ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাকিস্তানি দৈনিক: ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে

পারভেজ হুদভয় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
পাকিস্তানি দৈনিক: ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে

ঢাকা: পারভেজ হুভয় পাকিস্তানের প্রখ্যাত পরমাণু পদার্থবিদ, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী। শনিবার দেশটির শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে তার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যাতে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানান তিনি।

বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য নিবন্ধটির অনুবাদ তুলে দেওয়া হলো-

শাহবাগ স্কয়ার- সেটা আবার কোথায়? আব্দুল কাদের মোল্লাই বা কে?

গতকাল (শনিবার) ইসলামাবাদে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল, যাদের কেউই এদের নাম শোনেনি। অবশ্য তারা তাহরির স্কয়ারের কথা জানে, আফজাল গুরুর ফাঁসির কথা জানে।

তবে ঢাকার শাহবাগ ও সেখানে চলমান আন্দোলন নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই বললেই চলে।

মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এতে সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশের জনগণ, তারা চান কাদের মোল্লার ফাঁসি।

কাদের মোল্লার ব্যাপারে কোনোরকম আগ্রহ দেখায়নি পাকিস্তান। গণমাধ্যমগুলো নিরব এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা দু:খজনক, কারণ বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের মতোই কাদের মোল্লাকেও ভুলে যাওয়া হয়েছে। যদিও তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন ও যুদ্ধে পাকবাহিনীকে সাহায্য করেছিলেন।

শাহবাগ নিয়ে পাকিস্তানের অনাগ্রহই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ব্যাপক দূরত্বের কথা জানান দিচ্ছে।

যুদ্ধের পর পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাকি ৪৬ ভাগ নিয়ে পাকিস্তানের ইতিহাস অসম্পূর্ণই থেকে গেছে।

ওই ছাত্রদের কাছেও বাংলাদেশ যেন বিশ্বের অন্যপ্রান্তের কোনো দেশ। কেন?

এর জবাব খুঁজতে আমি পাকিস্তানের স্কুলগুলোর পাঠ্যবই ঘেঁটেছি। ক্লাস ফাইভের সামাজিক শিক্ষা বইতে প্রসঙ্গটি শুরুই করা হয়েছে হিন্দু ও মুসলিমদের ভেদাভেদ দিয়ে। তাদের পাকিস্তানের গোপন শত্রুদের কাছ থেকে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে, ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। পাকিস্তানের আলাদা হওয়া বিষয়ে মাত্র তিনটি বাক্য আছে বইতে, যার মধ্যে শেষটি হচ্ছে, “ভারতের সাহায্যে অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। ”

ক্লাস এইটের পাকিস্তান স্টাডিজ বইয়ে শুধু লেখা আছে, “পূর্ব পাকিস্তানের কিছু নেতা ভারতের সাহায্যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ গঠন করেন। ”

নবম ও দশম শ্রেণীর বইতে এ প্রসঙ্গে তিন পৃষ্ঠার সর্বোচ্চ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেখানকার পয়েন্টগুলো হলো- ইয়াহিয়া খানের একনায়ক সরকার, ব্যবসা-বাণিজ্যে হিন্দুদের প্রভাব, হিন্দু শিক্ষকদের নিন্দনীয় ভূমিকা, ভাষা সমস্যা, ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও ১৯৭০-এর নির্বাচন।

এই আংশিক ও বিকৃত ইতিহাস থেকে পাকিস্তানের তরুণদের ১৯৭১ কে বোঝা সম্ভব নয়।

কিন্তু তাদের দোষ দেবো কীভাবে? আমরা যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তরুণ ছিলাম, তারা খুব ভালোভাবে জানি যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক দেশ ছিল, কিন্তু এক জাতি নয়।

আজকের তরুণরা কল্পনাও করতে পারবে না তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভেতর কতোটা বাঙালি বিদ্বেষ ছিল। আমিও অত্যন্ত লজ্জিতভাবে স্বীকার করছি যে তরুণ বয়সে আমিও আমাদের অন্য প্রদেশের ‘কালো’ ও ‘বেঁটে’ লোকদের প্রতি করুণা অনুভব করতাম। আমাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা কাজ করতো যে আমরাই ‘ভালো’ মুসলিম। আমরা লম্বা, ফর্সা ও চোস্ত উর্দু বলতে পারি। মনে পড়ে, আমার কোনো কোনো বাল্যবন্ধু রেডিও পাকিস্তানে বাংলা খবর শোনার সময় বাংলা ভাষা নিয়ে হাসাহাসি করতো।

পাকিস্তানের ‘পূর্ব প্রদেশ’ হারানোর কারণে অনেকে আজও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি অনেক পাকিস্তানি এখনও বিশ্বাস করেন যে একাত্তরে শুধু পাকিস্তানের শুধু সামরিক পরাজয় হয়েছিল, রাজনৈতিক নয়।

পাকিস্তানের বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর এ কিউ খান এ সপ্তাহেই লিখেছেন, “একাত্তরের আগে আমাদের পারমাণবিক শক্তি থাকলে দেশের অর্ধেক আমাদের হারাতে হতো না, আজকের বাংলাদেশের কাছে শোচনীয় পরাজয়ও হতো না। ”

কিন্তু সত্যিই কি তাতে কাজ হতো?

না, পারমাণবিক বোমা থাকলেও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হতেই হতো। যতোই ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান থাকুক, পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এখানেই।

ভারতকে মধ্যে রেখে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ৯০ হাজার সেনা বহন করা খুবই দু:সাধ্য ছিল। ভারতের আকাশে ওড়ার নিষেধাজ্ঞা থাকায় নৌপথই ছিল একমাত্র মাধ্যম। এই দীর্ঘ যুদ্ধ চলতে থাকলে একেবারে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হতো পাকিস্তান।

আমি এখনও আমাদের পরমাণুবিজ্ঞানীর কথাটি বোঝার চেষ্টা করছি। পারমাণবিক বোমা কি ঢাকার পতন ঘটাতে ব্যবহার করা হতো? নাকি কলকাতা ও দিল্লিকে আটকে রাখতে ব্যবহার করা হতো?

ইতিহাসকে পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। কিন্তু এখন এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলার যে আহবান বাংলাদেশ জানিয়েছে, তা সম্পূর্ণ সঠিক—আমরাই দীর্ঘদিন ধরে এটি অস্বীকার করে এসেছি। এখন সেটা করার সময় এসেছে ও দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ এসেছে। এই সৎ সাহসটুকু আমাদের থাকা উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।