ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একুশে ফেব্রুয়ারি: বাংলাভাষা প্রচলন আইন ও প্রাসঙ্গিক কথা

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৩
একুশে ফেব্রুয়ারি: বাংলাভাষা প্রচলন আইন ও প্রাসঙ্গিক কথা

আমরা সবাই জানি একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী `প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা`।

সংবিধানের এ বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সালের ২ নম্বর আইন) প্রণয়ন করা হয়।

বছর ঘুরে প্রতিবারই আসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি ।

কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশে বিচার বিভাগসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করা এখনো সম্ভব হয়নি।   সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আসলে বাধা কোথায়?

১৯৮৭ সালের আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, `এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। `

সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, `আদালত` অর্থ সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনো আদালত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ এবং উল্লিখিত আইনের অধীন আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সব কার্যক্রম ও রাষ্ট্রীয় নথিপত্র বাংলা ভাষায়ই বাধ্যতামূলকভাবে সম্পাদিত হওয়ার কথা। প্রসঙ্গত, দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ `বাংলা ভাষা প্রচলন আইন` করা হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

শহীদ মিনার শব্দটি শুনলে মফস্বলে বড় হওয়া অনেকেরই খালি পায়ে ফুল হাতে প্রভাত ফেরিতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। সেই সকালে শ্রদ্ধা জানানোর প্রভাতফেরি, শহরের এপথ ওপথ ঘুরে, শেষ হয় কোনও একটি স্কুল বা কলেজের শহীদ মিনারে। গলায় সুর থাকুক বা না থাকুক, বুকে পুষে রাখা শ্রদ্ধায় বিনীত সেই গান, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারিÑ উচ্চারিত হয় সেই প্রভাতফেরির সবার মনে আর গলায়। বছরের বাকি সময় মফস্বলের শহীদ মিনার অবশ্য স্কুল বা কলেজের একটি অংশ হয়েই থাকে ছাত্র ছাত্রীদের চোখের সামনে।

ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার একটু আলাদা। একুশে ফেব্রয়ারির প্রথম প্রহরে সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধানের শ্রদ্ধা জানানোর পর নিরাপত্তার কড়াকড়ি উঠে গেলে শহীদ মিনারে নামে জনতার ঢল। সে ঢল থাকে দুপুর পর্যন্ত।

এ উপলক্ষে অবশ্য শহীদ মিনার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। সাজানো হয় বর্ণাঢ্য রূপে। বছরের বাকি সময় শহীদ মিনারকে নানাভাবে ব্যবহার করে এ শহরের মানুষ। কোনও দাবি আদায়ে, আমরণ অনশন করতে মূল বেদিতে দিনের পর দিন অবস্থান করা, সভা-সমাবেশ ছাড়াও কোনও অধিকার আদায়ের মিছিলের গন্তবব্য থাকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।

বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মারা গেলেও তাদের মরদেহ আনা হয় শহীদ মিনারের পাদদেশে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এই শহীদ মিনারের অবস্থান হওয়ায় গণমাধ্যম কর্মীরাও সহজে পৌঁছে যেতে পারেন সেখানে। কিন্তু সেসব কর্মসূচি ছাড়াও ছিন্নমূল মানুষও নিরাপদে সময় কাটান এই মহান শহীদ মিনারে।

একুশে ফেব্রয়ারি ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলোতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষা করা হয় নাÑ এই অভিযোগ এনে ২০১০ সালের ফেব্রয়ারিতে হাইকোর্টে রিট করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। সংগঠনের তরফ থেকে আদালতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার একটি ঐতিহাসিক স্থান, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই স্থাপনা গড়া হলেও এখন এর ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। এখন সেখানে মাদকাসক্তদের আড্ডা, অসামাজিক কার্যকলাপ হয়। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনা হয় রিট আবেদনে।

২০১০ সালের ফেব্রয়ারির ৯ তারিখে বিষয়টি আমলে নেন হাইকোর্ট। শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, সে বিষয়ে রুলও ইস্যু করেন বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি নাঈমা হায়দারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ।

শুনানি শেষে রায় হয় ২৫ আগস্ট। রায়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে, তাদের স্মৃতি রক্ষায় শহীদ মিনার গড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও নির্দেশ দেয়া হয় বলে সাংবাদিকদের জানান আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। অবশ্য কিছু কিছু পদক্ষেপ আদালতের তরফে পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সেখানে পাহারার ব্যবস্থা করা, যারা ভবঘুরে বা মাদকাসক্তদের আনাগোনা ঠেকাবে।

শহীদ মিনারের মূল বেদিতে সভা-সমাবেশ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আমরণ অনশন, অবস্থান ধর্মঘট বা এই জাতীয় কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ করা হল।

রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জনের স্মারক, শহীদ মিনারের মূল বেদির পাদদেশে অবশ্য সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। এর ফলে শহীদ মিনারের মূল বেদির ব্যবহার একটি আইনি কাঠামোর আওতায় চলে এলো।

জুতা খুলে শহীদ মিনারের মূল বেদিতে যাওয়ার একটি প্রথা সবাই মেনে চলেন। মূল বেদির বাইরে সভা-সমাবেশ করলে দর্শক জমায়েতও নিশ্চয়ই মূল বেদিতে হতে পারবে না।

শুধু শহীদ মিনার নয়, রায়ে নির্দেশনা এসেছে ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের সম্পর্কেও। ভাষা আন্দোলনে শহীদ, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, মরণোত্তর পদক, আর জীবিত ভাষা সংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে রায়ে। সরকারকে বলা হয়েছে তাদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার।

মামলার বিবাদী করা হয় প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র, পিডব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী ও চিফ আর্কিটেক্টকে।

প্রকৃত ভাষা আন্দোলনকারীদের একটি তালিকা করে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তা গেজেট আকারে প্রকাশেরও নির্দেশ দেয়া হয় রায়ে। আর এই তালিকা করতে একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেয়া হয়ছ সরকারকে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানানোর নির্দেশও রয়েছে আদালতের তরফে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য একটি প্রবাদে উল্লেখ করা যায়, যে দেশে গুণীর কদর হয় না, সেদেশে গুণী জন্মায় না। পরিশেষে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয়, কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।

লেখকঃ সম্পাদক ও প্রকাশক আইনবিষয়ক পত্রিকা ‘সময়ের দিগন্ত’ ও পিএইচডি গবেষক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।