ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মতলবি মানবাধিকার মতলবি প্রশ্ন!

জাহিদ নেওয়াজ খান, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১৩
মতলবি মানবাধিকার মতলবি প্রশ্ন!

নতুন মতলবি প্রশ্ন: এই এতো এতো মৃত্যুতে আপনি কি হ্যাপি নাকি আনহ্যাপি? মানুষের মৃত্যুতে সামান্যতম সুখী হওয়ার মতো বিষয় থাকতে পারে, কারও মাথায় বিন্দুমাত্র এরকম চিন্তা থাকলে বুঝতে হবে, হয় সে মানসিকভাবে পুরোপুরি বিকারগ্রস্ত অথবা চালবাজির জন্য এই মৃত্যু তার কাছে আকাঙ্খিত।

সেই আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ভালোভাবেই করেছে জামায়াত-শিবির।

২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ১৮ জেলায় তাদের সহিংসতায় ৭৪ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৩৮ জন জামায়াত-শিবিরের কর্মী বা সমর্থক, ৩০ জন সাধারণ মানুষ ও অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং ৬ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য। এই সময়ে ১৪ জেলার বিভিন্ন জায়গায় তারা সংখ্যালঘু পরিবার ও মন্দিরে হামলা করেছে, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালিয়েছে। কেবল কানসাটেই পুড়িয়ে দিয়েছে ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি।

স্বাধীন বাংলাদেশে এক সময়ে এতো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও বাস্তবতা যে একই সময়ে এতো বেশি জায়গায় অরাজকতা এবং নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। গণভাবে এতো বেশি অনিশ্চয়তাও বোধ করেনি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ। এতো সব দুঃখজনক ঘটনার পেছনে খুনের রাজনীতির পরিচালক, যারা একাত্তরে গণহত্যা-হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট-অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ করে আরও বেশি হত্যা-খুনের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিতে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেওয়ার আবদার।

কথিত তাফসির এবং ওয়াজের নামে যৌন সুড়সুড়ানি বক্তব্যের জন্য সাঈদীর যেহেতু ভিন্ন পরিচয়ে কিছুটা জনপ্রিয়তা আছে, তাই যুদ্ধাপরাধের কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার ফাঁসির আদেশের পর কিছু মানুষকে উস্কে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সুযোগ গ্রহণ করে জামায়াত-শিবির। অবশ্যই এটা যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে তাদের লক্ষ্য ছিলো কিছু লাশ, যাতে, অনেকের ভাষ্যমতে তাদের ‘অঘোষিত আমির’ বেগম খালেদা জিয়া একে ‘গণহত্যা’ বলে রাজনৈতিক ফ্রন্টেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন।

এমন কোনো অনৈতিক কাজ এবং প্রচারণা নেই লাশ ফেলার অপরাজনীতিতে যা জামায়াত-শিবির করেনি। শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণকে প্রথমে তারা নাস্তিকদের জমায়েত বলেছে। তাতে শুরুতে দুয়েকটি ইসলামী সংগঠন সাড়া দিলেও পরে তারা ভুল বুঝতে পেরে জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে গেছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের সাড়াও তারা পায়নি। ইসলামের নামে রাজনীতি করা এই ভ-দের মিথ্যা প্রচার সেখানেই থেমে থাকেনি। ফটোশপে এডিট করে ইন্টারনেটে এমন ছবি ছেড়ে দিয়েছে যাতে মনে হয় শাহবাগে অনৈতিক কাজ চলছে আর এ কারণে মা-বাবারা তাদের ছেলে-মেয়েদের শাহবাগে যেতে না দেন।

এইসব গাঁজাখুরি প্রচারণা কাজে না আসায় সাঈদীর মামলায় রায়ের পর তারা গ্রামের সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে একদিকে ইসলাম রক্ষার কথা বলে আর অন্যদিকে নগদ টাকা বিলি করে গ্রামের কিছু মানুষকে যুক্ত করে পুলিশের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ শুরু করে। ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মাদ্রাসার শিশু আর জামায়াতি এনজিওর বেনিফিশিয়ারি নারীদের। সশস্ত্র জামায়াত-শিবির কর্মীরা অনেক জায়গায় অবস্থা এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে নিজেদের বাঁচার জন্য পুলিশের গুলি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। যেখানে পুলিশ নিরস্ত্র ছিলো অথবা আরও অপেক্ষা করেছে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও ফরহাদ মজহারের মতো লোকেরা টেলিভিশনের পর্দায় আর পত্রিকার পাতায় জামায়াতের ফেরিঅলা হিসেবে হাজির হয়ে, নিজেকে মানবাধিকার কর্মী দাবি করে যে কথা বলতে চাচ্ছেন তার মানে হচ্ছে, জামায়াতের সশস্ত্র হামলায় পুলিশ বাহিনীকে শহীদ হয়ে যেতে হবে, কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য গুলি করা যাবে না।

তা হয়নি কারণ কোনো দেশের পুলিশ বাহিনীই ফরহাদ মজহারের মতলবি মানবাধিকারপন্থী নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে যেখানে পুলিশ গুলি করতে বাধ্য হয়েছে সেখানে তাই দুঃখজনক হলেও প্রাণহানি ঘটেছে। নিকট ইতিহাসে এতোবেশি প্রাণহানি আর বাংলাদেশে ঘটেনি। এ নিয়ে তাই সমালোচনামুখর অনেকে। কিন্তু যারা সমালোচনা করছেন তারা শুধু মুদ্রার একপিঠ দেখছেন। এতোবেশি প্রাণহানির বিপরীতে তারা এটা দেখেন না, আসলে দেখতে চান না, এরকম গণনৈরাজ্য-গণঅরাজকতা-গণআইনঅমান্যতাও আর কখনও ঘটেনি।

৮৬ থেকে ৯০’র গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত রাজপথের একজন কর্মী হিসেবে যে অভিজ্ঞতা তাতে আমরা জানি কখন পুলিশ গুলি করে, কখন প্রাণহানি ঘটে। আমরা একটি স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে পেরেছি, কিন্তু এতো অল্প সময়ে এতো বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি কারণ ওই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি যেটা এখন জামায়াত-শিবির করছে।

মনে আছে ৯০’র ২৭ নভেম্বর ডাক্তার মিলন শহীদ হওয়ার পরদিন জরুরি অবস্থার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন বিডিআর সদস্য ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে আটক হয়েছিলেন। সাংবাদিক আনিস আলমগীরের ক্যামেরায় তার ছবি থাকার কথা, তাকে ছবি তুলতে দেখেছিলাম। এরশাদের বিরুদ্ধে ওই সময়ে ছেলে-মেয়েদের চরম ক্ষোভের কারণে ওই বিডিআর সদস্যকে কিছু মারধোর করা হলেও ছাত্র-ছাত্রীরাই তাকে শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে যাতে তিনি আরও শারীরিক ক্ষতির আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেন। পুরো ক্যাম্পাসে তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্যও ছিলেন না, সেদিন চাইলে ছেলে-মেয়েরা তাকে ধুলোয় মিশিয়ে ফেলতে পারতো, ডাক্তার মিলন শহীদ হওয়ার পর ওই অবস্থাও ছিলো। কিন্তু তা ঘটেনি কারণ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে অন্যপক্ষের মনে করলেও শত্রুদেশের সৈনিক মনে করেনি।

বিপরীতে জামায়াত-শিবির এখন পুলিশ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের শত্রুদেশের সৈনিক মনে করছে। কারণ এদেশকে তারা তাদের দেশ মনে করে না। একাত্তরে তাদের পেয়ারের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেভাবে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে আল-বদর-রাজাকাররা যেভাবে নীরিহ মানুষ হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে; এবারও তারা ঠিক সেভাবেই ঝাপিয়ে পড়েছে যাতে হয় তারা পুলিশ বাহিনীর সদস্যটিকে কতল করতে পারে, অথবা তাদের নিজেদের পক্ষে প্রাণহানি ঘটে।

পুলিশ বাহিনীর সদস্যই নিহত হোক অথবা তাদের পক্ষের প্রাণহানি, দু’ভাবেই লাভ খোঁজার চেষ্টা করেছে জামায়াত। তাদের দুরাশা ছিলো, যদি অনেক বেশি পুলিশ সদস্যকে খুন করা যায় কিংবা তাদের পক্ষের অনেক প্রাণহানি; তাহলে এমন কোনো হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে যাতে সরকার পড়ে যায় আর তাদের কলিজার টুকরা খুনি নেতারা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সাঈদীর মামলায় রায় ঘোষণার পর একজন জুনিয়র আইনজীবী সাঈদীকে ‘সরকার পড়ে যাবে’ বলে যে কথা বলেছিলেন সেটাই তার প্রমাণ।

এভাবে বর্তমান সহিংসতা আসলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের যুদ্ধ। যে যুদ্ধে মাদ্রাসার শিশু আর গ্রামের নারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে উস্কে দিয়ে তাদেরকেও কথিত জেহাদে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে জামায়াত-শিবির।

এক বগুড়ার ঘটনাই এর আরেক প্রমাণ। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন আজগুবি তথ্য মোবাইল ফোনে ছড়ানোর পাশাপাশি মসজিদের মাইক থেকেও ওই গুজব ছড়াতে ইসলামের নামে রাজনীতি করা জামায়াত-শিবির কর্মীদের বুক একটুও কাঁপেনি। সাধারণ মানুষকে উস্কে দিতে তারা ফজরের নামাজের সময় মসজিদের মাইক থেকে চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে দাবির সঙ্গে একথাও প্রচার করে এমন একজন ঈমানদার লোকের মুক্তির জন্য সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়া ঈমানি দায়িত্ব। এই হচ্ছে জামায়াতের ইসলাম, শিবিরের ইসলাম।

তাদের সেই ইসলামবিরোধী ইসলামের প্রমাণ শিবির নেতার বক্তব্যে আরও স্পষ্ট। বগুড়া জেলা শিবিরের প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, “চাঁদে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দেখা যাওয়া গুজব বা ‘সত্যি’ যাই হোক-- এর পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ও তার ভক্তরা একজোট হয়ে রাস্তায় নেমে মিছিল করে। পুলিশ এসব মিছিলে গুলি চালালে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। ”

আবারও মিথ্যা। যে মানুষরা জামায়াত-শিবিরের উস্কানিতে পড়ে মিছিলে গিয়েছিলো তারা নিজেরাও সাক্ষ্য দেবে, পুলিশ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালালে পুলিশ গুলি চালিয়েছিলো, গুলি চালানোর পর হামলা হয়নি।
শুধু বগুড়া নয়, আরও অনেক জায়গার কোথাও কোথাও শুধু জামায়াত-শিবির, আর কোথাও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে উস্কানিতে পড়া গ্রামবাসী থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, ট্রেন, বিদ্যুতকেন্দ্র, সরকারি অফিস, আদালত, মুক্তিযুদ্ধ ভাষ্কর্য, শহীদ মিনার, ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী নেতাদের বাড়িঘরে হামলা করেছে। কোথাও পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর সদস্যদের তারা কোনো ভবনে তালাবন্দী করে আগুন দিয়েছে, কোথাও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ হবে এ বাজনা বাজিয়ে স্থলবন্দরে নির্মাণাধীন মোটেলের ছাদ থেকে প্রকৌশলীকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে, কোথাও কলেজ শিক্ষককে আর কোথাও জগতজ্যোতির মতো গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠককে কুপিয়ে খুন করেছে, কোথাও পানিতে ডুবিয়ে সংখ্যালঘু প্রবীণ মানুষকে মেরে ফেলেছে।

এভাবে একাত্তরের তাদের সব অপকর্মের পুনরাবৃত্তি করেছে জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্রসংঘ থেকে নাম পরিবর্তন করা তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির। এরপরও যারা মানবাধিকারের কথা বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, তারা আসলে একাত্তরে মানবাধিকারের চরম লংঘনের বিচার বন্ধ করে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ছেড়ে দিতে চান। একজন বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হয়েও তাদের একজন বেগম খালেদা জিয়া। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন এবং পরের বিবৃতিই তার প্রমাণ।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই ([email protected])

বাংলাদেশ সময় ১৩৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।