ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শান্তির পায়রা উড়িয়েছে মালালা

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১২
শান্তির পায়রা উড়িয়েছে মালালা

মালালা ইউসুফজাই সাম্প্রতিককালের সম্ভবত প্রথম কোন কিশোরী। যে বিশ্বব্যাপী সমবেদনা কুড়িয়েছে কোটি কোটি মানুষের।

মালালার গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে তাকে অন্তত আমার কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এরআগে যদিও মালালা পরিচিতি পেয়েছিলো তার লেখায়।

তার দ্রোহের সূচনা দিয়ে। ব্লগ লিখে ১১ বছরের মুসলিম শিশু যে মুসলমানদের রোষানলে পড়তে পারে, তার নজির সম্ভবত এই প্রথম। তা-ও এই ব্লগ লেখা ইসলামের বিরুদ্ধাচরন নয়- শুধুমাত্র তার শিক্ষার অধিকারটা জানান দিয়ে সে ব্লগ লেখা শুরু করেছে।

তার নিজস্ব ভাষা উর্দুতে লেখাগুলো (বিবিস উর্দু) পড়ার সুযোগ হয়নি আমার মতো অনেকেরই। কিন্তু কারো বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, কেন-ই বা উগ্রবাদীদের গাত্রদাহের কারণ হয় তার এই লেখাগুলো।

তালেবানদের দখলে যাওয়া পাকিস্তানের সোয়াট এলাকায় এখন অনেক কিছুই নিষিদ্ধ। এই শহরের শিশুরা পথে-ঘাটে না-কি লাশ দেখে দেখে বেড়ে উঠছে। এখানে শাসন চলে তালেবান নামক মুসলমানদের। এই মুসলমানরা এখানে নারীদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। মেয়েদের ঘরে বসার নির্দেশ দিয়েছে।

তাদের যৌনক্ষুধা নিবৃত্তির শুধুই এক উপাদান হিসেবে দেখতে চায় তারা তাদের। মেয়েদের শিক্ষা এখানে তালেবানী দৃষ্টিতে পাপ। আর এই পাপের পক্ষ নিয়ে হাজারো-লাখো নারীদের জাগিয়ে দিতে মালালা ইউসুফজাই যেন বাতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো।
এই বাতি নিভিয়ে দিতেই মালালা ইউসুফজাই এগারো বছর বয়স থেকে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ে।

সত্যি বলতে গেলে কি এ-ও এক বিস্ময় আমার কাছে। রাজনীতির মাঠে ১১ বছরের শিশুও প্রতিপক্ষ হতে পারে, তা ভাবনায় যেন কুলিয়ে ওঠা যায় না। তাইতো তাদের মাঠে নামা। প্রথমে শাসানো এবং এরপর কাপুরুষের মতো তার উপর সশস্ত্র আক্রমন। সারাবিশ্ব যখন মালালার ওপর এই আক্রমনে , নিন্দার ঝড় উঠেছে চারদিক থেকে, সেসময় তালেবান মুখপাত্র বলছেন মালালা গুপ্তচর ছিলো।

সে অবমুক্ত করে দিয়েছে তাদের সকল গোপনীয়তা। কি সেই গোপনীয়তা, সেকথা বলেননি সেই মুখপাত্র। আর সেজন্যেই নেশাগ্রস্থের মতো বলেছেন মালালা আগামী জুলাই মাসে ১৫ বছরে পা দেবে। তখন আর তাকে শিশু কিংবা কিশোরী বলা যাবে না। আর তখন তারা তাদের মিশন শেষ করবে অর্থাৎ মালালার জীবনের আগাম অনিরাপত্তার কথা তিনি ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন।

শুধু কি তাই, তারিক-ই তালেবান-এর প্রধানের সাম্প্রতিক দম্ভোক্তি-----কয়েকটি  টিভি চ্যানেলকে টার্গেট করে এর সম্পাদক সাংবাদিকদের তাদের হিটলিষ্টে রেখে দিয়েছেন ঘোষনা দিয়েই।

কেন শিক্ষা নিষিদ্ধ হবে ? পবিত্র ধর্মগ্রন্থে কি এই নিষেধ আছে ? বরং শিক্ষা অর্জনের জন্যে চীন পর্যন্ত যাবার কথা বলা হয়েছে। আমাদের রসুল (স:) একজন ব্যবসায়ী মহিলাকেই বিয়ে করেছিলেন। এ থেকে ধর্মে একজন মহিলাও যে ব্যবসা পরিচালনা করে সমৃদ্ধ জীবন চালাতে পারেন, তা কিন্তু আমাদের নবীর মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি।

১১ বছরের মালালা নারীদের আলোর পথে এগিয়ে যেতে উদ্দীপ্ত করছিলো, নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছিলো নারীদের সমৃদ্ধির। মাত্র তিন বছরের মাথায় এসে বলতে হবে মালালা আর একা নয় হাজারো-লাখো পাকিস্থানি শিশু আর নারীরা তার সঙ্গে আছে। আর তাইতো মালালার গুলিবিদ্ধ হবার পর পাকিস্তানের লাখো-কোটি কচিপ্রাণ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে ----মালালাকে ফিরিয়ে দেন আল্লাহ।

মালালা এখন ব্রিটেনের বার্মিংহামে। কোটি মানুষের আর্তনাদ আর প্রার্থনায় ফিরে আসবে হয়ত মালালা। বার্মিংহামের একটি অত্যাধুনিক হাসপাতালে মালালার চিকিৎসা হচ্ছে। মালালা একজন ব্রিটিশ নাগরিকের মতো সর্বোচ্চ সেবা পাচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস থেকে। মালালার জন্যে শত শত মানুষ সরাসরি অর্থনৈতিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

তার জন্যে সেট-আপ করা হয়েছে চ্যারিটি ফান্ডের। আমরা জানি ব্রিটিশ জনগন সময়ে সময়ে অসহায়ত্বে পাশে দাঁড়ায়,বিশেষতঃ শিশুদের পাশে। আর সেজন্যই হয়ত তারা ঘোষনা দিয়েছে, মালালার সুস্থ হবার পরই সিদ্ধান্ত হবে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় হবে কোন খাতে।

মালালা এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে আবারো বেড়ে উঠবে, এই প্রত্যাশায় সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে। মালালা পৃথিবীর লাখো-কোটি নির্যাতিত শিশু-কিংবা কিশোরদের একজন। পৃথিবীর অসহায় শিশুরা বলতে পারে না। প্রতিবাদের ভাষা এদের রুদ্ধ । মালালা এই রুদ্ধ অর্গলে করাঘাত করেছে মাত্র তিনটি বছর। এই তিনটি বছরেই সে জানিয়ে দিয়েছে, কিভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।

লেখনী কত শক্তিশালী হতে পারে, কিভাবে একটি ছোট হাতের লেখা কাঁপিয়ে দিতে পারে মৌলবাদের রক্তাক্ত হাত। সারা পৃথিবীর শিশু-কিশোর আর নির্যাতিত মানুষগুলো জেনে নিয়েছে কিভাবে বের হয়ে আসতে হয়। মালালা সেই বিদ্রোহীদের প্রতীক, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে বিশ্বের কোটি কোটি প্রাণ।

মালালা শান্তির শ্লোগান নিয়ে রক্তাক্ত। পাকিস্তান নামক রক্তঝরা দেশটিকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে তার শিশুপ্রাণ দিয়ে। আর তাইতো আজ পাকিস্তান থেকেই শুধু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চারিত হচ্ছে- মালালার নাম। শান্তিতে নোভেল প্রদানের এ প্রস্তাব গুরুত্ব পাবে নরওয়ের সিলেক্ট কমিটিতে, এটা বলা যায়।

এ বছর ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন শান্তির জন্যে নোবেল পেয়েছে। বলা হয়েছে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন অতি সম্প্রতি ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্র-মানবাধিকার-সমঝোতা আর শান্তির পক্ষে রেখেছে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আর সেজন্যেই বিভিন্ন দেশগুলোর রাজনৈতিক চাপসৃষ্টি কিংবা সাপোর্টেই হয়ত ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন পেয়েছে এই শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার।

মালালাকে নিয়েও সেকথাটিই উঠেছে এখন বিশ্বময়। মালালা একটা জাতিকে জাগিয়ে দিয়েছে। মালালা গোটা বিশ্বের নির্যাতিত শিশুদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন যুদ্ধ বন্ধের জন্যে উদ্যোগী হয়নি। মালালা এক শিক্ষিত নারী সমাজের স্বপ্ন দেখাচ্ছে সারা পৃথিবীকে। প্রকারান্তরে শান্তির পথে চালিয়ে যাচ্ছে কিশোরী বেলার জীবন-বাজী রাখা সংগ্রাম।  

নোবেল পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা থাকতেই পারে। সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও উচ্চারিত এই কথাটির মতো আমারও মনে হয় বিশ্ব শান্তির পথে একধাপ এগিয়ে দেয়া এই মালালা হোক আগামীর শান্তির প্রতীক। শান্তির নোবেল আসুক তার গলায়। গোটা পৃথিবীর অসহায় শিশুরাই হবে এই নোবেল পুরস্কারের অংশীদার।

ফারুক যোশী : যুক্তরাজ্য অভিবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক [email protected]
বাংলাদেশ সময় : ১১৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ১২০২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।