ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফটোসাংবাদিকরা না থাকলে মামলার প্রধান আসামি হতেন মীর্জা ফখরুল

মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১২
ফটোসাংবাদিকরা না থাকলে মামলার প্রধান আসামি হতেন মীর্জা ফখরুল

১০ ডিসেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন।

মানবাধিকার কমিশন থেকে শুরু করে ছোটখাট অনেকেই আলোচনা সভা-র্যালি করেছে। মানবাধিকারের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছেন অনেকেই। কিন্তু ১০ ডিসেম্বরই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বিশ্বজিতের লোমহর্ষক হত্যা কাহিনী। যা ছিল মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতার, এক অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তাক্ত উপহার।

এর আগেরদিন অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর ছিল বিরোধী জোটের আহ্বানে রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি। অবরোধের সমর্থনে ঢাকা জজ কোর্টের জাতীয়তাবাদী আইনজীবীরা মিছিল বের করে। আইনজীবীদের মিছিলে প্রকাশ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রলীগের পান্ডারা হামলা করে। দেশবাসী টেলিভিশন ফুটেজে দেখেছে কিভাবে আওয়ামীলীগের পান্ডারা নারী আইনজীবীদের জাপটে ধরেছে, চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে, দেশবাসী আরো দেখেছে ‘গণতন্ত্র রক্ষাকারী দেশপ্রেমিক’ ছাত্রলীগ কিভাবে আইনজীবীদের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে।

ছাত্রলীগের এই তাণ্ডব থেকে আইনজীবীদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসে ছাত্রদলের একটি মিছিল। সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয় কয়েকটি ককটেল। শুরু হয় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া। আশেপাশের সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে থাকে। আশ্রয়ের সন্ধানে ধাবমান তেমনি এক হতভাগ্য সাধারণ পথচারীর নাম বিশ্বজিৎ দাস। যিনি সকালে ভাইয়ের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন শাখারী বাজারে নিজেদের দর্জি দোকান আমন্ত্রণ টেইলার্সের উদ্দেশে। বিশ্বজিৎ তার বড় ভাই উত্তম দাসের সঙ্গে ওই দোকানে গত ছয় বছর যাবৎ কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে আসছিলেন।

আমজনতা কিংবা পক্ষ-বিপক্ষের সবাই নিরাপদ আশ্রয় পেলেও ভাগ্য বিড়ম্বিত হন বিশ্বজিৎ দাস। রক্ত পিপাসু হায়নার মত ছাত্রলীগের ক্যাডারদের চোখ পরে বিশ্বজিতের ওপর। তিনি ধাওয়া খেয়ে বাঁচার জন্য পাশের একটি মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত ডেন্টাল ক্লিনিকে আশ্রয় নেয়।

উন্মত্ত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে টেনে হিচরে নিরাপদ বের করে এনে চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে আর লোহার রড দিয়ে পেটাতেও থাকে। সাথে চলে জামাত শিবির-রাজাকার বলে গালাগাল। নিরীহ বিশ্বজিৎ বাঁচার জন্য অনেক কাকুতি-মিনতি করে রেহাই না পেয়ে তার শেষ অস্ত্রটি ব্যবহার করেও ব্যর্থ হয়। যখন সে বুঝতে পারে তার মার খাওয়ার কারণ হচ্ছে দেশপ্রেমিক (?) ছাত্রলীগ তাকে শিবির সমর্থক মনে করে মারছে তখন বিশ্বজিৎ চিৎকার করে বলে ওঠেন-- “ভাই আমি শিবির নই, আমি হিন্দু! ছাত্রলীরে রক্ত পিপাসু ওই ক্যাডাররা না জানলেও বিশ্বজিৎ জানতেন হিন্দুরা শিবির করে না। তাই তিনি বারবার “আমি হিন্দু, আমি হিন্দু, আমি শিবির না” বলে বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করেন। বিশ্বজিৎ যখন বাঁচার চেষ্টা করছিল তখন ১০ গজের মধ্যে প্রায় ২৫ জন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের তাণ্ডব দেখছিল। ‘জনগণের বন্ধু’ পুলিশ বাহিনী বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে কিংবা ছাত্রলীগকে নিরস্ত্র করতে এগিয়ে আসেনি। তাদের নির্লিপ্ততায় মনে হয় তারা ভেবেছে ‘দেশের মালিকরা যা কিছু করছে করুক, তাতে গোলামদের বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোটা বেয়াদবী হবে’।

যদি তাই না হয় তবে এতগুলো পুলিশের সামনে দিনে দুপুরে একজন মানুষকে কিভাবে কুপিয়ে হত্যা করা সম্ভব? পুলিশ মনিবের এতই অনুগত যে রক্তাক্ত বিশ্বজিৎ রাস্তায় অসাড় হয়ে পরে থাকলেও তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়নি। তার কপালে হাসপাতালের দেখা মেলে হৃদয়বান এক ‘বেয়াদব’ রিক্সা চালকের কল্যাণে। বেয়াদব লিখলাম এ কারণে যে, পুলিশ বিশ্বজিৎকে উদ্ধার কিংবা হাসপাতালে নেয়ার সাহস না করলেও রিক্সাওয়ালা যে সাহস দেখিয়েছে তা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কাছে বেয়াদবিরই শামিল।

বিশ্বজিৎ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে এক ঘণ্টার অসম লড়াই শেষে পরপারে চলে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু বিশ্বজিতের মৃত্যু ও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ, সরকারের নির্লজ্জতা, পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইঁদুর-বিড়াল খেলা, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বিবৃতি-- সবই একের পর এক আঘাত করেছে, মানবিক হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে যারা আমরা এখনো বেঁচে আছি ‘স্বৈরাচারী’ এক রাষ্ট্রে।

ছাত্রলীগের খুনিরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে ক্যাম্পাসে ফিরে যোগ দিয়েছে তাদের সভাপতির জন্মদিন উৎসবে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে স্বয়ং সভাপতি খুনিদের নিজ হাতে কেক খাইয়ে দিচ্ছে। তারপরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম দাঁত কেলিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বারবার বলেন, হত্যাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী নয়। কিন্তু সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের বেরসিক সাংবাদিকতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ অন্ধকার করে দিয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পরে মিডিয়া যে ভূমিকা রেখেছে তাতে এদেশের মানুষ এত কিছুর পরেও স্বাধীন দেশের নাগরিক বলে সান্ত্বনা পেতে পারে। জয়তু মিডিয়া।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে আসামিদের গ্রেফতারের নির্দেশের পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর বললেন, ১১জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঐ দিনই পুলিশ বলেছে, তারা বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় কাউকে গ্রেফতার করেনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের করবেন বলে দাবি করলেও পরে আর কিছু জানাতে পারেননি। অনেকেরই ধারণা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের রক্ষা করতে চাচ্ছেন। কারণ, বিরোধী জোটকে দমন করার জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে তিনি নিজেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাই তাদের রক্ষার দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায় বৈ কি?

বিরোধীদলও বিশ্বজিৎ হত্যার প্রতিবাদে তেমন কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। বিরোধী জোটের আশায় থাকলে আর ৫টি হত্যাকাণ্ডের মত এই মামলাটিও হারিয়ে যেত। কিন্তু মিডিয়ায় খুনিদের সচিত্র প্রতিবেদন, প্রত্যেকের পরিচয়, কর্মকাণ্ড ব্যাপক প্রচারের কারণে এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কারণে গত ১৫ই ডিসেম্বর আসামি শাকিল, সাইফুল, শাওন ও নাহিদকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
 
প্রকৃত আসা‍মিরা ধীরে ধীরে গ্রেফতার শুরু হলেও তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদদাতারা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, খুনিরা কেউ ছাত্রলীগের নয়। প্রসঙ্গত, খুনি ও যার যার পরিবার তাদের ছাত্রলীগ কর্মী দাবি করে। কিন্তু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্বজিৎকে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা হত্যা করেছে। সাবাস! এই না হলে রাজনীতি?
 
বিশ্বজিৎ তোমার বিদেহী আত্মার কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ, তোমার মৃতদেহ অজ্ঞাত হিসাবে কোনো ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার হয়নি। তোমার মৃত্যু হয়েছে শত শত মানুষের সামনে। অর্ধ শতাধিক সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিকের সামনে তোমার মৃত্যু হয়েছে। তারপরেও তোমার খুনিদের সনাক্ত করতে এত ধূম্রজাল কেন? যদি সেদিন ঘটনাস্থলে কোনো ফটোসাংবাদিক বা ক্যামেরা ক্রু অথবা রিপোর্টার না থাকতো তবে তো এই মামলার প্রধান আসামি হতেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সম্ভবত আরো আসামী হতেন সাদেক হোসেন খোকা, মীর্জা আব্বাসসহ বিএনপি’র অপরাপর নেতা-কর্মীরা।

বিশ্বজিৎ তুরণ বয়সেই তুমি ঘাতকের আঘাতে ঝড়ে গেলেও সান্ত্বনা পেতে পার এই ভেবে যে, এদেশে কত মানুষইতো খুন হয়, কিন্ত সাংবাদিকদের লাগাতার চেষ্টায় তোমার খুনিরা চিহ্নিত হয়েছে। তুমি এখন বাংলাদেশের নায়ক। সরকার ও সরকারি দল ছাড়া সবাই এখন তোমার পক্ষে। তোমার ঘাতকদের রক্ষা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের বিবৃতি, ছাত্রলীগ নেতাদের খড়ের গাদায় মুখ লুকানো-- সবই তোমার জন্য।

কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের হাত-পা বাঁধা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে-- তারা শুধু তোমার জন্য আক্ষেপই করতে পারি। কিছুই করা হলো না তোমার জন্য। তাই বিশ্বজিৎ, ক্ষমা করো আমাদের। তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়!

মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ: আহ্বায়ক নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদল [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২
একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।