ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সর্বনাশটা ঘটে গেছে সবার অলক্ষেই!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫০ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১২
সর্বনাশটা ঘটে গেছে সবার অলক্ষেই!

Simone de Beauvoir এর Second Sex বইটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। এই বইটি তৎকালীন  নারীবাদী আন্দোলনের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত হতো।

এটি ৪০ এরও বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। চিন্তার বিপ্লবী ঢংয়ের কারণে বইটি একাধারে প্রশংসিত এবং সমালোচিত হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে নারীবাদ এবং জেন্ডারকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। তত্ত্বগতভাবে নারীবাদে যাই থাকুক না কেন, নারীবাদী কাউকে কাউকে ‘পুরুষের আধিপত্যবাদী’ দৃষ্টিভংগীর বদলে ‘পুরুষকেই’ প্রতিপক্ষ করতে দেখি। অন্যদিকে জেন্ডার, যা কিনা নারী পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে বুঝায়, সে ধারণায় পুরুষ প্রতিপক্ষ নয়, বরং বন্ধু এবং সেই অর্থে সহযোগী। তবে কেউ কেউ ইদানিং জেন্ডার এবং নারীবাদকে একই অর্থে বিবেচনা করছেন।

উল্লেখিত বইটি অনেক পুরু। বই সম্পর্কে আলোচনাও নয়। দু’একটা ছোট্ট্র উদ্ধৃতি দেব শুধু।
নারী আসলে কি?

“Woman? Very simple, say those who like simple answers; she is a womb, an ovary, she is a female: this word is enough to define her. From a man’s mouth, the epithet, ‘female’ sounds like an insult; but he, not ashamed of his animality, is proud to hear: ‘he is a male’!”-    Simone de Beauvoir.        

Pythagorasও নারী সম্পর্কে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভংগী ধরতে পেরেছিলেন সঠিকভাবে।

“There is a good principle which created order, light, and man, and an evil principle which created chaos, darkness, and woman.”    

এমনও মানুষ আছে বিধায় Poulain de Barre সাবধানী হতে বলেছেন পুরুষের যে কোন লেখা কিংবা কাজ সম্পর্কে। তিনি বলেছেন,

“Everything that men have written about women should be viewed with suspicion because they are both judge and party.”

তবে Shirley Chisholm বলেছেন বেশ চমৎকার কথা, “The emotional, sexual, and psychological stereotyping of females begins when the doctor says, "It`s a girl."  

জন্মের পর থেকেই কন্যা শিশু সন্তানটিকে শেখান হয় সে একজন নারী এবং শুরু হয় তার ‘Feminine destiny’ নারীমুখী যাত্রা, যেখানে একজন নারী হচ্ছে সেকেন্ড জেন্ডার। পুরুষের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই ‘ভাল নারী’ হবার একমাত্র পথ। পুরুষের যে কোন নিবর্তনমূলক কাজকে মাথা নেড়ে সমর্থন জানানোই তার কর্তব্য। প্রতিবাদহীন, প্রতিরোধহীন তার চরিত্র। এই হচ্ছে নারী।

এবার দু’টো গল্প বলি।
মেয়ের গল্প- মেয়ের জন্য স্কুল ইউনিফর্ম কিনেছি। একটু দেরী করে ফেলায় প্রায় সব দোকানেই স্টক শেষ হয়ে গেছে। খুব বেশি পছন্দ করার সুযোগ নেই। মেয়ের স্কুলে তিন রঙের ইউনিফর্ম। নেভি ব্লু, রয়েল ব্লু এবং রেড। ছেলে মেয়ের রঙ পছন্দ করায় আইনগত কোন বাঁধা নেই। তিনটি রঙের যে কোনটাই, যে কেউ পছন্দ করতে পারে। মেয়ের জন্য একটা লাল টিশার্ট কেনার পরে ভাবলাম, দ্বিতীয়টা ভিন্ন রঙের কিনি। রয়েল ব্লু কালার শেষ হয়ে যাওয়াতে নেভী ব্লু রংয়ের টিশার্ট কিনতে হলো।

ব্যাস, তাতেই বিপত্তি। বাসায় ঢুকেই অভিযোগ ওটা পাল্টাতে হবে। কারণ কোন মেয়ে এই রঙের পোশাক পড়ে না। রঙটা একান্ত ছেলেদের। লক্ষ্য করেছি, মেয়ে আড়াই/তিন বছর থেকেই নীল রঙের কিছু কিনতে চায় না। সব কিছুতেই গোলাপী রঙের প্রবণতা কাজ করে। রঙের প্রতি ভালবাসার টানে নয়। বরং এটা একান্ত মেয়েদের রঙ সেই ধারণা থেকে। অথচ পরিবারে আমরা কেউই রঙের সাথে নারীপুরুষের সম্পর্কটা কখনো শিক্ষা দেইনি। সবই পেয়েছে চারপাশের পরিবেশ থেকে। এইটুকুন বয়সেই সে রঙ দ্বারা নারীপুরুষ ভাগ করে ফেলেছে।

সমাজে এর প্রভাব কি হতে পারে। মেয়ের বাবার কাছ থেকেই দেখে নেই সেটা...।

বাবার গল্প- মেয়ের জন্য গোলাপী রঙের সব কিছু কিনতে কিনতে ভুলবশতঃ একবার নিজের শীতের কানঢাকা টুপিটাও গোলাপী রঙের কিনে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম। সেই গল্পে যাচ্ছি না।
রঙের গল্প না হলেও মেয়ের গল্পের সাথে মূল জায়গাটায় মিল আছে বেশ। শিক্ষানবীশ সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে গত দু’সপ্তাহে আমাকে পৃথক দু’টো প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়েছিল। প্রথম সপ্তাহের প্রশিক্ষণে ২০জনের মধ্যে আমরা তিন জন মাত্র পুরুষ ছিলাম। ২য় সপ্তাহে প্রশিক্ষণের সময় ১৫জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে আমি সবেধন নীলমণি একমাত্র পুরুষ জাতির মাথা উঁচু করে ধরে ছিলাম (সাত ভাই চম্পার উল্টো গল্প যেন!)। বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল ওয়ার্কে অধ্যয়নরত ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি।

এর কোনটাই দোষনীয় নয়। কিন্তু ঘটনাটা যদি ধারাবাহিকভাবেই ঘটতে থাকে তখন কিছুটা ভাবনার বিষয় বৈকি! সেই যে আমার মেয়ে শিশু অবস্থায় গোলাপী নীলে দীক্ষা নিচ্ছে, তার সংগে বাবার শিক্ষা এবং চাকরিক্ষেত্রে সংখ্যালঘুতার কোন সম্পর্ক আছে কিনা!

এভাবে উন্নত বিশ্বেও কাজের প্রতি ব্যাক্তি পছন্দ নির্ধারণের বেলায় অনেকটা ‘পুরুষের কাজ’, ‘মেয়েদের কাজ’ অলিখিত এই ধারণা কাজ করে।

ফুটবলে ভিন্ন ভিন্ন জার্সি গায়ে দিয়ে খেলোয়াররা প্রতিপক্ষ সনাক্ত করে তাদের ডেরায় হানা দেবার পথ সহজ করে। ঠিক তেমনি ভিন্ন ভিন্ন রঙের সাথে নারী পুরুষের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে এই একাবিংশ শতকে আমরা কি শিক্ষা নিচ্ছি? নারী পুরুষ এখনো উভয় উভয়ের প্রতিপক্ষ? সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের প্রথাগত নেতিবাচক আচরণে পুরুষের হস্তক্ষেপ থাকলেও রঙের খেলায় নারীদের অন্ততঃ সম্মতি আছে।

নারী পুরুষের এই প্রতিপক্ষ অবস্থানের যুদ্ধসাজ ইতিমধ্যেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন অবয়বে স্পষ্ট হচ্ছে। নতুন হলেও নারীবাদে Reverse gender polarity নামক স্বতন্ত্র একটি ধারা চালু হয়েছে। এরা উদ্যোগী হয়েছেন নারীকে পুরুষের সেই গতানুগতিক আধিপত্যের জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে। যে স্থান থেকে মুক্তি পেতে নারীরা যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে চলেছে। এই ধারার নারীবাদীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, নারীরা স্বতন্ত্রভাবে পুরুষের থেকে শ্রেষ্ঠ। অন্যদিকে, বিরোধী শিবিরও বসে নেই। ইতিমধ্যেই তারাও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। David Benatar রের লেখা ‘The Second Sexism, Discrimination against Men and Boys’ বইটি পড়লেই সেটা জানতে পারবেন। তবে এ বইয়ের লেখা সকল যুক্তি হেসে উড়িয়ে দেবার নয়। ভাবনায় ভ্রুঁ একটু হলেও কুঁচকাতে পারে। এভাবে নারীপুরুষের মধ্যে আমি আরেকটা যুদ্ধের পদধ্বনী শুনতে পাচ্ছি। সেটার প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন।

গোলাপী-নীল রঙের খেলায় কিংবা নারীর কাজ, পুরুষের কাজ এই ধারণার মাধ্যমে আমরা মূলতঃ জেন্ডার সমস্যা দূর না করে এতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছি। ছোটবেলা থেকেই রঙের মাধ্যমে নারীপুরুষকে আলাদা করে ফেলছি।

এই সর্বনাশটা ঘটছে অনেকটা সবার অলক্ষ্যে।
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।