ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মুক্তচিন্তার পক্ষে একটা আলোচনা

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৩
মুক্তচিন্তার পক্ষে একটা আলোচনা

‘‘Absolute freedom can lead to absolutism. Hitler used freedom of speech to end freedom of speech and the democratic process to end democracy. The fascist parties of Europe today have the same strategy’’.
-Sivanandan (political activist and writer, and founding editor of Race & Class)

একটা সময়ে প্রচলিত ছিল, ‘অসির চেয়ে মসির শক্তি অনেক বেশী’। এখনো মানুষ বলে।

তবে বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ। সহিংসতা বাঁধাতে এবং সৃষ্টি করতে এ যুগে অসি মসি কারো তুলনায় কেউ পিছিয়ে নেই। যদিও বর্তমানে মসি অনেকটাই কম্পিউটারের কী-বোর্ডে ঢুকে পড়েছে। সামাজিক শব্দগুচ্ছের কিংবা সামাজিক আচরণের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো সাদা-কালো সীমারেখা নেই (one word may have different connotations)। দ্বন্দ্বের উৎপত্তিটা এখানেই। কেউ এটার সুযোগ নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুক্তচিন্তার অপব্যবহার করে। কেউ করে না বুঝে। শুধু বাঙলাদেশেই নয়, মুক্তচিন্তা এবং হেট স্পিচ নিয়ে সারা বিশ্বে পক্ষে বিপক্ষে তুমুল হট্টগোল চলছে। মুক্তচিন্তায় বাঁধা দেয়া যেমন কারো মানবাধিকারে হস্তক্ষেপ, ঠিক তেমনি এটাকে আড়াল করে কারো প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করাও জঘন্য মানসিকতা। কোনটা মুক্তচিন্তা আর কোনটা হেট স্পিচ সেটা নির্ধারণেই সবচেয়ে বেশি জটিলতা। মূলত: এটা নির্ধারিত হয় কোথায় কোন পক্ষের অবস্থান মজবুত তার ভিত্তিতে।

বাংলাদেশেও ফেইসবুক এবং ব্লগ নিয়ে কতো কীর্তিকলাপই হয়ে গেল এবং এখনো হয়ে চলেছে। কারো কারো জেল হয়েছে, কেউ কেউ ভিটেমাটি ছাড়া, বৌদ্ধ মন্দির জ্বালানো হয়েছে, আরো কতো কি! সম্প্রতি জনৈক ব্লগারকে ছুরিকাহত করে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত হয়ে গেল। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, আমাদের মুক্তচিন্তার চর্চাটা কেমন হওয়া উচিত?

ধরুন, তাসলিমা নাসরীন কিছুদিন আগে বাংলাদেশিদের নিয়ে যে আপত্তিকর মন্তব্যটি করেছিলেন, তাতে আমরা সবাই আহত হয়েছি। ওভাবে ঢালাও মন্তব্য করার অধিকার কি তিনি রাখেন? এটাকে কি মুক্তচিন্তার সমার্থক বলা যাবে? মুক্তচিন্তার চরিত্রটাই বা কেমন? মুক্তচিন্তা কি সুস্থচিন্তা কিংবা গঠনমূলক যৌক্তিক আচরণের সমার্থক, নাকি সুস্থ্-অসুস্থ-ঘৃণা প্রকাশকারী উগ্র মত প্রকাশও এর অন্তর্গত? মুক্তমতের নাম করে ব্লগ, ফেইসবুক কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে যে কেউ যদি ‘স্বাধীন বঙ্গভূমির’ মতো দেশভাঙ্গার কোনো প্রচারণা চালায় সেটাও কি তার অধিকার? আবার কারো কলমের খোঁচায় কেউ আহত হয়েছে বিধায় প্রকাশ্য রাস্তায় তাকে ছুরি মেরে বসা সেটাই বা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া?  এই বিষয়গুলো আসলে দেখার দায়িত্বই বা কার? কাউকে শারীরিক আক্রমণ করা যেমন অপরাধ, ঠিক তেমনি চিন্তার অপরিশীলিত ব্যবহারের দ্বারা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করাটাও কি সমর্থনযোগ্য?

‘উগ্রবাদ’ প্রত্যয়টি শুধু ধর্ম কিংবা জাতিবিদ্বেষের সংগে জড়িত নয়। যে কোনো বিশ্বাসীদের উগ্র আচরণও একই পর্যায়ের। সাঈদী তার ওয়াজে কারো বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কিন্তু সে এমন উস্কানিমূলক কথা বলে যাতে তার সমর্থকরা আক্রমণে উৎসাহিত হতে পারে। এটা কি সাঈদীর মুক্তচিন্তার অধিকার? ঠিক একজন নাস্তিক সে তার ইচ্ছেমতো কোন ধর্মে বিশ্বাস না-ও করতে পারে। ইচ্ছে হলে নাস্তিকতার প্রতি জন সমর্থন সৃষ্টি করুক। কিন্তু ধর্মান্ধদের মতো অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করে কেন? যে উন্মাদনা আমরা ধর্মান্ধদের মাঝে দেখতে পাই এবং যারা ধর্মবিদ্বেষী প্রচারণা চালায় দু’য়ের ব্যতিক্রম কোথায়? উভয়েই যুক্তি প্রকাশে উগ্র ও উদ্ধত। উভয়েরই শব্দচয়ন হিংসা এবং অশ্লীলতায় পূর্ণ। উভয়েই তার নিজের সীমানা অতিক্রম করে। কাজেই, সাঈদীর বাণী যেমন মুক্তচিন্তার সমার্থক নয়, ধর্মকে কটাক্ষ করে প্রচারণাও ঠিক তদ্রুপ। মুক্তমতের সীমানা না থাকলে অনেক কিছুই মেনে নিতে হবে। যে কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্যকেও প্রশ্রয় দিতে হবে। রেসিজমকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে এবং আরো অনেক কিছু।  

যেদেশে এই মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে, সেখানেও আইনের মাধ্যমে তারা একটা গাইড লাইন মেনে চলে। অর্থাৎ মুক্তচিন্তা মানে যা কিছু তাই নয়। এরও একটা সীমারেখা থাকবে। বলতে পারেন, তাহলে ইসলামকে আক্রমণ করে কিছু বলা হলে তারা পার পেয়ে যায় কিভাবে? এখানেই মুক্তচিন্তার শুভংকরের ফাঁকি। পশ্চিমারা মানা না মানাটা তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে নিজেদের আদলে সাজিয়ে নিয়েছে। যেখানে ধর্মটা কোনো মূখ্য বিষয় নয়, বিশেষত ইসলাম। অন্যকে আঘাত করে তারা ‘মুক্তচিন্তার’ দোহাই দিয়ে পার পেতে চায়। কিন্তু নিজেরা আহত হলে ‘হেট স্পিচের’ কথা বলে তাকে আইনের আওতায় আনে। পশ্চিমারা একটা সময়ে অস্ত্রের শক্তি দিয়ে আমাদের ভূমি দখল করত। এখন তারা শব্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারের দ্বারা আমাদের মনোজগতকে দখল করে রেখেছে।

পশ্চিমা সমাজ সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছেন যে, সেখানে ধীরে ধীরে নাস্তিকতার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ছে। ধর্ম তাদের কাছে মূখ্য নয়। বিপরীতে যেটা তাদের জীবন এবং সমাজে প্রভাব ফেলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ঠিকই ব্যবস্থা রেখেছে। যেমন তাদের বহু সংস্কৃতির ধারণাকে টিকিয়ে রাখতে রেসিজমের বিষয়ে কঠোর আইন আছে। ভারতের এক ক্রিকেটারের সেই বর্ণবাদী বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ার কথা মনে আছে? আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে যারা মুক্তচিন্তাকে সামনে এনে উগ্রভাবে ধর্মকে আঘাত করছেন, তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিকভাবে বামপন্থী। অথচ পৃথিবীর যতো দেশে বাম রাজত্ব কায়েম হয়েছে তার কোথাও মুক্তচিন্তার কোন বালাই নেই। বরং এটাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিবেচনা করা হয় ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে। বেশ কিছুকাল আগে চীনের তিয়েনআনমেন চত্ত্বরের হত্যাকাণ্ডের কথা নিশ্চয়ই অনেকেই ভোলেন নি!

স্বাধীন মত প্রকাশ মানুষের একটা অধিকার। সবারই তাতে সমর্থন এবং শ্রদ্ধা থাকতে হবে। মুক্তচিন্তাকে “অধিকার ফ্রেম ওয়ার্কের” মধ্যে এনে বিচার করলে অধিকারের পাশাপাশি ‘অধিকার ভোক্তার’ (Right holder) দায়িত্ব এবং কর্তব্যও (রেসপনসিবিলিটি) চলে আসে। এভাবেই মুক্তচিন্তার একটা সীমারেখা টানা হয়েছে।

আজকের আলোচনার অর্থ এটা নয় যে, আমি মুক্তচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি। বরং আমি মুক্তচিন্তাকে আরো বেশি প্রগতিশীল করার পক্ষে বলছি। যার প্রয়োগ হবে ভাল কিছু সৃষ্টির জন্য। অন্যর মতামতকে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে। কোনো বিষয়ে চরমপন্থা অবলম্বন উগ্রবাদের জন্ম দেয়। রান্নায় লবণ প্রয়োজন। কিন্তু লবণের অতিরিক্ত ব্যবহার খাদ্যকে অখাদ্য করে তোলে।

একটা ঘটনা বলি। একবার ‘শিশুদের জন্য হ্যা বলুন’ প্রচারণা বেশ জোর কদমে চলছিল। একটা কৌতুক তখন বাজারে চালু ছিল। শিশুরা যদি বড় কাউকে চড় মারতে চায় সেটাতেও কি ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে? আসলে কোনো বক্তব্যকেই পরম বলে গণ্য না করে এর মর্মকথাটা বোঝা দরকার।
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।