ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সরকার বিরোধী মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নয়

সাহেদ আলম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৩
সরকার বিরোধী মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নয়

শাহবাগের টানা অবস্থান যাকে গণজাগরণ হিসেবে বলছি আমরা সেটি কতখানি জাগরিত করলো আপামার গণমানুষকে তা মাপার সময় এখোনো আসেনি। এই জাগরণের শুরুটা যেহেতু ফেসবুক ব্লগ আর অনলাইন প্রতিবাদের মাধ্যমে, তাই সেখানকার আলোচনা আর অনুভ‍ূতিগুলি পর্যালোচনা করেই সামনে এগোবে শাহবাগের চেতনা।

আপাতঃদৃষ্টিতে শাহবাগের অর্জন কি, তাতে অনেক মত ও পথ থাকতে পারে। তবে শাহবাগ যে এক চেতনার নাম তা নিয়ে বোধ হয় সংশয়ে খুব কম মানুষ। সেই চেতনা মুক্তিযুদ্ধকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফিরিয়ে আনার চেতনা।

অনেকের প্রশ্ন জাগতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি এতটাই ফিকে যে ১৭ দিন ধরে স্লোগানে স্লোগানে সেটিকে পূর্নজাগরিত করতে হয়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বঘোষিত দাবিদার বর্তমান সরকার। গত সাড়ে চার বছর ধরে সরকার তো এমন কোন কাজ করেনি যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুন্ঠিত হয়েছে। তাহলে কেন আবার নতুন করে চেতনার দরকার? নাকি যেই দলটি মুক্তিযুদ্ধের ধারক বাহক তাদের, চেতনার শেষ ভরসাস্থল তাদের কোন কোন কর্মকাণ্ডে মুক্তির চেতনা ভুলুন্ঠিত হওয়ার ভয়ে ছিল সাধারণ মানুষ। এমন প্রশ্ন যাদের মনে তাদের উত্তরে বলছি, শাহবাগে সমবেত হয়ে সেই ভয়কে জয় করার সাহস জুগিয়েছে তরুণ প্রজন্ম।

অমি রহমান পিয়াল। শাহবাগ আন্দোলনের পেছনের এক বড় সংগঠক। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগ করেছেন। ব্লগে নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখা আর বিপক্ষের মানুষ কে বিরোধিতা করেছেন বলে তার পরিচয় জেনেছি। তার একটি কথা এটিএন নিউজে প্রচারিত হয়েছে। খুব পরিষ্কার কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাইরে রেখে রাজনীতি হবে না বাংলাদেশে। হোক না সরকারি দল অথবা বিরোধী দল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই রাজনীতি করতে হবে, সরকার পরিচালনা করতে হবে। খুব পরিষ্কার কথা। আমি সম্পূর্ণ একমত তার সাথে। বোধ করি শাহবাগে দলমত নির্বিশেষে যারা অংশ নিয়েছেন তারাও এই বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু পৌঁছালো কি সেই বার্তা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে?

সময় বলে দেবে সামনের দিনের জোট-মহাজোট কিংবা একক দলীয় কর্মসুচি ধরন থেকে। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের  স্বপক্ষের দল হিসেবে দাবী করে। তাদের সেই দাবির পক্ষে সোচ্চার থাকেন সাদেক হোসেন খোকা আর মেজর হাফিজের মত মত মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু যেই দল একাত্তরের ঘাতক বলে চিহ্নিতদের সরকারের মন্ত্রী বানায়, তাদের নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার পতনের আন্দোলনে নামে, জামায়াত শিবিরের সহিংস কর্মকাণ্ডে জোট রাজনীতির কারণে নৈতিক সমর্থন দেয়, সেই দলের প্রতি মুক্তি চেতনায় আস্থা খুঁজে পায় না শান্তিপ্রিয় মানুষ। জামায়াত কে বাদ দিয়ে বিএনপির সামনের রাজনীতির পথ প্রসস্ত না হলে জামায়াতী সমর্থক ছাড়া খোদ বিএনপি কর্মী সমর্থক তো বটেই, তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশই বীতশ্রদ্ধ হবে তাদের রাজনীতি আর নেতৃত্বের প্রতি।
বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা রাষ্ট্রে, রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের উদ্দেশ্যে ইসলাম কে রাষ্ট্রর্ধমে স্থান দেবার কাজটি করেছিলেন সরকারের বর্তমান বড় মিত্র এইচ এম এরশাদ। এটির মাধ্যমে শুধু সংবিধানে একটি লাইন সংযোজিত হয়নি, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার- এই নীতির বড় চপোটাঘাত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে যে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয় সেই ধর্মের নামে রাজনীতি করার বিরুদ্ধে যতই আমরা প্রতিবাদী হই-খুব পরিষ্কার করে বিরোধিতার সুযোগ আমাদের দিচ্ছে না সংবিধান। যার মাধ্যমে সংবিধানে প্রবেশ করলো রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, তিনি কিন্তু বর্তমান সরকারের-ই অংশ। শাহবাগে যখন প্রতিবাদী সাধারন মানুষ, সংহতি প্রকাশে অগণিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তখন নিজেদের যারা মঞ্চের বাইরে রেখেছেন তাদের মধ্যে জাতীয় পার্টিও আছে, আছেন দলীয় প্রধান এরশাদও। শাহবাগে যারা সংহতি প্রকাশে আসেন নি তাদেরকে মঞ্চের সংগঠকদের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি আখ্যা দেওয়া হয়ছে। সেই হিসেবে কি জাতীয় পার্টিও মুক্তি চেতনা বিরোধী। তাই যদি হয় তবে তাকে নিয়ে নির্বাচনী জোট বাঁধে কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় দলটি?

শাহবাগে সংহতি প্রকাশ না করার বড় দল এককভাবে বিএনপি। শাহবাগের যত স্লোগান আর বিক্ষোভ তা জামায়াতে বিরুদ্ধে হলেও পরোক্ষভাবে গায়ে পড়েছে বিএনপির। ‘যারা পালে রাজাকার, তারাও তো রাজাকার’- এমন স্লোগান তো বিএনপির উপর যেয়ে আঘাত হানে। কারণ রাজাকার আর রাজাকারের দল তাদের নির্বাচনী মিত্র। বিএনপির নেতা-কর্মীর আপসোস করতেই পারেন যে এই চেতনা ১৯৯৬ সালের দিকে হলে বিএনপি ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও নির্বাচনী কৌশলের জন্যে রাজাকারদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় সেটা জানতে পারতো তরুণ প্রজন্ম। তবে সময় তো ফুরিয়ে যায়নি। বিএনপি ছাড়াও, সরকারের মিত্র জাতীয় পার্টির বেশ কিছু নেতা এবং বর্তমান সরকারের দু’এক জন মন্ত্রী এমপির বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে বিরোধিতার যে অভিযোগ আছে তারাও তো রাজাকার উপাধি পেতে পারেন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে হাত লাল হয়ছে গুটি কয়েক মানুষের নয়, শত সহস্র রাজাকারের। বাকীরা কোথায়, কার আশ্রয়ে, সেই হিসেব চাইতে পারিনি আমরা শাহবাগে। এটাই শাহবাগের বড় ব্যর্থতা। তবে তরুণ প্রজন্ম নিশ্চই সেই হিসেব চাইবে ভবিষ্যতে আর সতর্ক নজর রাখবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে যেয়ে যারা রাজনীতি করবে সেই সব দল ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে।

শাহবাগের তরুণ নেতৃত্ব অভিভাবক হতে পারতো সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের যারা জীবন বাজি রেখে কোন রকম ক্ষমতার লোভ না করে যুদ্ধ করেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নিরবে চোখের জল ফেলেননি, বরং বুক উচিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। যারা ক্ষমতা আর  নীতিহীন দলাদলির রাজনীতিতে আপোষ করতে না পেরে খাদের কিনারায় যেয়ে পৌঁছেছেন, তাদেরকে বুকে টেনে না নিয়ে শাহবাগ তাদের আরো দ‍ূরে ঠেলে দিয়ছে ক্ষেত্র বিশেষে। কে বা কাদের প্ররোচনায় সে সব দাবি তোলা হয়েছে মঞ্চ থেকে তা নিশ্চয়ই বোঝেন সচেতন মানুষ।   কিন্তু শাহবাগের তরুণ জমায়েত শুধুই তাদের চিনলো একজন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা আর সংবিধান প্রণেতা হিসেবে। এই দেশটির পেছনে তাদের পূর্বের অবদান কি, আর কেনই বা  বর্তমানে তারা ছাতার বাইরে সেই ব্যাখা আর ঘটনা জানলো না মুক্তির চেতনা পিপাসু শাহবাগের জমায়েত। এটাও বড় ব্যর্থতা শাহবাগের।

শুধ‍ু এখানেই নয়, ফেসবুক আর ব্লগে প্রশ্ন তোলা হয়েছে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইদ স্যার, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ড. ইউনুস কে নিয়ে। তারা কেন সংহতি প্রকাশ করেননি স্বশরীরে তার ব্যখ্যা চাওয়া হয়েছে। উষ্কে দেয়া হয়েছে শাহাগের পথভ্রষ্ট কোন কোন বাশীবাদকের তরফ থেকে যারা একবার ও মনে করেননি শাহবাগ চেতনার এই আলোকিত মানুষ গুলোর কারীগররা ঘৃনার পাত্র নন। তারা আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। তারাও আত্বনির্ভরশীল জাতি গঠনে নিরলস শ্রম আর  মেধা উজাড় করে যাচ্ছেন। তারা আসেন নি বলে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি এমন ভাবনা অন্তত শাহবাগ তারুন্যের নয়। যারা সেই ভাবনা উষ্কে দিচ্ছেন তারা কারো কারো অভিলাষ পূরণে কাজ করছেন। বরং কেন তারা এখানে আসতে পারেনি, তাদের কে আপন করে নেবার প্রতিবন্ধকতা গুলো শাহবাগ দূর করতে পেরেছে কিনা সেটা মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। সামনে আন্দোলনকে টেনে নিতে হবে বহুদুর। শাহবাগের গণজাগরন মঞ্চ দল-মত নির্বিশেষে সবার, আমাদের জাতীয় অভিভাবকেরা সেখানে সম্মান পাবেন ঘৃনা নয়। তাহলেই শাহবাগ হবে আরো কোটি মানুষের চেতনার নাম।  

তবে ব্যর্থতার দু’একটি নজির থাকলেও এই শাহবাগ এক নতুন বাংলাদেশের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার লক্ষ মোমবাতির আলোয় আলোকিত হয়ে কোটি হৃদয়ে স্থান নিয়েছে বিশুদ্ধতা। শহীদের কাছে লেখা চিঠির আবেগ ছুয়ে গেছে অনন্য যুদ্ধ না দেখা কোটি প্রাণের হৃদয়ে। একাত্তরের ঘাতকরা কোন র্ধমীয় নেতা নয় বরং সত্যিই ঘাতক আর ঘৃনার পাত্র হিসেবেই জনধিকৃত হয়েছে প্রতিটি দিন। গণমানুষের চেতনার স্লোগান জয় বাংলায় ফিরেছে তরুণ মনে। এ এক এমন অর্জন যা স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরেলেও দলীয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মসুচির মাধ্যমে তা করতে পারেনি আওয়ামীলীগ। নির্দলীয় ব্যানারে হলেও, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক শাহবাগের তরুণরা সেটিই করে দেখিয়েছে। কোন দল তাতে সুবিধা পেল, কোন দল পেল না সেই ভাবনায় অপেক্ষকৃত কম কলুষিত হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের বেশিরভাগ কর্মসুচি।

সাহেদ আলম, অতিথি লেখক। তরুণ সংবাদকর্মী।
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৮৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৩
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।