ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কথা বলো জাবি

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৩
কথা বলো জাবি

মনে পড়ে ৯১ সালের সেই দিনটির কথা। ক্যাম্পাসে ছাত্র হিসেবে প্রথম পদার্পণ।

নতুন হল। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নামে। ক্লাশ শুরুর আগের দিনে হলে উঠলাম। ছিমছাম পরিবেশ। লেকে পাখির কাকলি। শাপলা ফুটে আছে। চারিদিকে সবুজের বন্যা। হলের কাজ তখনো চলছে। কেবলমাত্র একটা ব্লকের অর্ধেকটা শেষ করেই ছাত্র উঠিয়েছে। নতুন হলে অল্প ক’জন আমরা। সবাই নতুন। অপরিচিত। বড় একা একা লাগছিল। একটু ভয় ভয় মন নিয়ে বিকেলে বের হলাম। হলের পুকুরের অপর পারটাতে চায়ের দোকান। বটতলা হিসেবে সুপরিচিত। বিকেলের নাস্তা এবং চা খেতে গেলাম। গমগম করছে নতুন আর পুরাতনের ভিড়ে। তখন ওখানে একটামাত্র দোকান ছিল। অপরিচিত এক বড় ভাই এগিয়ে এসে নাম জিজ্ঞেস করলেন। অনেকক্ষণ আলাপ হলো অনেকের সংগে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু ভয়টা কেটে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম চায়ের দামটা আর দিতে হয় নি। না, এটা কোনো ইনভেস্টমেন্ট নয়। কারণ তারা কোন ছাত্র রাজনীতির সংগে জড়িত ছিলেন না।

পরের দিন ক্লাশ সেরে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রদের সঙ্গে সে কি জম্পেস আড্ডা, ক্যাফেটেরিয়াতে। সময় গড়ালে আমরাও বড় ভাই হয়েছিলাম। নতুনরাও এসেছিল। একইভাবে তাদের সংগে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম মাপতে হয়নি। রাজনৈতিক হানাহানি যে ছিল না তা নয়। তবে সেটা রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটুকু বাদ দিলে বাকি পরিবেশ ছিল ঈর্ষণীয় রকম ভালো। জাবি আমাদের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, এটা অনেকেরই কাছে বন্ধুত্বের ঠিকানাও। আপন ঘর। আজ যুগেরও অধিককাল কেটে গেছে। তারপরেও দেশ থেকে বহুদূরে থেকেও ফেসবুকের কল্যাণে যখন শুনি বন্ধুরা দল বেঁধে বউ বাচ্চা নিয়ে জাবিতে বেড়াতে গেছে, বড্ড অনুভব করি লাল ইটের মায়াবী বন্ধনকে। এ যেন ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়া। এখনো কোনো ছোট ভাইকে বকা দিতে পারি নির্দ্বিধায়। মনেই হয় না সে তো অনেককাল আগের কথা। কিংবা বড় ভাইয়েরা স্নেহমাখা ভৎর্সনা শুনতে একটুও মন্দ লাগে না। বয়স বাড়ছে। কিছু কিছু সাদা চুলকে রঙ মেখে লুকানোর অব্যাহত চেষ্টাও আছে। তারপরেও যখন জাবির কাউকে দেখি, মনে হয় এই তো সেদিন! বটতলা, ডেইরি ফার্ম কিংবা প্রান্তিকে ছুটে চলা সেই দুরন্ত তরুণ আমি!  

এভাবে অতি সন্তর্পণে জীবনের সাথে কখন যে জাবি জড়িয়ে গেছে আমার মতো অনেকেরই সেটা অজানা। এতোটা দূরে থেকেও জাবির কোনো ভাল সংবাদে তাই আহ্লাদিত না হয়ে পারি না। ঠিক তেমনিভাবে কোনো খারাপ খবরে মনক্ষুণ্ন হই।

কিছুদিন ধরে একটা খবর মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। গত ক’দিন ধরে একটা পেজ এবং বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ একটার পর একটা রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে জাবির র্যাগিং এর ওপর। এই খবর অবধারিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক ইমেজকে ক্ষুন্ন করবে। অনেকের সংগে আলাপ করে জেনেছি ঘটনার অন্তরালের কথা। আবার বাংলানিউজের মতো একটা দায়িত্বশীল পত্রিকার খবরও কিভাবে অস্বীকার করি। হয়তো কিছুটা ঘটেছে যেটা ছিল কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু সেটা কতোটুকু? ব্লেডকে তো দা কিংবা ছুরি বলা যাবে না।

একটু পিছন ফিরে তাকান
অপরাধ প্রবণতা মানব ইতিহাসের মতোই আদি এবং পুরাতন। জাবিকে আমি ব্যতিক্রম বলব না। সেখানেও নানাবিধ অপরাধ হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু ব্যতিক্রম যেটা সেটা এর প্রতিবাদী চরিত্র। কোনো অপরাধকেই এরা বিনা বাধায় ছেড়ে দেয় না। ছাত্রদলের কবীর ভাইয়ের মৃত্যুর পরে শত বিরোধ এবং শত্রুতার পরেও দেখেছি জাবির সকল ছাত্র সংগঠনকে এক হয়ে শিবির ঠেকাতে। কাল দুপুরে যারা মারামারি করেছিল, শিবির প্রতিরোধে আজ সকালে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে। ভীতু হিসেবে পরিচিত কোনো ছেলে কিংবা মেয়েকে দেখেছি শিবিরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অকুতোভয় বীরের ভূমিকায়। রাজনীতি নিয়ে যাদের কোনোকালে কোনো ভাবনাই ছিল না।

পাশাপাশি শিবিরবিরোধী আন্দোলন কিংবা লড়াইয়ে সব সময়ই মেয়েরা ছিল নেতৃত্বে। তাই ওদের সমস্ত আক্রোশ স্বাভাবিকভাবেই মেয়েদের বিরুদ্ধে একটু বেশি। ক্যাম্পাসে ঘাঁটি গাড়তে না পেরে বারবার শিবিরচক্র জাবি এবং বিশেষত‍ঃ মেয়েদের চরিত্র হননে মেতেছে। সারাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার মেয়েরা যখন সামাজিক লজ্জার ভয়ে ঘটনা লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, ঠিক তখন জাবির রোকেয়া, প্রীতিলতারা প্রতিবাদের আগুন জ্বেলেছে ক্যাম্পাসে ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। ঘটনা চাপা দিয়ে অপরাধীদের আরেকটি অপরাধ সংগঠনের সুযোগ দেয়নি। দুঃখজনক কথা হলো, মেয়েদের এই ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা না করে তথাকথিত কিছু ভদ্রলোক লুকিয়ে থাকা ছদ্মবেশী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সুরে সুর মিলিয়ে মেয়েদের চরিত্র হননে নেমেছিল।

ঘৃণা সেই ভদ্রবেশীদের প্রতি। জাবির মেয়েরা অতীতে যে কীর্তি দেখিয়েছে কিংবা জাবির সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা শিবিরের ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছে, বাঙলাদেশের আর ক’টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই দৃষ্টান্ত আছে? এই মেয়েরাই তৎকালীন সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা এনামুল হক শামীমের নিকটাত্মীয়, জাবির ছাত্রলীগের সে সময়কার বড়নেতা মানিকের ধর্ষনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল। যখন শুনলাম আন্দোলনের পুরোধা সেই মেয়েরাও ঘৃণ্য র্যাগিং এর সংগে জড়িত তখন বেশ কষ্টই পেয়েছি। যে মেয়েরা একটা সময়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তারাই আজ নিপীড়ক?

ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে তো কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি।

এক. র্যাগিং-এর সংগে মূলত: কারা জড়িত? সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নাকি এর পিছনে কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ আছে?

দুই. কোনো শক্তির সমর্থন ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা ঘটনো সম্ভব হলেও ধারাবাহিকভাবে কি সেটা সম্ভব?
তিন. যদি সম্ভব হয়েও থাকে তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর সেখানে কি ভূমিকা ছিল? তাদের নিশ্চুপ থাকার কারণ কি?
একটা বিষয় বেশ লক্ষ্যণীয়। অভিযোগগুলোর বেশীরভাগই এসেছে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। এবং এরা কোনো না কোন পূর্ব পরিচিত কিংবা আত্মীয়ের রুমে উঠেছিল। কোনো শক্তির সমর্থন ছাড়া একজন সাধারণ ছাত্র বা ছাত্রীর অতিথি হয়ে আসা কাউকে এ রকম অপমান করা হলে তারা কিভাবে নিশ্চুপ ছিলেন? এই সিদ্ধান্তে আসাই কি যথেষ্ট নয় যে, এই প্রচারণার সংগে কোনো না কোনো সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত? তারা কোনো একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে পুঁজি করে সমগ্র বিশ্ব বিদ্যালয়ের নামে কলঙ্ক রটাচ্ছে?  

বাংলানিউজ অত্যন্ত প্রভাবশালী জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা। আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলানিউজের সংগে লেখালেখির সুবাদে জড়িত। ভাল লাগে এই সংবাদপত্রের সাহসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের অবস্থানকে। বিশেষ করে এর সম্পাদক আলমগীর হোসেনের নিষ্ঠার কথা শুনেছি তার প্রিয়ভাজন আবিদ রহমান ভাইয়ের কাছে বহুবার। সেই বাংলানিউজে যদি ধারাবাহিকভাবে খবর আসে, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগের ব্যাপার। একটা অনুরোধ থাকবে, কষ্ট করে হলেও একটু ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখবেন কি কোনোভাবে আপনারা চতুর জামাত-শিবির চক্রের ফাদেঁ পড়েছেন কিনা!

সেই সাথে জাবির সকল প্রাক্তন এবং বর্তমান ছাত্রছাত্রীকে কি একটা অনুরোধ করতে পারি ঘটনার সত্যতা জানার জন্য? এটা কোনো পক্ষের প্রচারণা হলে আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করে সবুজ, লাল ইটের গড়া ক্যাম্পাসের ইতিবাচক ইমেজকে অক্ষুন্ন রাখি। আর যদি কোনোভাবে এটা সত্য হয়ে থাকে, তাহলেও আসুন আমরা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করি। যারা এর সাথে জড়িত তাদেরকে আড়াল করার চেষ্টা না করে সম্মিলিতভাবে রুখে দিই। অপরাধকে লুকিয়ে রাখায় কোনো গৌরব বা কৃতিত্ব নেই। তাকে মোকাবেলা করাই সম্মানের কাজ। আমি এখনো বিশ্বাস করি, যা রটেছে তা মিথ্যে। সত্য উদঘাটন করে আমরা কি সেটা প্রমাণ করতে পারব না?

কথা বলো জাবি। জেগে ওঠো আবার সত্যের পক্ষে। রুখে দাও ষড়যন্ত্র কিংবা অপরাধীকে।
[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১৬৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৩
এমএমকে/ সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।