ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ঢাকঢোলের ইতিবৃত্ত ও শিক্ষামন্ত্রীর এসএসসি হল পরিদর্শন

রাহুল রাহা, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৩
ঢাকঢোলের ইতিবৃত্ত ও শিক্ষামন্ত্রীর এসএসসি হল পরিদর্শন

ঢাকঢোল এদেশেরই বাদ্যযন্ত্র। সেই আদ্যিকাল থেকে রাজামহারাজারা যে কোন কিছু করতে গেলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাতেন।

নতুন ফরমান জারি হতে শুরু করে রাজপৌত্রের জন্মসহ এমন কোন রাজকার্য ছিলোনা যেখানে ঢাকঢোল পেটানো না হতো। সম্রাট হুমায়ুন যখন সাম্রাজ্য হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন তখনও তার সাথে কয়েক ডজন দামামা বাদক ঘুরছেন। উপমহাদেশে ধর্মাচারেও ঢাকঢোলের ব্যাপক প্রভাব। সেগুলোও যে রাজারাজড়াদের উদ্যোগে ধর্মাচারে ঢুৃকেছে, তা বুঝে নিতে খুব একটা কষ্ট হয়না। রাজপুরুষদের ঢক্কানিনাদ প্রীতির বহু প্রমাণ এখনও বিদ্যমান। যারা পুরোনো রাজবাড়ীগুলো ঘুরে দেখতে ভালোবাসেন তারা এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করছেন নিশ্চই।

সম্রাট-রাজা-বাদশার যুগ আর নেই।   কিন্তু ঢাক পেটানোর অভ্যাসটা বাঙালী ত্যাগ করতে পারেনি। তাই এখনো নানা রাষ্ট্রীয় আচারে ব্যান্ড বাজানোর রেওয়াজ চালু আছে। সেনাবাহিনীসহ সকল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে ব্যান্ডদল রাখা একটা বাদশাহী কেতা। তবে কালে কালে সব কিছুরই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়। পাল্কি বা দোলা গিয়ে এসেছে গাড়ী, বইয়ের বদলে এসে গেছে ই-বুক, কুঁয়োর পানির বদলে বোতলবন্দী মিনারেল ওয়াটার-এরকম আরো বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।

তেমনি ঢাকঢোলের নব্যরূপ গণমাধ্যম। দুটোরই উদ্দেশ্য যে অভিন্ন তা বোঝাতে বোধ করি যুক্তি প্রদর্শনের দরকার নেই। তাই একালের রাজা-মন্ত্রী-সান্ত্রীরা ও গুলোই সাথে নিয়ে ঘোরেন।

আমাদের একজন মন্ত্রী আছেন যাকে অনেকেই হিন্দি সিনেমার নায়ক অনিল কাপুরের সাথে তুলনা করেন। অনিল একটা সিনেমায় একদিনের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দেশে সুশাসনের ধুন্ধুমার ধারা বইয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের মন্ত্রীও প্রায় তা-ই করেন। তো ঢাকীর দল তো পিছনে থাকতে পারেনা। তারাও সাথে সাথে ঘোরে। মন্ত্রীর চড় মারা, দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলা, অনায়কোচিত হাঁটা, মুখ খিচানো, তর্জনী তুলে যাতে তাকে শাসন-সবই ঐ ‘ঢাকীর দল’ জাতিকে দেখিয়ে দেয়। আর টেলিভিশন পর্দায় প্যাকেজ নামক বায়বীয় বস্তু উপস্থাপন করে ঢাক বাজানোর পর্বটি সম্পন্ন করে। এই ঢাকঢোল পেটানোর পর্বটি এখন এতই অবিচ্ছেদ্য যে, মন্ত্রী কাল কি করবেন, তার একটা ফিরিস্তি মন্ত্রীর ঢাকী (পিআরও) আগের দিনই দামামা বাদকদের (টেলিভিশন রিপোর্টার) দিয়ে রাখেন। সদলবলে তারা মন্ত্রীকে অনুসরণ করেন। এতে মন্ত্রীর দাম বাড়ে, গণমাধ্যমের ঢাকীদের চাকুরি রক্ষা পায়। একেবারে উইন উইন সিচুয়েশন।

তবে এই চর্চা এতই ব্যাপ্তিলাভ করেছে যে, মাঝে মাঝে মন্ত্রীরাও ভুলে যান কোথায় ঢাক নিয়ে যেতে হবে, ঢাকীরাও ভুলে যায় কোথায় ঢাক বাজাতে হবে। যেমন ধরুন, এসএসসি পরীক্ষার হলের কথা। শিক্ষামন্ত্রী চলেছেন হল পরিদর্শনে। তার সাথে তার দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা, নিরাপত্তাকর্মী আর ডজন চারেক গণমাধ্যমকর্মী। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। মন্ত্রী দেখছেন কচিকচি শিক্ষার্থীরা মাথা নীচু করে লিখছে। আর ঢাকী বাহিনী তার ছবি তুলছে।

ঢাকীদের সংখ্যা এতই বেশী যে, হলে একটু আধটু ধাক্কাধাক্কি, ছবি তোলার প্রতিযোগিতা থাকবেই। সকাল দশটা থেকে ১২ পর্যন্ত মন্ত্রী একাধিক স্কুল পরিদর্শন করলেন। এক এক হলে বিশ-পচিশ মিনিট কাটালেন আর ঢাকীরা সাথে সাথে দমদমাদম মাদল বাজানোর মত করে ছবি তুললো। তারপর হলের বাইরে এসে বারংবার একই ইন্টারভিউ দিতে হলো মন্ত্রীকে। কচি শিক্ষার্থীদের খুবই ইচ্ছে করে বাইরে যে সব কাণ্ডকারখানা ঘটছে তা দেখতে। কিন্তু উপায় নেই। পরীক্ষার হল। তাই উঁকিঝুঁকি দিয়েই লেখায় মন দিতে হয়। তবে একাডেমিক পরীক্ষার বাইরে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ইদানিং ‘মিডিয়া ট্রায়ালে’ও অংশ নিতে হয়। যদি সন্ধ্যার খবরে বদনখানা একবার দেখায়! পরীক্ষায় অংশ নেয়া স্বার্থক। আর মিডিয়া কারবারীদের ভাব আছে। আর ভাবখানা এমন, ব্যাটা তোর কি সৌভাগ্য পরীক্ষায় বসে টিভিতে ছবি দেখানোর সুযোগ পেলি! কিন্তু তিন ঘন্টার মধ্যে কচি পরীক্ষার্থীর পঁচিশ মিনিট যে মনোযোগ নষ্ট করে এলো ঢাক আর ঢাকীর দল, সেদিকে কারো খেয়াল নেই।

এই লেখার আসল উদ্দেশ্য এটাই। মাননীয় মন্ত্রীবর্গ, সরকারি আমলা, বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ যারা প্রায়শঃই টেলিভিশন ক্যামেরা নামক ঢাক এবং রিপোর্টার নামক একদল ঢাকী নিয়ে যেখানে সেখানে যান, একটু সতর্ক হবেন, আপনাদের কীর্তির প্রচারনা করতে গিয়ে যেনো অন্যকারো জীবনের ক্ষতি না হয়।

এক বিখ্যাত সাংবাদিককে দেখেছি, যানজটের নিউজ তৈরি করতে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে নানা জনের ইন্টারভিউ নিয়ে যানপরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়েছেন। তিনি বলতেই পারেন, যানজট কমাতে ফ্লাইওভার তৈরির সময় বেশি যানজট হয়না? তাহলে আমার কোন উত্তর নেই। কিন্তু মানুষের কমন সেন্স বলে একটা বিষয় থাকে। ঢাকঢোল পেটাতে গিয়ে সেটার প্রয়োগ কম হলে একটু কষ্ট লাগে বৈ কি!

পাকিস্তানের জিও টিভির খ্যাতিমান সাংবাদিক হামিদ মীর এসেছিলেন ঢাকায়। তার মুখে শুনেছিলাম, প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারী নাকি প্রায় রাতেই মুন্নাভাই এমবিবিএস ও এই ঘরানার হিন্দী ফিল্ম দ্যাখেন। আর নিজে মুন্নাভাইর মত কিছু একটা করার কথা চিন্তা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কেন মুন্নাভাই হতে চাইবেন, সেটা আমার মাথায় ঢোকেনা। তবে এটা বুঝি ঢাকের

প্রভাব! যোগাযোগ তাত্ত্বিকেরা যাকে বলেন, গণমাধ্যমের প্রভাব। এই প্রভাব নাকি ম্যাজিকের মতো। নেশা ধরিয়ে দেয়। মানুষের চিন্তাশক্তিকেও খর্ব করে। গণমাধ্যমের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরে মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক নাকি দলীয় সরকার। পদ্মাসেতু না নিজের চিন্তা ভুলে যায়। আশির দশকের যোগাযোগ তাত্ত্বিকেরা বলতেন, ‘ভোদকা রাশান আর মিডিয়া আমেরিকান। দুটোই নেশা ধরায়। ’ এত টেলিভিশন, এত পত্রপত্রিকা দেখে তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এসব কি আসলেই গণতন্ত্র চর্চার হাতিয়ার নাকি নতুনতর নেশার উপাদান। মন্ত্রী, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীরাও যদি এর হিতাহিত ও ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন না থাকেন তাহলে, বিপদ হতে বিলম্ব হবে বলে মনে হয়না।

বাংলাদেশ সময় ১০৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৩

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।