ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

যুদ্ধাপরাধীদের জন্যে ঘৃণার মিনার

রেজওয়ান তানিম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৩
যুদ্ধাপরাধীদের জন্যে ঘৃণার মিনার

নতুন সূর্য ওঠার গল্প শুনতে সবসময়ই ভাল লাগে আমার। কিশোর বয়সে মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।

খুব ভীতু ছিলাম তো, একা ঘরে ঘুমুতে পারতাম না। ঘুম পাড়াতে এসে মা প্রায়ই শোনাতেন রূপকথা, কুঁজো বুড়ির গল্প। আমি বলতাম, ওসব থাক মা, তুমি সকালের গল্প বলো। বলো না মা, কেমন করে জেগেছিল শহীদের রক্তে ভেজা বাংলা? কেমন করে পেয়েছি আমরা রক্তের অক্ষরে লেখা লাল সবুজের অস্তিত্ব।

মা শোনাতেন তার চিত্রপটে আঁকা দু চারটা গল্প। তখন মা খুব ছোট ছিলেন। তেমন কিছু মনে করতে পারেন না। শুধু মনে পড়ে জানলাগুলো আটকানো থাকত, বাইরে গুলির শব্দ। মা তার মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পগুলোই আমাকে শোনাতেন। গল্পগুলো খুব সাধারণ। ওর মাঝে ছিল নানুর কাছে এসে হায়েনাদের বানর খোজার গল্প (এই ‘বানর’ আসলে ওদের ধৃত কোনো রমণী, নানাবাড়ির পঞ্চাশ গজ দূরেই ছিল হায়েনাদের ক্যাম্প), ওই পশুগুলোর হাত থেকে শিশুদের চকোলেট নেবার গল্প (এ গল্পটি বলেই মা ডিসক্লেইমার দিতেন, তিনি ও চকোলেট খান নি), আর আরেকটা ছিল হাতবাঁধা এক ছেলের পালাবার সময় পিঠে গুলি খাওয়ার গল্প। ওর বেশিরভাগই তেমন কোনো বড় ঘটনা নয়, যা ঘটেছিল একাত্তরে নতুন একটা দিনের গল্প লেখার, তার তুলনায়। তবু ওগুলোকে মনে হত মহাকাব্যের মতন, যার প্রতিটি শব্দ অসাধারণ ওজস্বিতা নিয়ে আমার কানে ঝংকার তুলত। আমি বার বার শুনতাম ওগুলো। বিশেষ করে ওই গল্পটা, বাঁচার আকুতি নিয়ে গোসলখানার জানলা ভেঙে হাতবাঁধা ছেলেটির ধানক্ষেতে ধরে পলায়ন, অত:পর কিছুদূর যেতেই বর্বরদের গুলি খেয়ে মৃত্যু; পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি কচি মনে বিষাক্ত ক্রোধ জাগত। মনে হত, ওদেরও যদি অমন হাতবাঁধা অবস্থায় শিরদাঁড়া বরাবর গুলি করা হত, তবে বোধহয় ন্যায়বিচার হত।

এই দু তিনটা গল্পে কি কৌতূহল মেটে? আরো গল্পের খোঁজ করি, পত্র পত্রিকায়, টেলিভিশনে, বইপত্রে। আরেকটু বড় হয়ে আর্ন্তজালে। আমার সামনে এখন অনেক অনেক দৃশ্য, অঙ্ক, সর্গ- এই অন্তিম বেদনার মহাকাব্যের। এত রক্ত, এত মানবিক বিপর্যয়ের কথা, এত বেদনা ও ত্যাগের কথা লেখা নেই পৃথিবীর কোনো মহাকাব্যে, জানা নেই পৃথিবীর কোনো জাতির। জীবন ঝরে গেছে ওই নয়টি মাসে একেকটি ঝরা পাতার মত। আর সে গণহত্যায়, মৃত্যুর মহাকাব্য তৈরিতে পাকি পাপাত্মাদের সহায়তা করেছে এদেশের কিছু জারজ! যারা ইসলামের কথা বলে বেঈমানি করেছে মাটির সাথে।

সেই জারজেরা হায়, স্বাধীনতার পঁয়ত্রিশ বছর পূর্তিতে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে শ্বদন্ত বের করে ফুর্তি করে, হিমযন্ত্রের ঠাণ্ডা বাতাস খায় শহীদের রক্তে স্নাত বাংলার মাটিতে। ভাবতে পারি না এখনো, এতো রক্ত ও ক্লেদে, কষ্টের কাফনে মোড়ানো বিদেহী আত্মাদের পূণ্যে গড়া দেশে কি করে এটা সম্ভব? এই কি চেতনা একাত্তরের? এই কি পরিচয় আজকের তরুণ, যুবকের, মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধদের; একদল রাজাকারের হাতে চলে যায় কেন দেশের ক্ষমতা? অনেক বেদনা নিয়ে লিখেছি সেদিন ’ক্ষমা চাই’। এদের জন্য ক্ষমা চাইবার কোনো অধিকার নেই আমাদের, তবুও চেয়েছি শহীদের আত্মার কাছে।

এখন সে কবিতার সাত বছর পূর্তি। আমাদের আশাবাদী মনে একটু জলসিঞ্চন। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর শুরু হল জন্মজারজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সবার উচ্ছ্বাসকে মিইয়ে দিতে এলো ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। বিচারের রায় হলো কসাই কাদেরের। মাত্র তিনশ চুয়াল্লিশটি লাশের হিসেব দেবার জন্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে সরকার পক্ষ। বিজ্ঞ বিচারকের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি কসাইটার তাণ্ডবলীলা, রায় হিসেবে জুটল তাই যাবজ্জীবন। কত মানুষ খুন করলে তবে বিচারে পাওয়া যেত ফাঁসির আদেশ? হয়ত এক হাজার, দু হাজার কিংবা এক লাখ মানুষ!

ঘরের কোনে বসে আমি গাইতে থাকি একবুক হতাশার গান। এমন সময় আর্ন্তজালে প্রতিবাদ করে কিছু তরুণ। কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা চলে যায় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে, কালের সাক্ষী শাহবাগ মোড়ে। রায়ের বিরুদ্ধে তোলে প্রতিবাদ, ফাঁসির দাবি তুলে আঁকে পোস্টার, লেখে স্লোগান। বুকের কোনে জ্বলে ওঠা আগুন তাদের দীপ্ত করে। তারা হয়ে ওঠে একেকজন নব যুগের মুক্তিসেনা।

প্রথমে আট-দশ, বিশ-পঞ্চাশ, শখানেক, শ-দুয়েক_এর পরে হাজার হাজার লক্ষ মানুষ স্রোতের মত নেমে আসে রাস্তায়---সবার গন্তব্য হয়ে ওঠে শাহবাগ। একাত্তরের চেতনায় দুদিনের মাঝেই ভরে ওঠে পুরো প্রজন্ম চত্বর। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, তরুণ, তরুণী সব বয়সের গণমানুষের আজ একই দাবি, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, রাজাকারের বিচার চাই। আমার ঘরকুনো মন, কখনো তোলেনি এইটুকু স্লোগান, কখনো যায় নি কোন মিছিলে, মিটিঙে। কিন্তু প্রজন্ম চত্বর আমাকে টেনে নিয়ে গেল মশাল মিছিলে, শত শত তরুণের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বললাম,

‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই
রাজাকারের ফাঁসি চাই’

এভাবেই মিছিলে, মিটিঙে এগিয়ে চলছে শাহবাগ। প্রাণের টানে লাখো লাখো মানুষের কাঁধে কাঁধ রেখে দাঁড়ানোয় তৈরি হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ঘৃণার মিনার। এ মিনার ছড়িয়ে গেছে আটষট্টি হাজার গ্রামে, এ মিনার ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বের বাঙালিদের মাঝে। এ মিনারে শামিল জনতা আজ বিচার নিয়ে ফিরবে বলে পণ করেছে। বসেছে ফাঁসি আদায়ের মারণযজ্ঞে---জেনে রেখো বাংলাদেশ, গোটা পৃথিবী; ইস্পাত কঠিন এ দৃঢ়তা, রোখার কেউ নেই,  কেউ নেই!!  

রেজওয়ান তানিম:কবি, ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।