ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পাদটীকা-৩

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১২
পাদটীকা-৩

’৯৬ সাল। একই অঙ্গে এত রূপের পালায় আমি তখন হংকংয়ে পুরোদুস্তর শিপিং আর বাল্ক ট্রেডিং ব্যবসায়ী।

চীনের বিভিন্ন বন্দর থেকে নিজেদের ভাড়া জাহাজে সিমেন্ট, ক্লিংকার আর বিভিন্ন সার তুলে চাটগাঁ- মংলার ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। আট বছরের ব্যবসায়িক জীবনে অনেকের অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত সহায়তা পেয়েছি অনেক। বড় ভাইর এক অনুজপ্রতিম ক্যাপ্টেন বন্ধু বাংলাদেশে আমার জাহাজগুলোর এজেন্সি করতেন। আমদানীকারকদের সাথে লিয়াজোঁ করে কাষ্টমস শুল্ক যথাসময় পরিশোধ করে মালামাল খালাসের ব্যবস্হায়ও সক্রিয় থাকতেন।
 
হিসাবপত্রে ‘টাকা-আনা-পাই’ হলেও আমার প্রতি ওনার গভীর মমত্ববোধ ও আন্তরিকতাকে খাটো করে দেখা অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত হবে। নিজের সবচেয়ে ছোট ভাইটি বয়সে ওনার চেয়ে ষোল বছরের ছোট। কলেজের চৌকাঠে পা রেখেই মজলেন গ্রিন কার্ডধারী যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী এক বালিকার প্রেমে। বালিকা মানে প্রকৃতার্থেই বালিকা। বড় জোর বয়স ১৫/১৬। জন্মের পরপরই সপরিবারে সন্দ্বীপ ছেড়ে নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে খুঁটি গেড়েছে। বাংলাদেশে খালার বাড়িতে একা একা বেড়াতে আসা বড় আহ্‌লাদী স্বভাবের কেয়ার ভালো লেগে যায় রাগীবকে। দু’জনেই ‘পিকচার পারফেক্ট’ টাইপ কিউট। যেন ‘মেইড ফর ইচ আদার’। কেয়ার নির্মল হাসি আর অবুঝের মতো সৎ উচ্চারণের কথাবার্তায় রাগ করবার কোনো জো থাকে না। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একধরনের নির্ভেজাল ইনোসেন্স থাকতো।
 
মার্কিন মুল্লুকের গ্রিন কার্ডধারী হাত ফসকাতে পারে আশংকায়, বন্ধু-বান্ধবেরা উৎসাহী হয়ে দু’জনের বিয়ে দিয়ে দেয় কাজী অফিসে পরিবারের অজান্তে। মার্কিন আইনে কেয়া নাবালিকা বিধায় বিয়েটা কিন্তু রাগীবের কোনো কাজে আসে না।   প্রায় আড়াই বছরের সুদীর্ঘ অপেক্ষায় ওদের থাকতে হবে বিয়ের বৈধতা অর্জনে। মাস ছয়েকের মধ্যেই কাকতলীয়ভাবে দুই পরিবারেই জানাজানি হয়ে যায় বিয়ের খবর। বড় ভাইয়ের বন্ধু সামাজিক লজ্জায় কেয়াকে নিজেদের যৌথ পরিবারের বাসায় তুলে আনতে বাধ্য হলেও বিয়েটা অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেন নি আনুষঙ্গিক বাস্তবতায়। এজন্যে কেয়ার সেই নির্ভেজাল ইনোসেন্সও দায়ী! শাশুড়ি-ভাসুর-জাল-ননাসদের সাথে সম্পর্কের ভাব বিনিময়ে রেসিপিতে নিপাট অজ্ঞ ছিলেন কেয়া।
 
ভাইয়ের বন্ধু একদিন আমাকে জরুরি টেলেক্স পাঠালেন ফোন করবার জন্যে। যথারীতি কথা হলো। বড় ভাইর বন্ধুটির দৃঢ বিশ্বাস রাগীব-কেয়ার বিয়েটা এক ধরনের মোহ উৎসারিত অতি ক্ষণস্হায়ী এক ধরনের অবুঝ আবেগ। দু’জনকে পরস্পর থেকে কিছুদিনের জন্যে পৃথক করা গেলে পারস্পরিক ঘোর লাগা মোহ আর যুক্তি-তর্কহীন অন্ধ আবেগের ইতি ঘটবে। আমি যদি রাগীবকে হংকং অফিসে চাকুরি দিয়ে নিয়ে যাই, সমস্যার একটা সুরাহা হতে বাধ্য! তখন হংকংয়ে তিন মাসের ’অন অ্যারাইভাল ভিসা’ ব্যবস্হা চালু ছিলো। পরের শুক্রবার রাগীব বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে হংকং পৌঁছালো। রাগীবকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনলেও কোনোদিন বিস্তারিত আলাপচারিতা হয়নি।
 
সুদর্শন রাগীব কাজে কর্মে বেশ ছটফটে হলেও কাজের ফাঁকে ও অবসরে প্রচণ্ড বিষন্ন থাকেন। কারণটা আমি জানি বলেই চেপে যাই। কিন্তু গিন্নি আর বন্ধু-সহকর্মী অমলকে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্হ মালুম হয়। পরে জেনেছি, ওদের যৌথ চাপাচাপিতে রাগীব নিজের করুণ দূর্দশার সকরুণ বর্ণনা দিয়েছিলেন। আমার অগোচরেই, আবেগাপ্লুত গিন্নি আর অমল যৌথ উদ্যোগে কেয়ার জন্যে ঢাকা-হংকং টিকেটের ব্যবস্হা করে ফেলেন। কেয়ার সংগে রাগীব ও আমার গিন্নির বিস্তারিত বাতচিত হয়। ’ষড়যন্ত্রের’ কোনো পর্যায়ে আমাকে রাখা হয়নি বিশ্বাসঘাতকতার আশংকায়।
 
পরের শুক্রবার বিকেলেই অমল ও রাগীব খুব জলদি অফিস ছাড়েন। গিন্নিও নিজের অফিস থেকে লাঞ্চের পর উধাও। রাতে বাসায় ফিরে দেখি আনন্দের ফোয়ারা বইছে ঘরে। সিডিতে বাজছে ব্যান্ডের বিভিন্ন সংগীত। বাতাসে পোলাও-কোর্মার ক্ষুধা জাগানিয়া ঘ্রাণ। কী এমন ঘটলো আমার অগোচরে? গম্ভীর অমলের মুখেও আনন্দের-সাফল্যের উঁকিঝুঁকি। অথচ শুক্রবার সন্ধ্যায় অমল চীনের সেনজানে স্ত্রী-কন্যার কাছে ফেরত যান। আজ চারিদিকে কেবল অনন্য ব্যতিক্রম! কিছু একটা নির্ঘাৎ ঘটেছে।
 
কিছুক্ষণ পর গিন্নির সাথে ভারী পাওয়ারের চশমা পরা একটা ‘বাচ্চা’ মেয়ে এসেই হুট করে পা ধরে সালাম করে বসলো। গিন্নি জানেন, আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম নিই না। বুঝলাম ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’ । জানলাম চাটগাঁ রেখে আসা মিসিং পাজলের এই সেই বাদবাকী অংশ। রাগীবের কোর্ট ম্যারেজের স্ত্রী কেয়া। গায়ে গতরে গাট্টগোট্টা হলেও গর্দানের ওপরের হলুদ অংশটুকু দশ বছর বয়সী নাবালিকা। কথায় কথায় কাঁচের চুড়ির টুং টাং মিষ্টি শব্দ তুলে কেবলই হাসে। সেকি অবিরাম বাঁধ ভাঙ্গা হাসি। কেয়ার হাসি দেখলে-শুনলে মনে হবে না দুনিয়ার কোনো কোণে কোথাও কোনো দুঃখ-বেদনা-কষ্ট লুকিয়ে আছে। কান্না শব্দটি চিরকাল অজানাই থেকে যাবে!  
 
সারাক্ষণ দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে প্রতিবেশ-পারিপার্শ্ব ভুলে প্রহরের পর প্রহর অতিক্রান্ত করেন। এমনও হয়েছে সন্ধ্যায় খেতে বসেছি একসাথে। আমরা খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেছি, তখনো তারা পরস্পরকে দেখেই চলছে, খাওয়া শুরুতো পরের ব্যাপার। ভাইয়ের বন্ধু এই ঘটনার জন্যে সরাসরি আমাকে দায়ী করে বাক্যালাপ ও ব্যবসা দু’টোই বন্ধ করে দিলেন। এদিকে ওদের ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ হবার উপক্রম। অমল বুদ্ধি করে চীনে নিজের বাসা থেকে সপ্তাহখানেক বেড়িয়ে আনলেন। তাতে ভিসার মেয়াদ আরো মাস তিনেকের জন্য বাড়লো। ওরা কেবল নির্বাক পরস্পরকে দেখে আর হাত ধরে বসে থাকে। কোনো কথা নেই বার্তা নেই, আছে কেবল মুগ্ধ নয়নে একে অপরকে দেখা। মাঝে মধ্যে ব্যাপারটা বিরক্তিকরও। কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলেও কেচ্ছা একই। সুন্দর সব প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকেও তাদের অনাগ্রহ।
 
ভিসার মেয়াদ শেষে রাগীব-কেয়া ফিরে যায় বাংলাদেশে। তবে আমার অজ্ঞাতে চাটগাঁয় না-গিয়ে ওরা ঢাকাতে থাকার একটা অ্যারেঞ্জম্যান্ট করে গিয়েছিলো। কিছুদিন পর ভিন্ন সব মাধ্যমে জানলাম রাগীবের মার্কিন ভিসা হয়েছে। ওরা এখন মার্কিন মুল্লুকে সুখী দম্পতি। হংকং ছাড়ার পর আর কোনোদিন যোগাযোগ হয়নি ওদের সাথে। সুখী যুগল নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলো!
 
২০০৯ সালে বড় ভাইর বাসায় দেখা হয়ে গেলো রাগীবের বড় বোনের মেয়ের সাথে। মুন্না জানালো ওর ছোট মামা মানে রাগীব আমার নাম্বার খুঁজছে। কয়েকদিন পর রাগীবের ই-মেল এলো ফোন নাম্বার সমেত। জানলাম সে এখন শিকাগোয়। দিন কয়েক পর রাগীবকে ফোন দিয়ে প্রথমেই কেয়ার খবরাখবর জানতে চাইলাম।
রাগীব হঠাৎ করে কেয়াকে স্মরণ করতে ব্যর্থ হলো। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে রাগীব জানালো, নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর মাস চারেকের মধ্যেই তাদের ’দু’জনার দু’টি পথ দু’দিকে গেছে বেঁকে’। কারণ কেয়া বড্ড পেছনে টেনে ধরে। সারাক্ষণ রাগীবকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চায়। কাজ-কামাইয়ের ধান্ধায় রাগীব সারাদিন বাইরে থাকুক এই ‘বিরহ’ কেয়ার অসহ্য! ভালোবাসার তীব্রতায় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক উড়ে-উবে যায়।
 
পাদটীকাঃ বন্ধু অমলের উক্তি মনে পড়ে গেলো। ভালোবাসার পরিমাণটা চিনির মতো। বেশি মিষ্টি হয়ে গেলে গলা দিয়ে নামে না। আমার নিজস্ব বিচারে ভালোবাসা হচ্ছে ফুটবল ম্যাচের মতো। এক নিঃশ্বাসে বলা হয়, ‘সাবাস, বাপের ব্যাটা বল গোলে হান্দাইয়া দেয়….. দুত্তুরি শালা, এটাও মিস করলি আবার... এই না-হলে বাঘের বাচ্চা!’
 
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
[email protected]
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, ১৪ অক্টোবর, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।