ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশাল অহিংস আন্দোলনে ভীত জামায়াত

ফারজানা খান গোধূলি, প্রবাসী সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
বিশাল অহিংস আন্দোলনে ভীত জামায়াত

ইতিহাস কথা বলে। শহীদ জাফর মুন্সী আর ব্লগার-স্থপতি শহীদ রাজীবের হত্যার ধরণে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার, আল বদর ও আল শামস ও পাকিস্তান সমর্থকদের সুপষ্ট ছাপ পাওয়া যায়।

১৯৭১ থেকে ২০১৩---- মাঝখানে পার হয়ে গেছে ৪২টি বছর। যুগের সাথে বদলে গেছে অনেক কিছু, বসন-ভূষণ, চাল চলন, জীবনযাত্রা, মেশিন-পত্র। এসেছে কমপিউটার, ল্যাপটপ, নোটবুক, আই ফোন, অ্যান্ড্রয়েড ফোন, চালকবিহীন গাড়ি, সেই সাথে এসেছে নতুন নতুন মারণাস্ত্র, জীবাণু অস্ত্র। প্রতিদিন একটাকে পিছনে ফেলে আবিষ্কার হচ্ছে আরেকটি।

লক্ষণীয় যে, এতো কিছুর পরিবর্তন হলেও গত ৪২ বছরে এতটুকুও পরিবর্তন হয় নি ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের ও তাদের দোসরদের মনোভাব। সেই একইভাবে অত্যাচার করে মানুষ খুন। একদল হিংস্র হায়েনার মত দল বেঁধে নিরাপরাধ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা। ধরে-বেঁধে জবাই করা। অমানুষিক অত্যাচার করা। হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া।

একাত্তরে ওরা পাকিস্তানি মিলিটারির সেবা করেছে, দেশকে পরাধীন করে রাখার তাগিদে, নিজের মা-মাটি ও দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসলামের দোহাই দিয়ে মানুষ মেরেছে। ৩০ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, নারী, শিশু, বৃদ্ধ , অসুস্হ, কাউকেই ছাড়ে নি। ঘরে ঢুকে ঢুকে মেরেছে। মা-বোনদের ধর্ষণ করে তুলে দিয়েছে হানাদার পাকিস্তান আর্মির হাতে। দিনের পর দিন বন্দি করে গণধর্ষণ করেছে, এর পর তাদের নিষ্টুরতম উপায়ে বর্বরভাবে হত্যা করেছে। সেই বর্বরতা যখন ইতিহাসের পাতায় পাতায় সাক্ষ্য দিয়ে যায়, স্বচক্ষে দেখা স্বজনহারানো মানুষের মুখে মুখে এখনো সেই গা শিউরে ওঠা কাহিনী। ৪২ বছর পরেও শুনলে কেঁপে ওঠে বুক, হৃদয় চিরে হাহাকার বের হয়। আহারে, ধর্মের নামে মানুষ এতো ভয়ঙ্কর, হিংস্র হয় কিভাবে? সেই হিংস্রতা তুলনা করাও সম্ভব না।

নিকৃষ্ট পশুও কোন নারীর যৌনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে হত্যা করতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাদে পাওয়া এক ছাত্রীর লাশের সুরতহালের এই বিবরণ দিয়েছেন এক সুইপার। মৃত মেয়েটির গায়ে ছিল না কোনো চামড়া, ছিল না মাথায় একটাও চুল, হাতে কোনো নখ, যৌনাঙ্গের ভেতর দিয়ে বুক পর্যন্ত ছিলো লাঠি ঢোকানো। গা শিউরে ওঠা ওই লাশটি, এক সুইপার নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।

এটা শুধু একটিমাত্র ঘটনার বিবরণ, এমন গা শিউরানো বীভৎসতার ঘটেছিলো ঘরে ঘরে। যার নেতৃত্ত্বে ছিলো আজকের জামায়াত এবং তাদের নেতারা। এ এক অমোঘ সত্য অস্বীকার করার পথ নেই। আর অস্বীকার করেও পার পাওয়া যাবে না। মজার ব্যাপার হল, এই যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নিজেদের কুকর্ম ঢাকার জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে জামায়াতে ইসলামী নামে (পাকিস্তান আমলের দলটির নামে নাম রেখে)।

"আমাদের ধর্ম ইসলাম বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অনুমতি দেয় নি। সে যত বড় অপরাধই হয়ে থাক না কেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমাদের ধৈর্য্য ধরতে শিখিয়ে গেছেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে শিখিয়ে গেছেন, মানুষকে ও তার মতকে সম্মান করতে শিখিয়ে গেছেন। আমরা যদি তার অনুসারি হয়ে থাকি তবে হত্যাযজ্ঞ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আইনের শাসন অনুযায়ী কোনো অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণের সাপেক্ষে তার একটি বিচার হবে, সেটা আমাদের দেশের আইনে হোক বা ইসলামী আইনে হোক। এই আইনের শাসনের জন্যেই তো আমরা আজ শাহবাগসহ সারাদেশে আন্দোলন করছি, নতুবা যে ঘৃণ্য অপরাধ রাজাকাররা করেছে তাতে তো কথাবার্তা ছাড়াই হত্যা করা যেতো, এরা কি কখনো ভাবে মহানবীকে (সঃ) নিয়ে অনেক বিদ্রুপ হয়, কিন্তু তিনি তার নিজের জীবদ্দশায় কি করেছেন তা কি আমরা মনে রাখি? তায়েফে যখন তাকে পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছিলো তখন কি করেছিলেন তিনি সেটা কি আমরা মনে করতে পারি? তিনি কি পালটা পাথর ছুড়েছিলেন বা ছুড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন? নাকি দোয়া করেছিলেন নিক্ষেপকারীদের জন্য আল্লাহর কাছে (সংগৃহীত)। "

ইসলাম শান্তির ধর্ম, তাই ইসলামকে ঢাল করে অন্যায়ের দিন শেষ জামায়াতে ইসলামীর। ইসলাম যা বলে তা মানলে শান্তি আসবে, আর জামায়াতে ইসলামী যা বলে বা করে তা মানলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী ছাড়া কিছুই মিলবে না। খোদ জামাতিরাও জানে তারা ইসলাম মানে না। মানলে আজ দেশে তাদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো না।

সন্ত্রাসী জামায়াতের মূল শক্তি হল ছাত্রশিবির। যেটির নাম পাকিস্তান আমলে ছিল  ইসলামী ছাত্রসংঘ। নতুন পাত্রে পুরনো মদ। এরা তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য সবিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছে।

উল্লেখ্য যে, হাত-পায়ের রগ কেটে ও জবাই করে মানুষ খুন করাতে এরা বিশেষ বিশেষজ্ঞ।

রাজাকাররা কি ধরণের হিংস্র, তা বলে কোনো দিন শেষ করা যাবে না। একাত্তরের খুনীরা কক্ষনোই আমাদের দেশকে নিজেদের দেশ মনে করে নি। আজো করে না। আর করে না বিধায় আবারো নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছে। ধর্মরক্ষার নামে ভাংচুর, অগ্নি-সংযোগ ও সন্ত্রাসী তাণ্ডবে দেশকে আবার অচল করে পিছিয়ে নিতে চাই ৪২ বছর। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা ওদের অবদমিত মনের আশা পূরণের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লোভী রাজনীতিবিদ ও দলের ছত্রছায়ায় নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করেছে।

জাতির প্রাণের দাবির জোরে আজ ওরা কাঠগড়ায়। ফাঁসি দাবিতে দেশ উত্তাল। যদিও এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ত্বের হীন স্বার্থের জন্য তা হয়নি। ইতিহাস বলে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা। আজ ৪২ বছর পর সারাদেশ আজ যুদ্ধাপরাধীদের

বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। আবার জেগেছে জনতা, তরুণদের ডাকে আজ লাখো মানুষ পথে, শাহবাগ চত্বরে। একাত্তরের মত আজ নারী শিশু, ছাত্র জনতা, সর্ব স্তরের সাধারণ মানুষ পথে। তারা একাত্তরের ঘাতকদের সঠিক বিচারের দাবিতে সোচ্চার। আইন আদালতে বন্দী এই ভয়ঙ্কর অপরাধীদের বাঁচাতে গত কিছুদিন ধরে শিবির দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, খুন করছে নিরীহ মানুষকে। ইসলামকে হাতিয়ার করে, কুটচালে মানুষের একতায় ফাটল ধরাতে আবার হাতিয়ার করেছে, ইসলামকে। আল্লাহ্‌ ও নবীকে(সাঃ) আবারো ব্লগের মাধ্যমে হেয় করে, জবাই করে মেরে ফেলল রাজীবকে। জাফর মুন্সীর সাহসী প্রতিরোধে ভীত জামায়াত-শিবির তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। ঘাতকরা এইভাবে যুগে যুগে ভয় দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু বেশি দিন সফল হতে পারে নি, পারবে না আজো। কারণ যুব সমাজ জেগেছে।

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে, সালাম, রফিক, জব্বার বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেক যুবকের প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষা অর্জন। ১৯৫২ হাত ধরে ১৯৭১ আমাদের মহান স্বাধীনতা। অকুতোভয় যুবকেরা কোনো বাধা মানে না, আজো মানবে না। ভাবতেও অবাক লাগে কারা আজ জামায়াত করে! কারা আজ শিবির করে! সেই ছোট বেলা থেকে থেকে জামায়াতের মিশন চলে...কচি কচি ফুলের মত শিশুদের ফুলকুড়ি নামের সংগঠনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ব্রেন ওয়াশ করে হিংসার বীজ বুনে দেয়া হয় এদের মনে। করে তোলে দেশদ্রোহী। এদের পিছনে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা থাকে, বিপুল অর্থের মাধ্যমে, চাকরির মাধ্যমে, ব্যবসার মাধ্যমে ওরা ঠাই গেড়ে বসেছে। আর বসে বসে তৈরি করছে মানবাস্ত্র-মানব বোম, নব্য রাজাকার। কি এদের পরিণতি?

ইতিহাস সাক্ষী, তাদেরও পরিণতি হবে তাদের নেতাদের মত। নিক্ষিপ্ত হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তাদের পেছনে যে শক্তিই থাকুক না কেন, কোনো শক্তিই তাদের রেহাই দিতে পারবে না। জনতা যখন জেগে ওঠে-অন্য কোনও শক্তি সেই শক্তির সামনে টিকতে পারে না। আমাদের জনতা আজ এক, আর একতায় শক্তি, শক্তি অবিচলতায়। আর অবিচলতাই আমাদের আন্দোলনকে করে তুলেছে বেগবান।

শাহবাগ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের প্রাণভোমরা। দিনশেষে দেশপ্রেমীরা ছুটে আসছে। একটাই দাবি নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। অহিংস বিশাল এই আন্দোলনে ভীত জামায়াত শুরু করেছে একাত্তরের মত কূট কৌশল। আন্দোলনরত মানুষের মাঝে ফাটল ধরাতে মরিয়া। তারা বিবাদ লাগানো, উপহাস, অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করতে চাইছে জন আন্দোলনকে। ওরা নিজে ইসলামকে হেয় করে দোষ দেবে আন্দোলনকারীদের, ওরা বোমা মারবে, জবাই করবে, ওরা ধর্ষণ করবে, ওরা চোরাগোপ্তা হামলা করবে, ওরা আজ মরিয়া নিজেদের চামড়া বাঁচাতে। দিনে দিনে ওরা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে, তাই প্রতিবাদের সাথে প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাসের মীরজাফররা সবখানে আছে। আর ইতিহাসও বলে এই রাজাকার মীর জাফরদের পরিণতি করুণই হয়, দশের লাঠি যখন এক হয়। জনতার লাঠি আজ এক হয়েছে। নির্ভীক জনতা আজ পথে, তাই জামায়াতের ভয়, এই লাখো নির্ভীক মানুষকে।

দেশের প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি জনতা চায় রাজাকারের ফাঁসি, যে শিশুটিকে মা-বাবা একটু রৌদ্রের আঁচ লাগতে দেয় নি জন্মের পর, সেই শিশুটিকে নিয়ে মা-বাবা এসেছেন শীত, রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে। যে বালকের স্কুল থেকে ফিরে খেলার মাঠে ছোটার কথা, সে খেলা ভুলে বাবার বা মায়ের হাত ধরে হাজির শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। যে বালিকার খেলার কথা এক্কা দোক্কা, সে আজ প্রজন্ম মঞ্চে কচি হাতে মুঠি উঁচিয়ে স্লোগানে গলা মিলিয়ে বলছে ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’। যারা এসি গাড়ি ছাড়া বের হন নি কোথাও, তারাও আজ বসে আছেন শাহবাগ চত্বরে, খেটে খাওয়া মানুষের পাশে বসে সোচ্চার রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশের দাবিতে।

১৯৭১ এর পর আজ আবার সব ধরণের সব বয়সের মানুষকে এক কাতারে এনেছে। এক হয়ে রাজাকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বেগবান করে তুলছেন। দশজন বাড়ির পথে গেলে বিশ জন যোগ দিচ্ছেন। শাহবাগ থামে না, শাহবাগ ঘুমায় না, শাহবাগ জেগে রয় অপেক্ষায়। দিন দিন বেড়ে ওঠা আন্দোলনকে বুকে নিয়ে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর ডাক দেয়, আরেকটি একাত্তরের, নতুন সূর্যের প্রত্যাশায়। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের প্রতীক্ষায়। ইতিহাস নতুন করে লেখার প্রত্যয়ে, ইতিহাস নতুন করে চেনাবে বিশ্ববাসীকে, রাজাকারমুক্ত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশ সময় ১৯২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
এমএমকে/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।