ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সিমোন দ্য বোভোয়ার: একজন নারীবাদীর গল্প

আদনান সৈয়দ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৯ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৩
সিমোন দ্য বোভোয়ার: একজন নারীবাদীর গল্প

[০৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। ফরাসি নারীবাদী সিমোন দ্য বোভোয়ার ছিলেন বিশ্বের নারীবাদী আন্দোলনের পুরোধা।

এই দিনে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি]

পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতে নারীর স্থান কোথায়? পুরুষ শাসিত এই সমাজে একটি শিশু জৈবিকভাবে তার জন্মলগ্নের শুরু থেকেই শিকার হয় লিঙ্গ বৈষম্যের। জন্মের পরপরই লিঙ্গভেদে শিশুটির বেড়ে ওঠার প্রতিটি পদচিহ্নে চাপিয়ে দেওয়া হয় সমাজের নানা আইন-কানুন। তার হাতে-পায়ে সুকৌশলে পরিয়ে দেওয়া হয় লিঙ্গ বৈষম্যের কঠিন শৃঙ্খল। প্রকৃতির সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা শিশুটি একদিন হঠাৎ বুঝতে পারে সে নারী।

নারী হয়ে জন্ম হওয়ার কারণেই শিশুটির চাল-চলন, আচার-আচরণ, হাসি-ঠাট্টায়, চিন্তায়-মননে সর্বক্ষণ পুরুষের কঠিন করতলে নারিটি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। তখন তাকে টিপ পরিয়ে, পুতুল খেলিয়ে প্রমাণ করা হয় সে নারী। ইচ্ছে করলেই সে পুরুষের মতো আঙিনার বাইরে যেতে পারবে না, গলা ছেড়ে জোর গলায় কথা বলতে পারবে না; পারবে না জেদি হতে। তার পোশাক ভিন্ন, খেলনা ভিন্ন, ঘুমানোর জায়গাও ভিন্ন। এই ভিন্নতার জন্য দায়ী তার লিঙ্গ। তারচেয়েও বড় কারণ সে নারী।

একটি শিশু যখন নারী হয়ে ওঠে তখন সে আর পুরুষের মতো চলাফেরা করতে পারবে না, ঘরের ভেতরেই যতটা সম্ভব তার স্থান নির্ধারিত হয়ে যায়। সন্তান উৎপাদন এবং লালন-পালন, স্বামীর জন্য সাজগোজ করে অপেক্ষায় বসে থাকা, ঘরকন্নার কাজ সবই নারীর অবশ্য করণীয় হয়ে ওঠে। সিমোন দ্য বোভোয়ার নারীদের প্রতি পুরুষ শাসিত সমাজের এই অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছিলেন সেই ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ লা দ্যাজিয়েম সেক্স (দি সেকেন্ড সেক্স) বইটি লিখে গোটা বিশ্বে নারীবাদী হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। নারীদের প্রতি সমাজের এই বৈষম্যের কথা জানা ছিল বলেই বোভোয়ারের মতো একজন নারীবাদীই হয়তো বলতে পেরেছিলেন ‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং কেউ নারী হয়ে ওঠে’।

জানুয়ারি ০৯, ১৯০৮ সালে প্যারিসে সিমোন দ্য বোভোয়ারের জন্ম। জন্ম সালটা নিঃসন্দেহে নারীবাদী হওয়ার জন্য ছিল খুবই যুক্তিসঙ্গত। ধর্মীয় উন্মাদনায় নারীরা যখন কোণঠাসা, ঠিক তখন শিল্পবিপ্লবের নামে নারীদের পণ্যের কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে একদল পুঁজিবাদীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। সে কারণেই পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থার সেই মুহূর্তে বোভোয়ারের মতো একজন নারীবাদীর জন্ম খুব অস্বাভাবিক ছিল না। বাবা জর্জ দ্য বোভোয়ার ছিলেন উকিল। আবার সখের অভিনেতাও। মা ফ্রাসোঁয়া ব্রাসেয়ো ছিলেন একজন ধর্মীয় গোড়া ক্যাথলিক। চিন্তায়, মননে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই বোভোয়ারের নানা গুস্তাভ ব্রাসেয়ো এক অর্থনৈতিক মহাসংকটের মধ্যে পড়েন। তিনি ছিলেন মিওস ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। ব্যাংকটি ঋণখেলাপি হওয়ায় সিমোনের পারিবারিক জীবনে এক অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। বোভোয়ার বেড়ে উঠতে থাকেন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেই। চোখের সামনেই দেখতে পান মা ব্রাসোয়ার অমানষিক দুঃখ-দুর্দশার এক করুণ চিত্র। সেই ছেলেবেলাতেই সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন না। জন্ম দেবেন না সন্তানের। যে সমাজ লিঙ্গের বৈষম্যেকে লালন-পালন করে সে সমাজে আর যাই হোক বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধন মানায় না।

সিমোন দ্য বোভোয়ারের ছোট বোন হ্যালেন দ্য বোভোয়ার (পরবর্তীতে বিখ্যাত আঁকিয়ে হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন)। সিমনের বাবার দুই কন্যা সন্তানের চেয়ে অনেক শখ ছিল একটা পুত্র সন্তানের। এ নিয়ে তিনি মাঝে মধ্যেই অনেক আক্ষেপ করতেন। ছেলেবেলা থেকেই সিমোন প্রচণ্ড মেধাবী হওয়ায় বাবা জর্জ সবসময় বলতেন, একজন পুরুষের মতোই তোমার মেধা আছে । ১৫ বছর বয়সে সিমোন সিদ্ধান্ত নেন তিনি একজন বিখ্যাত লেখক হবেন। পিতা জর্জের জীবনে নাটক আর শিল্প-সাহিত্যের প্রতি যে অক্ষমতাটুকু ছিল তার ষোলআনাই ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন কন্যা বোভোয়ার।

সিমোন ভর্তি হন ফ্রান্সের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সোরবোর্নে। সেখানে পরিচয় হয় বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে। ১৯২৯ সালে সিমোনের যখন ২১ বছর বয়স তখন তিনি দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, সেই পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন জ্যাঁ পল সার্ত্র। পরীক্ষায় এই প্রথম আর দ্বিতীয় হওয়া নিয়েও কিছু কানাঘুঁষা সেই সময় বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বোভোয়ারের জীবনীকার দেয়ার্দে বেয়ার্স মনে করেন, পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন সত্যিকার অর্থে খোদ সিমোনই। কিন্তু সার্ত্র ছিলেন পুরুষ আবার পরীক্ষাটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় উদ্যোগের ফসল। তাই অনেকটা মানবিক অজুহাত দিয়েই জুরি বোর্ড সার্ত্রকে প্রথম স্থানটি দিয়ে দেন। কিন্তু প্রথম আর দ্বিতীয় যেই হোন না কেন সার্ত্রের সঙ্গে সিমোনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের, প্রেমের আবার কখনো কখনো গুরু-শিষ্যের।

সার্ত্রের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্ব নয়, তার দার্শনিক চিন্তার বিচার বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণ সমালোচক হয়ে ওঠেন সিমোন দ্য বোভোয়ার। প্রাক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকে পুঁজিকরে আর সার্ত্রের সঙ্গে ওলগা কোসাকিউয়িজ এবং ওয়ান্ডা কোসাকিউয়িজের প্রেমের দুর্বোধ্য জটিল সম্পর্কের মালা গেঁথে সিমোন লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ’সি কেম টু স্টে’ । সেটা ছিল ১৯৪৩ সাল। এই উপন্যাস প্রকাশ হওয়ার পরপরই উন্মেচিত হয় সিমোন এবং সার্ত্রের অপেক্ষাকৃত জটিল সম্পর্কের কথা। ১৯৪৫ সালে সিমোনের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লা সেং ডেস অট্রিস’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটির পটভূমি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসন্ন অনাগত ভাবিষ্যত সামনে রেখে। উপন্যাসের নায়ক জন ব্লোমার্ট যিনি পারিবারিক বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর প্রেমে পড়েন হেলেন নামে এক নারীর। শুরু হয় জনের রাজনৈতিক এবং পাশাপাশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিচার বুদ্ধিবৃত্তিক এক নতুন জীবনের কাহিনী। উপন্যাসটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। উল্লেখ্য ১৯৮২ সালে ক্লাউদে চারবলের দক্ষ পরিচালনায় এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয় পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘হেলেন’।

১৯৫৪ সালে সিমোন দ্য বোভোয়ার প্রকাশ করেন তাঁর আত্মজীবনিমূলক উপন্যাস ‘লেস মেন্ডারিন’ বা দি ম্যান্ডারিন। দি ম্যান্ডারিন সিমোনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর লেখা ভিন্নধর্মী এক উপন্যাস। ভিন্নধর্মী এ কারনে যে উপন্যাসটিতে সিমোন তার নিজের এবং সার্ত্রের অনেক ঘটনাই তুলে এনেছিলেন অনেকটা রূপক আর ব্যাঙ্গাত্মকভাবে। বলা বাহুল্য উপন্যাসটি সিমোনকে এনে দেয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। উপন্যাসটি ফরাসি সাহিত্যে সেরা হিসেবে প্রিক্স গনকোর্ট পুরস্কারে ভূষিত হয়। গোটা উপন্যাসটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনোবিজ্ঞানী এনি ডুবরুইল এবং তার স্বামী রোবার্টের জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে সিমোন এবং সার্ত্রের চরিত্রকেই যেন ফুটিয়ে তোলেন বোভোয়ার।

১৯৪৯ সালে দুই খণ্ডে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠায় লেখা হয় সিমোনের সবচেয়ে সাড়া জাগানো নারীবাদী গ্রন্থ ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ । এই বইটির মাধ্যমে সিমন গোটা পৃথিবীতে নারীবাদী তত্ত্বের এক নতুন প্রতিবাদী জোয়ার তৈরি করতে সমর্থ হন। শুধু লিঙ্গ বৈষম্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেভাবে নারী সমাজের এক ভাষাহীন, স্বপ্নহীন এবং সামাজিক দুর্বল জীবে পরিণত করে রাখতে সবসময় সচেষ্ট থাকে সিমোন অত্যন্ত জোরালোভাবে এর মনস্তাত্ত্বিক এবং ইতিহাসগত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁর সেকেন্ড সেক্স বইটিতে।

বোভোয়ার মনে করেন সমাজে দুই শ্রেণীর প্রাণী আছে। প্রথম সারিতে থাকছেন পুরুষ আর দ্বিতীয় সারিতে অন্যান্য গোত্রভুক্ত প্রাণী। পুরুষ শাসিত এই সমাজ নারীদের প্রতিনিয়ত এ ‘অন্যান্য’ গোত্রের মধ্যে বসবাসরত এক কাল্পনিক জীব হিসেবে ভাবতেই বেশি আনন্দ পায়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে পুরুষরা সবসময় যে সাফাইটি দেন তা হলো নারীকে বোঝা কঠিন আর এরা সবসময়ই রহস্যাবৃত। সে কারণেই নারী ও পুরুষকে একই পাল্লায় মাপা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। উল্লেখ্য, পুরুষদের এই ধরনের সাফাইয়ের পেছনে অনেক রকম সামাজিক এবং ধর্মীয় চিন্তার অবদান আছে। তবে দেখা গেছে শুধু ধর্মের দোহাই দিয়েই নয়, একজন নারীর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা তার লিঙ্গ পরিচয়ে। এ বিষয়ে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকেই বিবেচনায় আনার চেষ্টা করেন। মার্কসের মতে পুরুষ তার ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য ঘরের বাইরে সময় কাটায়। সে যখন ঘরে ভেতরে ঢোকে তখন সে ঘরটিকে একটা ছোটখাটো রাজ্য ভেবে সে রাজ্যের রাজা হতে চায়। তখন সে নিজের বউ ছেলেমেয়েদের দাস-দাসীর চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না। তবে এর কারণ যে পুরোপুরি অর্থনৈতিক নয় তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেখা গেছে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই নারীর একমাত্র মুক্তির পথকে সুগম করতে পারছে না। অর্থাৎ কথাটা ঘুরিয়ে বললে এভাবে বলা যায়, একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া মানেই যে সেই নারীটি পুরুষের মতো স্বাধীন, তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে নারী পুরুষসৃষ্ট সমাজে কতটুকু মানসিক এবং মনম্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা পাচ্ছে তাও দেখার বিষয়। সিমোন এই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে সামাজিক এবং পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে দেখতে চান। তিনি বলতে চান, পুরুষ সবসময়ই নারীকে ঐতিহ্যিক ভাবেই রাক্ষুসী, অস্বাভাবিক, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে গাল দিয়ে আসছে। পুরুষের মনোজগতে নারীর এই অবস্থানের কারণেই নারী সবসময় পুরষের চোখে প্রতিনিয়ত তুচ্ছ হতে বাধ্য।

১৯৫৮ সালে সিমোন দ্য বোভোয়ার চার খণ্ডে তাঁর আত্মজীবনী শেষ করেন। গ্রন্থগুলি হলো- মেমোয়ার্স অব এ ডিউটিফুল ডটার, দি প্রাইম টাইম, ফোর্স অব সারকামস্টেন্স এবং অল সেইড অল ডান। আত্মজীবনীতে আনন্দময় শৈশব, বুদ্ধিদীপ্ত চোখে বেড়ে ওঠা চারপাশের খণ্ডচিত্র, সার্ত্রের সঙ্গে জীবনের তিক্ত এবং মধুর লেনদেনের গল্প, বিশ্বযুদ্ধের দুর্বিসহ স্মৃতি সবকিছুই ঠাঁই পায়। সার্ত্রের সঙ্গে সিমোন বিভিন্ন সময়ে পর্তুগাল, তিউনেসিয়া, সুইজারল্যন্ড, ইটালি, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ভ্রমণের সুযোগ পান। তারা একসঙ্গে দেখা করেছেন ফিডেল ক্যাস্ট্রো, ক্রশ্চেভ, চে গুয়াভারাসহ অনেক বিপ্লবী নেতার সঙ্গে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সার্ত্রসহ তাঁর অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের কথা অত্যন্ত সাবলিল এবং খোলাখুলিভাবেই স্থান পায় এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলোতে। ঘটনার বর্ণনায় দেখা যায় বোভোয়ার ব্যাক্তিগতভাবে ছিলেন খুবই আত্মকেন্দ্রিক। হাতেগোনা তাঁর বুদ্ধিজীবী বন্ধুমহল বলতে যা বুঝায় তাদের সঙ্গেই ছিল তার নিত্যদিনের ওঠা-বসা।

নিজের পছন্দমতো জীবনযাপনে অভ্যস্থ এবং বিশ্বাসী ছিলেন সিমোন। নারীর অধিকার নিয়ে সবসময় সচেতন থাকার কারণেই পুরুষকেন্দ্রিক আচার আনুষ্ঠানেও তার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। লোক দেখানো সামাজিকতায় তাঁর কোনো আস্থা ছিল না। এমনকি ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারের অনুরোধে একটু মুচকি হাসতেও বোভোয়ারের পাহাড় সমান বাধা ছিল। ফটোগ্রাফার জিসেলে ফ্রিয়োদ তার স্মৃতি কথায় বলেছেন, “অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে লুকোনোর জন্যই সম্ভবত তিনি খুব একটা হাসতেন না। ” ষাটের শুরুর দিকে জরায়ুর স্বাধীনতা, গর্ভপাত এবং নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তিনি প্রচার করেন একজন পুরুষের সামাজিক মর্যাদায় যে অবস্থান থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে, একজন নারীরও ঠিক সমানভাবে সেই একই অধিকার আছে। ১৯৭৯ সালে তাঁর প্রথম জীবনে দেখা অনুসরণীয় কিছু প্রগিতিশীল নারীদের গল্প অবলম্বনে লেখেন ছোটগল্প ‘দা থিংস অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট’। নারী অধিকার বিষয়ক তাঁর আরেক ছোটগল্পের সিরিজ ’দি ওমেন ডেস্ট্রয়েড’ পাঠকমহলে বেশ সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়।

অনেকেই মনে করেন বোভায়ারের দার্শনিক চিন্তায় উজ্জীবিত গ্রন্থ ‘দি এথিক্স অব এমবিগিউটি’ সার্ত্রের ‘বিং এন্ড নাথিং লেস’ দ্বারা প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত চিন্তার ফসল মাত্র। আর সে কারণেই সাহিত্যের হিসেব-নিকেশ এবং নারীবাদী লেখক হিসেবে সিমোন দ্য বোভোয়ার যত না উচ্চকিত, দার্শনিক বিচারে তাঁর জায়গাটা ঠিক ততটুকু নয়। অবশ্য এ প্রসঙ্গে সিমোন খোলাখুলিভাবে স্বীকারও করেছেন যে তিনি সার্ত্রের চিন্তা এবং দর্শনে কখনই প্রভাবিত ছিলেন না। তিনি নিজেকে একজন দার্শনিকের চেয়ে বরং সাহিত্যিক হিসেবেই দেখতে বেশি ভালোবাসেন।

১৯৮১ সালে সার্ত্রের জীবনের শেষ বছর গুলোর স্মৃতি নিয়ে প্রকাশ করেন ‘এ ফেয়ারওয়েল টু সার্ত্র’। বইটির মুখবন্ধে সিমোন লেখেন, “সার্ত্রের ওপর এটিই আমার একমাত্র বই যেখানে রচনাগুলো প্রকাশিত হওয়ার আগেই সার্ত্র পড়তে পারলেন না। ” এখানে উল্লেখ্য, সিমোন এবং সার্ত্র সবসময়ই পরস্পর  নিজেদের লেখা পড়তেন এবং সমালোচনাও করতেন। সার্ত্রের মৃত্যুর পরপরই সিমোন এবং আরলেটে এলকেইম নামের এক আলজেরিয়ান নারী বিভিন্নরকম তিক্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। আরলেট ছিলেন সার্ত্রের অন্যতম প্রিয় ছাত্রী যিনি ১৮ বছর বয়সেই সার্ত্রের সঙ্গে বিভিন্ন রকম দার্শনিক বিষয়-বস্তু নিয়ে তর্ক-বিতর্কে মেতে থাকতেন। সার্ত্র স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটির বিচক্ষণতায় মুগ্ধ ছিলেন এবং কারো কারো মতে সার্ত্র মেয়েটিকে দক্ষিণ ফ্রান্সের এক শহরে একটা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন যেখানে তিনি প্রতি গ্রীষ্মে কয়েক সপ্তাহের জন্য সময় কাটাতে যেতেন। সার্ত্রের মৃত্যু পর সিমোন যখন সার্ত্রের চিঠিপত্র গুলোতে কোনরকম কাঁচি না চালিয়েই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেখানে বাধ সাধেন আরলেটে। এ নিয়ে সিমোনের সঙ্গে আরলেটের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপের দিকে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত সার্ত্রের বেশির ভাগ চিঠিপত্রই সিমোন কে সম্পাদনা করেই প্রকাশ করতে হয়।

জীবনের শেষ দিকে সিমোন প্রচণ্ডরকম মাদকাসক্ত হয়ে পরেন। সার্ত্রের মতো তিনিও একসময় ড্রাগ নিতে শুরু করেন। ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল নারীবাদী এই নারী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর সিমোন দ্য বোভোয়ারকে কবর দেওয়া হয় প্যারিসের সিমেটর ডু মোন্টপ্যারানেসে তাঁর আজীবন বন্ধু জ্যাঁ পল সার্ত্রের সমাধির ঠিক পাশেই। সমাপ্ত হয় এক নারীবাদীর জীবনের সমস্ত গল্পকথা। কিন্তু শুধু একজন নারীবাদী লেখক হিসেবেই নয়, সিমোন বেঁচে রইলেন এক তুখোড় বুদ্বিজীবী, দার্শনিক এবং সাহিত্যিক হিসেবে গোটা পৃথিবীর মানুষের হৃদয় জুড়ে।

লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট, ব্লগার এবং ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।