ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জন্ম নেয়া জঙ্গিরা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১৩
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জন্ম নেয়া জঙ্গিরা

ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে বেসরকারি নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র আটকের পর আতংকিত হওয়ার মতো সব তথ্য আসছে গণমাধ্যমে। আটক পাঁচজনই হত্যার কথা স্বীকার করেছে।

তারা বর্ণনা করেছে, কিভাবে পরিকল্পনা হয়েছে, কারা মদদ দিয়েছে, এবং কিভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে।

হিংসা, অনাচার আমাদের রাজনীতির চরিত্র। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, একটি প্রথমসারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে রাজনীতি নেই, ছাত্র-সংসদ নেই, সেখানে এই ধরনের হত্যাকারী থাকতে পারে। এখানে যারা পড়তে আসে তারা মূলত ধনিক শ্রেণীর। এরা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, এরা চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সমস্ত রাজনৈতিক কাজকর্মকে নির্বাসনে পাঠানো হোক।

কিন্তু আজ একথাই প্রতিষ্ঠিত হলো যে, রাজনীতি না থাকলেও, আপাতঃ সেখানে একটি কর্পোরেট সংস্কৃতির চর্চা থাকলেও, এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোনটি হয়ে উঠছে জঙ্গি তৈরির অভয়ারণ্য।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি তৈরি শুরু নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের মাধ্যমে। আর এতে বড় মদদদাতা ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের এক অধ্যাপক। এসব আধুনিক বিত্তশালী পরিবারের তরুণদের মগজ ধোলাই করে জঙ্গি বানানোর পরিকল্পনা অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিলো হিযবুত তাহরীর।   নিষিদ্ধ করার পরও তা যে অব্যাহত আছে, তা বোঝা গেলো এই পাঁচ ছাত্রের গ্রেপ্তারে।

নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ বলছেন, এক শ্রেণীর শিক্ষক ছাত্রদের জঙ্গিবাদের মদদ দিচ্ছেন। আমরা জানি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকখানি নির্ভরশীল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশই নোংরা, সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। তবে কী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসছেন, তারাই এখানকার ছাত্রদের মাঝে কুরাজনীতি ছড়াচ্ছেন? এই আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। বিশেষ করে, উগ্র মৌলবাদি ঘরানার যেসব শিক্ষক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদালয়ে পড়াচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া জরুরি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নেই, ছাত্র-সংসদ নেই। তাই পড়ালেখার পরিবেশ অনেক ভাল। এটা অভিভাবকদের সন্তুষ্টি। কিন্তু যদি তাদের সন্তানেরা এমন জঙ্গি হতে থাকে, তবে কি কোন তৃপ্তির জায়গা আছে?

যাদের সন্তানেরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তারা খুব উচ্চস্বরে বলেন, ক্যাম্পাস রাজনীতি করার জায়গা নয়। এখানে জ্ঞান আর বিদ্যাচর্চাই প্রধান কাজ। কথাটা আংশিক সত্য। ক্যাম্পাস অবশ্যই বিদ্যাচর্চার জায়গা। কিন্তু আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার জ্ঞান ছাড়া শুধু বিদ্যাচর্চা সম্পূর্ণ হয়না। রাজনীতি না হোক, রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার। এই রাজনীতি সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি নয়, দরকার বড় রাজনীতি।

ছাত্র সংসদ থাকা, বিতর্ক হওয়া, আলোচনা হওয়া খুব জরুরি, মনের জানালা খোলার জন্য। অন্যথায় এখানকার শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছাড়াই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে। রাজনৈতিক এই আলোচনা, এই বিতর্ক না থাকলে, যথার্থ রাজনৈতিক শিক্ষা থেকে বাইরে থাকবে এই শিক্ষার্থীরা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জন্ম নেবে আরো ডজন ডজন রাজীব হত্যাকারী।       

তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রচলিত ধারার ছাত্র-রাজনীতি আর শিক্ষক রাজনীতি এসব ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে। এখন সরকারি কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি বিরাজামান, তাতে আর যাই হোক শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ কারণেই সেশন জট নেই, সন্ত্রাস নেই, হানাহানি নেই। কিন্তু যদি এই ভাল পরিবেশে তলে তলে জঙ্গি ও মৌলবাদি মনমানসিকতার তারুণ্য তৈরি হতে থাকে, তাহলে ভাবা দরকার বিকল্প কী? এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা দরকার যেন, এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই মুক্তমনে একটি উন্নততর ও সাহসী সমাজের স্বপ্ন দেখতে পারে। তারা যেন অন্ধকারে বাস করা খুনী চক্র হয়ে না উঠে।  

সাধারণভাবে মানুষ ভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি মানে টাকার কারবার আর সন্ত্রাসের প্রবল দাপট। সেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক এনে পড়ানো মানে সেই মন-মানসিকতাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমদানি করা হয় কিনা তা ভেবে দেখার আবকাশ আছে।   অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানে এক একটি স্বার্থপর শ্রেণি তৈরির কারখানা যারা সমাজ থেকে, মানুষ থেকে অনেক দূরে। এ ধারনা বদলানো প্রয়োজন।  

অনেকে হয়তো বলবেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েতো বিতর্ক হয়। আমি সে বিতর্কের কথা বলছিনা। বলছি ছাত্র সংসদ করে, সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির বাইরে মুক্তবুদ্ধি আর গণতান্ত্রিক আলোচনার একটা জায়গা করে দেওয়া। আমাদের অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রের একটি নমুনা আমাদের অসুস্থ ক্যাম্পাস রাজনীতি। বেসরকারি বিশ্ববিদালয়ে ছাত্র সংসদ হবে দলীয় রাজনীতির বাইরে গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমৃদ্ধ ও গভীরতর করার সংসদ।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, পরিচালক (বার্তা), একাত্তর টেলিভিশন

বাংলাদেশ সময় ২০২৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৩
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।