ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শাহবাগ নিয়ে অপপ্রচার ভেসে গেছে জনতার জোয়ারে

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৩
শাহবাগ নিয়ে অপপ্রচার ভেসে গেছে জনতার জোয়ারে

কানাডা থেকে: পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা শাহবাগের আন্দোলন। দীর্ঘ দু’সপ্তাহ ধরে টানা রাতদিন ক্লান্তিহীন, বিরামহীন ভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে।

যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

কোনো জ্বালাও পোড়াও নেই, নেই ভাঙচূ‌র, হত্যা-হানাহানি, অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা।

কখনো সারাদেশে এক সঙ্গে তিন মিনিটের নীরবতা অথবা কখনো এক সঙ্গে মোমবাতি প্রজ্বলন কিংবা এক সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন।

এ যেন অতুলনীয় শান্তি আর সৌহার্দ্যের দৃষ্টান্ত। ৩৪৫টি খুনের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ৫ ফেব্রুয়ারিতে এ জাগরণের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে সারাদেশে তীব্র দ্রোহের রূপ নেয়। তাই অনেকেই শাহবাগের গণজাগরণকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আন্দোলনে স্বতস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিচ্ছেন কোলের শিশু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। এই জাগরণ, এই দ্রোহ এখন আর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এতে যুক্ত হয়েছে মুক্তচিন্তার বহুমাত্রিকতা।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য শাহবাগের গণজাগরণকে নস্যাত করার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। দু’টি মহল মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের লিপ্ত রয়েছে কোনো রাখঢাক ছাড়াই। ইতোমধ্যে খুন করা হয়েছে আন্দোলনের কর্মী রাজীবকে।

তার বিরোদ্ধে বলা হচ্ছে, সে নাস্তিক। সে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্লগে আপত্তিকর লেখা লিখেছে।

তার জানাজা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং কাদের সিদ্দিকী- সূর্যাস্তের পর অজু ছাড়া নাপাক স্থানে তিন তাকবিরে নামাজ ইত্যাদি। আর তার পৃষ্ঠপোষকতা করছে তিনটি দৈনিক আর দু’টি টিভি চ্যানেল।

দৈনিক আমার দেশের প্রকাশক মাহমুদুর রহমান শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের আন্দোলনকারীদের গালি-ই দিয়েছেন। আর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিম যুদ্ধাপরাধীদের আন্দোলনকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করেছেন।

জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান মিথ্যাচার করে বলছেন, “ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নোটিশ ও হুমকি-ধমকি দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরে যাওয়ার নির্দেশে দেওয়া হচ্ছে। ”

তিনি আন্দোলনকারীদের ‘দুশমন’ আখ্যায়িত করে আরও বলছেন, “শাহবাগে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) দুশমনদের সমাবেশ হচ্ছে। এই সমাবেশের সঙ্গে এ দেশের তৌহিদী জনতার কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে অন্যায় অশালীন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। তার প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ তথা তৌহিদী জনতা, ওলামায়ে-কেরাম, পীর মাশায়েখ ও জনগণের ঈমানি দায়িত্ব’’।

এমন কী আসিফের মতো তথাকথিত গায়ক শাহবাগে গণজাগরণের তরুণ যোদ্ধাদের  ‘শাহবাগী ছাগু’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, “শাহবাগ নাটকের শেষ কোথায়?”

সাংবাদিক  মাহফুজউল্লাহ শাহবাগের আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের সাজানো আন্দোলন বলে প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছেন!

দু’টি উগ্রবাদী দৈনিক প্রতিদিনই শাহবাগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত। তারা লিখছে-

ক) শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি: গৃহযুদ্ধের উসকানিমূলক বক্তাদের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার।

খ) লগি বৈঠার খুনি বাপ্পাদিত্য বসু শাহবাগের নেতৃত্বে।

গ) শাহবাগে আন্দোলনের নামে ফেনসিডিল সেবন ও অসভ্যতা চলছে। ঐখানে গাঁজাখোররা গেছে, বেলেল্লাপনা হচ্ছে।

এখন আবার তারা নানা ভাবে ফাঁদ পাতার চেষ্টা চালাচ্ছে।

কয়েকজন তরুণীকে ট্রেনিং দিয়ে কৌশলে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়ার জন্যও কর্মসূচি চালাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে।

গণজাগরণের ছবির সাথে অশালীন ছবি যুক্ত করে তা ইন্টারনেটে ছড়াচ্ছে।

এসব কুকীর্তির জন্য বেশ ক’টি জামায়াতি ওয়েবসাইড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বলেছেন- "গোলাম আজম, নিজামী, কাদের মোল্লা, সাঈদী - এরা শুধু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে নাই, এরা ইসলামের বিকৃতি সাধন করে ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। সুতরাং এদের ফাঁসি ছাড়া দ্বিতীয় কোন দাবি হইতে পারে না, দ্বিতীয় কোন শাস্তি হইতে পারে না। "

আর তাই এই খতিবকে তারা নাস্তিক, মুরতাদ বলে ফতোয়া দিয়েছেন।

থেমে নেই নতুন প্রজন্মের রাজাকাররাও। তারা  ময়মনসিংহে গণজাগরণ মঞ্চের কাছে বোমাবাজি করেছে। শাহবাগেও শিবির নাশকতার পরিকল্পনা করছে।

আর ‘শাহবাগ স্কয়া’র মতো তারা ‘পল্টন স্কয়ার’ বানানোর চেষ্টা করছে। হামলার পরিকল্পনা  করছে শিবির!

শিবির অনলাইনে খালেদা জিয়ার সুরে সুর তুলে বলেছে, “কাদের মোল্লাকে সরকার মিথ্যে মামলা দিয়া গ্রেফতার করে রাখছে। এই জালিম সরকার কাদের মোল্লাকে মিথ্যে মামলা দিয়া যাবজ্জীবন জেল খাটাইতাছে। ”
 
মিথ্যাচার করেছে- এসোসিয়েটেড প্রেসের ঢাকাস্থ সংবাদদাতা।  

এপির ঢাকাস্থ সংবাদদাতা জুলহাস আলম তার সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলিতে রাজাকারদের বিচার এবং শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে নানারকম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশন করছেন।

ফলে সারা বিশ্বের মানুষ রাজাকারদের বিচার এবং শাহবাগ আন্দোলনের আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল তথ্য পাচ্ছেন।

ঢাকার রাস্তায় যখন গণমানুষের জোয়ার, কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে বিক্ষোভ-সমাবেশ হচ্ছে তখন ৬ই ফেব্রুয়ারি জুলহাস আলম তার রিপোর্টে শুধু জামাত-শিবিরের হরতাল নিয়ে লিখেছিলেন। রিপোর্টে খুব চতুরতার সঙ্গে শাহবাগ আন্দোলনের ছবি ব্যবহার করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছিলো- “Protest Hit Bangladesh After War Crimes Verdict”-

তিনি প্রচার করার চেষ্টা করেছেন- যেন মানুষ রাজাকার কসাই কাদের মোল্লাকে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে!

৮ ফেব্রুয়ারি তার আরেকটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে- “Bangladesh Protest Calls for Death for War Crimes”, শিরোনামে।
 
আবার বাংলানিউজের নামে নিজেদের তৈরি নিউজ প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে কোনো কোনো জামায়াতপন্থী সংবাদপত্র।
 
শাহবাগ চত্বরে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে  হাস্যকর কথা বলছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তার কথায় মনে হয়েছে- এই আন্দোলন তার মুক্তির দাবিতেই হচ্ছে। তার ভাষ্য- “জনগণের আন্দোলন শুরু হয়েছে। এর জয় অবশ্যম্ভাবী। ” তিনি বোঝাতে চেয়েছেন- ‘মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের মুক্ত করছে। ’
 
আন্দোলনকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন- “গত কয়েক দিনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকারের মদদে একটি গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা করে যাচ্ছে। ’’

শুধু বিএনপির মওদুদ, ফখরুল, আনোয়ার, রিজভীই নন, দলের নেত্রী খালেদা জিয়া স্বয়ং কাদের মোল্লার মুক্তি দাবি করেছেন।

খালেদা জিয়া বলেছেন, “এই সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাদের মোল্লা, নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে বিচার করছে!”

দেশের মানুষ আর বিশ্বাস করে না জামায়াতি দোসরদের মিথ্যাচার, অপপ্রচার। এসব অপপ্রচার ভেসে গেছে জনতার জোয়ারে।
Saifullah-Mahmud-Dulal
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক কানাডা প্রবাসী, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।