ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘বাংলা ব্লগ মানেই কুৎসিত অসভ্যতা নয়’

জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৩
‘বাংলা ব্লগ মানেই কুৎসিত অসভ্যতা নয়’

অস্ট্রেলিয়া থেকে: বেশ কিছু মেইনস্ট্রিম পত্রিকাতে বাংলা ব্লগ সাইটগুলো নিয়ে ঢালাওভাবে আপত্তিকর শিরোনাম দিয়ে কিছু লেখা নজরে এল। মাত্র গুটিকয়েক ব্লগারের ধর্ম নিয়ে কিছু আপত্তিকর পোস্টের রেফারেন্স দিয়ে প্রকাশিত এইসব পত্রিকার রিপোর্ট যে ব্লগিং এর বাইরের পাঠকদের ব্লগ নিয়ে ভুল মেসেজ দিবে তা বলাবাহুল্য।



ব্লগ নিয়ে কোনও বিরূপ ধারণার শিকড় গভীরে যাবার আগেই একজন একটিভ ব্লগার হিসেবে পাঠকদের সত্য জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। ইংরেজি শব্দ Weblog এর সংক্ষিপ্ত রূপ হল ব্লগ। যে ওয়েবসাইটে একজন ব্যক্তি বা গ্রুপ তার/তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ঘটনা পর্যবেক্ষণ, মতামত বিশ্লেষণমূলক ইত্যাদি লেখা বা ছবি পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দেন সেই ওয়েবসাইটকেই মূলত ব্লগ বলা হয়ে থাকে। যারা ব্লগ লেখেন তাদেরকে বলা হয় ব্লগার।

উল্লেখ্য যে, শুধু যারা ব্লগিং করেন তারাই যে ব্লগের পাঠক তা নয়। যে কেউ যেকোনো ব্লগারের লেখা পড়তে পারেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু নিজস্ব ব্লগ আছে যেখানে মূলত যার ব্লগসাইট তিনি ছাড়া অন্য কেউ লিখতে পারেন না। তবে সেখানে একজন পাঠক লেখাটির ওপর তার মতামত ইমেইল বা ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে লগইন করে জানাতে পারেন।

অন্যদিকে গ্রুপ ভিত্তিক ব্লগসাইটগুলোতে যে কোনও ব্যক্তি তার ইমেল আইডি ব্যবহার করে এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কিছু তথ্য প্রদান করে নিজের পছন্দের একটি ব্লগে ব্লগার হিসেবে নিবন্ধন করে নিজস্ব ভাবনাগুলো অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।

বাংলাদেশে মূলত ২০০৫ এর শুরুর দিকে গ্রুপ ব্লগসাইট খুব ধীরে যাত্রা শুরু করলেও মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ব্যপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। নিজস্ব মত প্রকাশের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখায় গ্রুপভিত্তিক বিভিন্ন ব্লগসাইট বিভিন্ন নামে যাত্রা শুরু করে। দ্রুতই বাড়তে থাকে ব্লগসাইট এবং ব্লগারের সংখ্যা। মেইনস্ট্রিম পত্রিকার পাশাপাশি বিশ্বের সব ধরনের খবরাখবর জানতে আজকাল ব্লগসাইটগুলো নির্ভরযোগ্য তথ্য আদানপ্রদানের অভয়ারণ্য।

ব্লগ হল মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক। ব্লগিং যারা করেন তারা যেকোনো বিষয়ের উপর যুক্তি-তর্কে নিজস্ব মতামত প্রদান করে থাকেন। হেন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে ব্লগে আলোচনা হয় না। ব্লগ যেন তত্ত্ব ও বিভিন্ন তথ্যের সম্বলিত একটি অনন্য তথ্যভাণ্ডার। এমনও অনেক অনেক ঘটনা আছে যা মেইন স্ট্রিমের সংবাদ মাধ্যম এড়িয়ে গেলেও কোনও না কোনও ব্লগার তার লেখায় তুলে এনেছেন চাঞ্চল্যকর সেই সব খবর এবং সেই সাথে ঘটনার আড়ালের সত্যতা।

উল্লেখ্য, ব্লগগুলোতে কেউ কোনও বিষয়ে নিজস্ব মতামত দিয়ে লেখা লিখেই তার দায়িত্ব শেষ করেন তা নয়। ব্লগগুলোতে থাকে মন্তব্য করার সুযোগ। কোনও বিষয়ে মতের অমিল হলে পাঠক মন্তব্য করতে পারেন। আর লেখক কর্তৃক পাঠকের সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তরও দেওয়া হয়ে থাকে। কিছু কিছু মেইন স্ট্রিম পত্রিকাগুলোতে আজকাল পাঠকের মতামত দেবার ব্যবস্থা থাকলেও লেখক কর্তৃক সেই মতামত খণ্ডনের সুযোগ পত্রিকাগুলোতে থাকে না। কাজেই পাঠকের সঙ্গে লেখকের ইন্টারেকশনের সুযোগ ব্লগগুলোকে মেইনস্ট্রিম পত্রিকা থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র করেছে। তাই ব্লগ হয়েছে পাঠক ও লেখকের মিলন মেলা।

এখানে প্রতি সেকেন্ডে কোনও ব্লগার যেকোনো খবর পাঠকদের জানিয়ে দিতে পারছে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে সবার মাঝে। অনেক ব্লগসাইট আছে যেখানে ব্লগারের লেখা ব্লগসাইট এডমিন কর্তৃক কোনরূপ মডারেট করা হয় না। অর্থাত্‍ যে কোনও বিষয়ের উপর লেখার দায় একমাত্র ব্লগারের নিজস্ব, এখানে ব্লগসাইট কোনও দায়-দায়িত্ব নেবে না।

আবার কোনও সাইট আছে যেখানে লেখা প্রকাশের পর আপত্তিকর কিছু থাকলে মডারেটর তা ব্লগারকে না জানিয়েও মুছে দিতে পারে। আবার এমনও ব্লগসাইট আছে যেখানে লেখা ভালোভাবে মডারেটর কর্তৃক পড়ে তারপর ছাপানো হয়, এমনকি মন্তব্য পর্যন্ত মডারেট করে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

সাধারণত একজন ব্লগারের যেকোনো লেখায় অন্য ব্লগারেরা পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। কখনো খুব প্রাণবন্ত আলোচনা হয়, তবে তিক্ত ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। তবে সেই সব তিক্ত ঘটনা ব্যক্তিগত আক্রশে পরিণত হবে এমনটা ভাবার তেমন কোনও কারণ ছিল না কখনোই।

তবে একথা ঠিক যে, মুক্তচিন্তার ধারক ব্লগে ভয়াবহ নাস্তিক এবং কিছু ধর্মান্ধ আস্তিকও নিজেদের মতামত প্রকাশ করে থাকে। এইসব লেখা লিখে অন্য ব্লগার দ্বারা তারা পক্ষে-বিপক্ষে দু ধরনের সমর্থনই পেয়ে থাকেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কুরুচিপূর্ণ লেখার প্রায় সময় ব্লগেই জোরালো প্রতিবাদ হয়। আসলে এসব লেখার লেখকের সংখ্যা খুবই সীমিত।

ব্লগসাইটে যে ঢালাওভাবে শুধু নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ লেখা ছাপানো হয় এরূপ অপপ্রচার বাংলা ব্লগসাইটের জন্য ক্ষতিকর ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ একটি ভাল ব্লগসাইটে যদি একজন ব্যক্তি নিয়মিত ব্লগিং করেন, তার জানার পরিধি বেড়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের কত অজানা ইতিহাস সকলের কাছে আজ উন্মুক্ত হয়েছে শুধুমাত্র বাংলা ব্লগিং এর জন্যই। ব্লগিং এর দ্বারা একজন সাধারণ ব্যক্তি তার চিরাচরিত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত করে আলোকিত সুনাগরিক হিসেবে দেশ গড়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

ব্লগে সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যে অনেক ভাল কবি, লেখক আমরা এরইমধ্যে পেয়েছি। প্রতিবছর বই মেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্লগারদের লেখা বইগুলো সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছে। ব্লগারেরা যে শুধু লিখেই ক্ষ্যান্ত হন, তা কিন্তু নয়। নিজের সমর্থানুযায়ী তারা সম্পৃক্ত হচ্ছেন বিভিন্ন সেবামুলক কর্মকাণ্ডে। যেকোনো দুর্যোগে ব্লগারেরা নিজস্ব উদ্যোগেই আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন প্রতিনিয়ত।

বুদ্ধিবৃত্তিক গণতান্ত্রিক মতামত চর্চার জন্য ব্লগসাইটগুলো অনন্য। আর এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল শাহবাগের গণজাগরণ। অন্যায় ও অনিয়মের প্রতিবাদে ব্লগাররাই সর্বপ্রথম সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। আজও তারা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে প্রজন্ম চত্বরেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছে। এখানে ধর্মীয় মতাদর্শের কোনও ভূমিকা নেই। এখানে আছে শুধুই দেশপ্রেম। শুধুমাত্র ব্লগারদের কারণেই আজ একজন অন্তর্মুখী মানুষও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বেড়িয়ে এসেছেন রাস্তায়। আদর্শে অটল প্রতিবাদী একটি আত্ম নির্ভরশীল জাতী গঠনে ব্লগ যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার নজির হল শাহবাগ।

যেকোনো প্রযুক্তির ভাল-মন্দ দুটি দিকই আছে এবং থাকবে। ভাল-মন্দের এই আপেক্ষিকতা নির্ভর করে সম্পূর্ণভাবেই ব্যবহারকারীর উপর। কাজেই ব্লগিং এ নিজস্ব মতামত যদি সামাজিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ এর পরিপন্থী হয়ে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করার আশংকা দেখা দেয়, তবে আইনের আওতায় এনে তা রোধ করা যেতে পারে।

অতি সম্প্রতি ক্ষতিকর কিছু ব্লগসাইট বন্ধ করে দিয়ে সরকার হয়তো সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারে। শক্ত মনিটরিং দ্বারা  ধর্মবিদ্বেষ এর ঢালাও অপবাদ থেকে বাংলা ব্লগসাইটগুলোকে আওতামুক্ত করে আমরা ব্লগ দ্বারা সমাজের ভালদিকগুলোকে আরও বৃহত্‍ পরিসরে ছড়িয়ে দেবার দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছিল যে মহান ফেব্রুয়ারিতে, সেই ভাষার মাসে দাবি জানাই, ঢালাওভাবে বাংলা ব্লগিংকে জড়িয়ে অপপ্রচার বন্ধ হোক। ব্লগিং এর দ্বারা ভাষা হিসেবে বাংলা আরও বিকশিত হোক বিশ্বজুড়ে।

জিনিয়া জাহিদ, বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।