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে মনে পড়ছে সেই কলেজের প্রথম দিককার দিনগুলোর কথা। যখন তুমি আমাদের কলেজে প্রথম আসলে। কী যে টান টান উত্তেজনা ছিল আমাদের মাঝে! নতুন ম্যাডাম আসছেন কলেজে, কেমন হবে, আগের ম্যাডাম খুব মুডি ছিলেন দেখে আমরা খুব হতাশ ছিলাম। অবশেষে আমাদের সেই হতাশা দুর হলো তোমাকে প্রথম দেখেই। জানি না, ম্যাডাম, আমি সত্যি বলছি! একদম সত্যি! কেন যেন তোমাকে দেখেই সকল উত্তেজনা, হতাশা দুর হয়ে গেলো সেদিন। আজো বুঝতে পারি না! কী আছে তোমার ওই মায়ের মতো চেহারার মধ্যে!

আমি গ্রামের মেয়ে। কখনও একা বাইরে থাকিনি। তারপরও ভালো কলেজে পড়বো বলে ভর্তি হয়েছিলাম মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে। বাড়ি থেকে কলেজ অনেক দুর হওয়ায় থাকতে হলো হোস্টেলে। নতুন কলেজ, নতুন শিক্ষক, নতুন বান্ধবী, নতুন পরিবেশ। সব মিলিয়ে কেমন যেন আনইজি লাগছিল আমার। সবার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারছিলাম না। তবে তোমাকে দেখার পর, তোমার কথা শোনার পর থেকে আমার সেই সব আনইজি কখন যে দুর হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি! মনের মধ্যে এক অজানা শিহরণ কাজ করেছে। এক ভালোলাগা কাজ করেছে।

ম্যাডাম, তোমার কথা-বার্তা, ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ সব-সব কিছুই আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছে। বেশ, এক অজানা টান অনুভব করেছি। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য পাগল হয়ে যেতাম! তোমার সান্নিধ্য খামোখা আমার ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে সব ক্লাশ কেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নেন না! একদিন আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে ঠিক করলাম তোমার সাথে ছবি তুলবো। পছন্দের মানুষের সাথে ছবি তোলা প্রচণ্ড সখ আমার। বান্ধবী তাসলিমা ও আরো কয়েকজন নিয়ে তোমার বাসায় গেলাম। প্রথমে তো বাসায় ঢুকতে সাহস পাচ্ছিলাম না। গেটে কতক্ষণ পায়চারি করে তারপর ঢুকলাম। তোমার বাসায় গিয়ে বসামাত্রই তুমি আমাদেরকে নাশতা দিলে। আজো মনে আছে সেই চানাচুর আর বিস্কুটের স্বাদের কথা। আমরা তোমার সাথে ছবি তোলার কথা বলতেই তুমি স্বাচ্ছন্দে রেডি হয়ে এলে আমাদের সাথে ছবি তুলতে। তোমার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা ছিলোনা। তুমি নিজেই আমাদের দুজনকে দুপাশে নিয়ে দুহাত দিয়ে মায়ের পরশে জড়িয়ে নিলে। ছবিটি দারুন উঠলেও তাসলিমার চোখ বন্ধ উঠলো। তো কী হয়েছে! ম্যাডাম আছে তো সাথে। আমাদের খুশি যেন ধরে না!

ম্যাডাম, জীবনের কিছু স্মৃতি, কিছু মুহুর্ত, কিছু কথা যেমন মানুষ ভুলতে পারে না আজীবন! আমিও সেইসব মানুষের কাতারে। আজো তোমার সেই মায়ের মতো চেহারার কথা, তোমার সেই মন ভুলানো উপদেশের কথা, সেই বুকে আগলে ধরার কথা ভুলতে পারি না ম্যাডাম। আমার খুব লোভ হতো, তোমার বেশি বেশি সান্নিধ্য পেতে। তাই বান্ধবীদের নিয়ে মাঝে মধ্যেই তোমার বাসায় যেতাম তোমার সাথে সময় কাটাতে, তোমার সান্নিধ্য পেতে। একদিন তোমার স্বামী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে। এখন তো তিনি আমাদের আইনমন্ত্রী। তাকে যখনই টিভিতে দেখি আমার তোমার কথা মনে পড়ে যায়। হৃদয়ের মনিকোঠায় ভেসে উঠে তোমার ছবি। তোমার সেই মায়াবী হাতের পরশ!

প্রিয় ম্যাডাম, আজ আমি শিক্ষক হয়েছি সেটাও শুধু তোমার অনুপ্রেরণায়, তোমার আদর্শ পেয়ে। কেউ না জানুক, আমি জানি। সেই নয় বছর আগে থেকেই বুকের মধ্যে চষে বেড়াতাম শিক্ষক হবো কথাটি। মুলত তোমাকে দেখে দেখে, তোমার আদর্শকে লালন করে আমার শিক্ষকতা পেশায় আসা। আমি চেষ্টা করি আমার ছাত্রছাত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে। আন্তরিকতার সাথে আমার দায়িত্ব পালন করতে। জানি না, তোমার মতো কতটুকু হতে পেরেছি? তবে চেষ্টা আমি করেই যাবো। আমি চাইবো, আজ যেমন যেমন আমি তোমাকে স্মরণ করছি, অনুসরণ করছি ঠিক তেমনি আমার ছাত্রছাত্রীরাও আমাকে স্মরণ করবে, আমাকে অনুসরণ করবে।

ম্যাডাম তোমার কি মনে আছে? যখন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিলে। সমস্ত কলেজ, হোস্টেল যেন থমকে গেল। আর আমি! কি করবো, কি ভাববো কিছু বুঝতে পারলাম না। আমার এতো খারাপ লাগছিলো যা ভাষায় বোঝানো যাবে না। আমি যে তোমাকে কতো ভালোবেসে ফেলেছি সেদিন বুঝলাম। মাঝে মধ্যে দুঃখ হয়, আমি যে তোমাকে এতো ভালোবাসি, এতো শ্রদ্ধা করি তা তুমি আজো জানতে পারলে না। আজ হয়তো আমাকে তুমি দেখলে চিনতেও পারবে না। কারণ তোমার মতো এতো ভাল মানুষের ভক্তের অভাব হয় না। তুমি কতজনকে মনে রাখবে? তোমার কি মনে পড়ে? আমাদের ক্লাশের সেই রিকশা চালকের মেয়ের কথা? টাকার অভাবে ওর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবার দশা হয়েছিল। তুমি ওর প্রতি মা এর হাত বাড়ালে। তুমি চলে যাবার সময় শেষ বক্তব্যে আমাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললে, ‘পড়ালেখার জন্য তোমরা যদি আমার দুয়ারে এসে দাঁড়াও তবে কোনদিনও ফেরত যাবে না। আমি আমার সাধ্য মত চেষ্টা করবো। ’ আমি রুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে তোমার কথাগুলো শুনছিলাম। জানি না কেন যেন চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝড়ছিল আমার। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিলো। শিক্ষার প্রতি কতটুকু আন্তরিকতা থাকলে একজন মানুষ তার ছাত্রদের এত বড় আশ্বাস দিতে পারেন? সত্যিই তুমি মহান।

আজ অনেক দিন পর আবার সবকিছু মনে পড়ে যাচ্ছে একের পর এক স্মৃতি। লিখতে লিখতে আজো চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। মায়ের জন্য মেয়ের চোখেতো পানি আসবেই। এটাই স্বাভাবিক। আজও তোমাকে দেখি আমাদের তোলা সেই ছবিতে। আমি আমার নয় মাসের মেয়েকে ছবিগুলো প্রায়ই দেখাই। আজো তোমাকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আজো আমি তোমার আদরের পরশ ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারিনি তোমার সেই কথা! ‘আমার কথার মধ্য থেকে যদি একটা কথা তোমরা স্মরণ করে রাখো, জীবনে সফল হবে। ’ আমার এই লেখা তুমি পড়বে কিনা জানি না। তবে আমি লিখতে পারছি তোমার কাছে এটাই আমার স্বার্থকতা। সবশেষে করুণাময়ের নিকট প্রার্থণা করি, তুমি ভালো থেকো, সুস্থ্য থেকো, সুখে থেকো মা।

সেলিনা আফরোজ বৃষ্টি, সহকারি শিক্ষক
মাগুরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মানিকগঞ্জ, [email protected]

বাংলাদেশ সময় ২১৩৩ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১২
এমএমকে- [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।