ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বারবার একই কাঁদুনি ‘সামনে তাকান, পেছনে নয়’

সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১২
বারবার একই কাঁদুনি ‘সামনে তাকান, পেছনে নয়’

যাদের অতীত এতো কলঙ্কিত, এতো রক্তাক্ত- তারা তো অতীতের মুখোমুখি হতে ভয় পাবেনই। একাত্তরের ঘাতক শক্তির হাতে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় আরোহন এবং পথ চলার সময়ে তারা বলেন, “সামনে তাকান।

অতীত নিয়ে অযথা ঘাঁটাঘাটি করতে চাই না, আপনারাও করবেন না”।

বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত। তাদের উদারনীতির কারণে খালেদা অথবা এরশাদ কেউই ভারত সফরে গিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা থেকে বঞ্চিত হননি। অতিথি নারায়ণ বলে কথা!
 
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া আগামী বার ক্ষমতায় আসবার জন্যে আঞ্চলিক মিত্রদের সমর্থন আদায়ের ব্রত মাথায় নিয়ে মাঠে নেমেছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ’র ভাষায়, ‘ভারতের কাছে নাকে খত দিয়ে’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে মাঠে নেমেছেন। ৬ অক্টোবর ঝিনাইদহে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে এ কথা বলেন হান্নান শাহ।

বিএনপি তাদের চিরসাথী জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হামলা, ত্রিপুরা-আসামের উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের জন্য ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার অথবা আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার সময়ে তার মনে ছিল না আরেকবার ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। অথবা ভেবেছিলেন অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবেন।

খালেদা এই ভারত সফর শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠজনদের নিত্য প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। যে ভারতবিরোধী প্রোপাগান্ডা রাজনীতির মাঠে তিনি বলে বেড়ান, সেটাই তো রাজনীতিতে তার শক্তিশালী পুঁজি। সেই পুঁজি কি হারাবেন তিনি? রাজনীতির মাঠ থেকেই তো তাকে ছিটকে পড়তে হবে।

তবু রাজনীতিতে শেষ কথা নেই। কৌশলগত কারণে ভারতের কাছে ‘নাকে খত’ দিলেও কোনভাবে ক্ষমতায় এলেই স্বরূপে ফিরে আবার ভারত বিরোধিতায় তৎপর হওয়ার নিশ্চয়তা চাইবে তার সমর্থক আর শরিকরা। তিনি এখন কৌশলগত কারণে নির্বাচনী আশীর্বাদ নিতে ভারতে অবস্থান করছেন।

ভারত শুধু আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, মানচিত্র দেখলে অনেকের মনে হতে পারে- ভারত নামক একটি দেশের বেষ্টনীর মধ্যে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে স্বাধীন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভারত প্রধানতম মিত্র হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় ভারত তৃতীয় বৃহত্তর অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেশটি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। এ কারণে বেগম জিয়ার ভারত সফর যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে বিশ্লেষিত হচ্ছে।
 
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে পাকিস্তানপ্রেমী রাজনৈতিক শক্তি প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত, উত্তেজিত ও কটুবাক্যে মুখর। সেই শক্তির নেতা  ‘স্বল্পভাষী’ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়া ও তার রাজনৈতিক দল এবং মিত্ররা ভারতবিরোধিতার শপথ নিয়েই রাজনীতি করছেন।

অবিভক্ত বাংলার এপারের সন্তান ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জ্যোতিবসু নাকি স্বৈরশাসক এরশাদকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আচ্ছা, আপনারা কথায় কথায় এভাবে ভারতকে গালাগাল করেন কেন?”

এরশাদ নাকি তার জবাবে বলেছিলেন, “ ভারতকে গালি না দিলে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ গরম করা যায় না”।

প্রায় ছ’মাস আগে ভারতীয় এক কূটনীতিকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিলো। জামায়াত-বিএনপি- জাতীয় পার্টিসহ বাংলাদেশের বিরোধীদল সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “তারা যখন ভারতের রাষ্ট্রীয় কোন  প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন, প্রথমেই বলেন, “দেখুন, আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য শুনবেন না, ওসব আমরা রাজপথে বলার জন্যে বলি ....। ”  
 
বেগম জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সরকারের শেষ সময়ে এসে ভারত সফরে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি দেশে বিদেশে আলোচনার বিষয়বস্তু । কারণ, চিরাচরিত নিয়মে যিনি ফেনী পর্যন্ত ভারতকে দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে- প্রতি মুহূর্তে এমন অভিযোগ যার- তিনি ‘ নাকে খত দিয়ে’ জপমন্ত্র ভুলে ভারতের করুণা প্রার্থী হলেন। নিজের দোষ স্বীকার করে হলেও যদি এবারের মতো ক্ষমতায় আসা যায়.... যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় তাকে আসতে হবে।

খালেদার ভারত সফর  নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে,  বাংলাদেশের বিরোধীনেত্রী বলেছেন, নিজেদের দেশের মাটিতে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। অতীতে যা ঘটেছে ভুলে যান, ভবিষ্যতের দিকে তাকান।

যে খালেদা জিয়া সরকারের অভিজ্ঞতা নয়াদিল্লীর কাছে খুব একটা সুখকর ছিল না, আজ তার মুখ থেকেও আশ্বাস পেয়ে ভারত উৎসাহিত।

বিদেশ মন্ত্রকের মতে, বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেশী দেশের শাসক এবং বিরোধী দল একই মনোভাব দেখালে সেটি অবশ্যই ভালো লক্ষণ”।

এ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ স্মরণ করছেন ২০০৬ সালের কথা। জোট সরকারের শেষ দিকে তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। তখনকার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার সেই সফর ছিল বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। তখন এ বিষয়ে এতটা বিশ্লেষণ দেখা যায়নি। কারণ বিশ্লেষক কিংবা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এ কথা জানেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের বন্ধন অকৃত্রিম, স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক।

তবু খালেদার সহযোগী শক্তি হান্নান শাহ গং অবলীলায় বলে যাচ্ছেন, ভারতের কাছে নাকে খত  দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন।   হান্নান শাহর এ ব্যঙ্গ ব্যুমেরাং হয়ে আজ বিএনপির গায়েই পড়ছে। ঝিনাইদহের জনগণের সামনে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তো সবাইকেই ভারতের কাছে নাকে খত দিয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়- একে অন্যকে দোষ দিয়ে আমাদের কান ভারি করা কেন? একথা তাদের জানা হয়ে গেছে, এ সফরে বাংলাদেশের বা জনগণের  কোন প্রাপ্তি নেই।

বেগম জিয়ার ভারত সফর ইতিবাচকভাবে দেখতে  হলে প্রশ্ন আসে তিনি যুদ্ধাপরাধী আর জঙ্গিদের সঙ্গ ছাড়বেন কি না। সঙ্গ না ছাড়লে অন্ধকারের কালো শক্তি এই যুদ্ধাপরাধী আর জঙ্গি সংগঠকরা কি ভোল পাল্টাবে?

কথায় বলে স্বভাব যায় না ম’লে! খালেদার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রতি মুহূর্তের বাস্তবতা দেখলে এ প্রশ্ন করাই এখন বাতুলতা। খালেদার নেতৃত্বাধীন জামায়াত-বিএনপির ভারতবিরোধিতা কি  কেবল বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতার রাজনীতি? এ রাজনীতি আর কেউ চায় না।

সবার প্রার্থনা, খালেদার ভারত সফরের মাধ্যমে রাজনৈতিক হঠকারিতা দূরে যাক, শুভ রাজনীতির সূচনা হোক্। একাত্তরের খুনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার এ দেশের জনগণ প্রমাণ করেছে তারা অতীত ভুলতে পারে না। কারণ ‘এ মাটি আমার মায়ের শ্মশান, এ দেশ আমার পিতার কবর’। আর কোন অন্ধকারের শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না এই জনগণ। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের কাঙ্খিত শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে চায় বাংলাদেশের আপামর জনতা।

[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১২
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।