ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এবারও কেন সংখ্যালঘুরা টার্গেট

ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৩
এবারও কেন সংখ্যালঘুরা টার্গেট

গত বছর ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ইং তারিখে রাম, উখিয়া, পটিয়াসহ শান্তিপ্রিয় এদেশের অত্যন্ত নিরীহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালায় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এ হামলায় ২৬টি বৌদ্ধবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।



এছাড়াও বৌদ্ধদের বসতবাড়িতে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রাচীন পুঁথিপত্র, ত্রিপিটক, প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যে ক্ষতি দেশের হলো তা পূরণ হবার নয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নগ্ন হামলা চালানো হলো দেশব্যাপী, যা আজও অব্যাহতভাবে চলছে।

গত কয়েক দিনে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এবং শুক্রবার ধর্মান্ধগোষ্ঠী নরসিংদী, লক্ষীপুরের রায়পুর, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, চট্রগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া সুইপুরা রুপনগর বৌদ্ধ বিহারে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধবংস করা হয় উপাসনালয়, ঘর-বাড়ি। বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এদেশে কেন টার্গেটে পরিণত হবে ।

বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মসুলমান। তারা ধর্মপ্রাণ। এ ধর্মপ্রাণ মুখের বুলি না হয়ে প্রকৃত ধার্মিকতার পরিচয় দিতে পারি যখন সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারি। ধর্ম কী বলে দিয়েছে অন্য ধর্মের মন্দির, ঘরবাড়ি পোড়াও। এটা কী ধার্মিকতার পরিচয়। কোনো ধর্মেইতো সহিংসতা, হানাহানির কথা বলা নেই। তবু যা করা হচ্ছে ধর্মের নামেই। স্বার্থের জন্য ধর্ম ব্যবহার করে কলুষিত করছি ধর্মকে ।

ধর্মীয় অনুভূতি সকল সম্প্রদায়ে বিদ্যমান। এটা জেনে নিজের ধর্মানুভূতির বড়াই করতে গিয়ে এবং অন্যের ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে তাদের ধর্ম ও সমাজ অস্তিত্ব ভুলুণ্ঠিত করে কোনো ধার্মিকের ধর্ম প্রতিপালন বা সম্পন্ন হতে পারে না। এটা যথাযোগ্য ধর্ম অনুশীলনকারীরা বুঝলেও ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বোঝে না।

আর বুঝলেও তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে কখনো বা সংখ্যাগরিষ্ঠের দম্ভে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে। সকল ধর্মই মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু ধর্মের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মের নামে মানুষের সহজ সরলতার সুযোগ নিয়ে অকল্যাণে নিয়োজিত হয়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত। সুশিক্ষার অভাব সর্বত্র। আমাদের যেসব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে সেসবের শিক্ষাপদ্ধতি, বিষয়গুলোও একজন ভালো মানুষ তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়। গ্রামের অর্ধশিক্ষিত, লোকদের খুব সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে পারে। ধর্মীয় অনুশাসন বাস্তবায়নকারী পুরোহিত, প্রচারক, মোল্লা সম্প্রদায়ের বিশেষ একটি গোষ্ঠী ধর্মের সারকথা না বুঝেই অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ করে।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুত্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশের অভ্যুদয়। যার কল্যাণে আমরা পেয়েছিলাম অত্যন্ত আধুনিক ও মানবিক সংবিধান। সংবিধানের মূল স্তম্ভ হিসেবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে মানুষের মুক্তির ঐকতান পরিলক্ষিত হয়।

একে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি ও দলের বার বার বিপথগামী হবার অভিলাষই মানুষে মানুষে হানাহানি, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, উগ্র ধর্মান্ধতা তথা আজকের সামগ্রিক বিপর্যয়ের মূল কারণ বলেই মনে হয়।

আবহমান কাল থেকেই বাংলার জনগণ সৌহার্র্দ্য সম্প্রীতির ভাব বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। কারণ এদেশের সহজিয়া সম্প্রদায়, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান একই মায়ের সন্তান। একই রক্ত প্রবাহ তাদের ধমনীতে। আমাদের প্রধান পরিচয় আমরা মানুষ। তারপর বাঙ্গালী, তারপর হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান।

ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতবাদে বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী। শেকড়ই আমাদের অগ্রগতির বৃক্ষের মগডালে উঠার মৌলিক শক্তি। এটাকে অস্বীকার করে শেকড় ধ্বংস করে সম্যক প্রত্যাশী ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অকৃতজ্ঞ। তারা নিজেদের ও মানব সমাজের অকল্যাণ আর  বিপর্যয় ছাড়া অন্য কিছু করতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে হানাহানি, রক্তপাত, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন তথা জান, মাল ও সম্ভ্রমহানির ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে তার মূলে দেশপ্রেমের মুখোমুখি ধর্মকে দাঁড় করিয়ে দেয়া। বার বার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বিশেষ একটি গোষ্ঠীর পৌনঃপুনিক আক্রমণ, হামলা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে।

আমাদের বলতে আজ দ্বিধা নেই যে ধর্মের অপব্যবহার করে যারা মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে লেলিয়ে দেয়, পশুবৃত্তি চরিতার্থ করতে বাধ্য করে তারা কখনো ধার্মিক হতে পারে না। মানুষের চর্ম পরিধান করলেও তারা মনুষত্ব, মানবতা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া গত সোমবার (৪ মার্চ ২০১৩) এক বিবৃতিতে বলেছেন, ধর্ম-গোত্র সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের জানমাল সম্ভ্রমের নিরাপত্তা ও ধমীর্য় অধিকার সুরক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। তাদের ওপর কোনো আঘাত বরদাশত করা হবে না।

তিনি আরো বলেন ‘এদেশের মানুষ ধার্মিক কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় গণ বিচ্ছিন্ন শাসকরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ঠ করে জনগণের আন্দোলনকে বিপদগামী করার অপচেষ্টা চালিয়েছে ।  

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর দুর্বৃত্তরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মন্দির ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া শুরু করে। তখন থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। মৌলবাদীদের প্রতিরোধে মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রীর আহ্বানটি আরো আগে আসলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরো নিরাপত্তাবোধ করতো, স্বস্তি পেতো। রামু হামলার চল্লিশ দিন পর বিরোধীদলীয় নেত্রীর রামু সফর, যদিও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল রামু সফর করে ছিল। দেরীতে হলে অপরাধীরা সাহস পায়।  

একাত্তর সালেও মুত্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের জানমালের ওপর ক্ষতি সাধন করেছে। বিগত সরকারগুলোর সময়েও অনুরুপভাবে সংখ্যালঘু দলন অব্যাহতভাবে ছিল। যে ভয়ংকর ও নৃশংস চেহারার ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ সমস্ত অপকর্ম করে যাচ্ছে -  তা সংখ্যালঘু দমনে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত বলে মনে করি।

কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এটি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু। এটি কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইস্যু নয়। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভুমিকাও বা কী ? মৌলবাদের চরিত্র হিংসা হানাহানি করা, না হয় পাকিস্তান, আফগানিস্থানে কী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান আছে। সেখানে কেন হামলা হয়।

এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের ধার্মিক হবার আগে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়া চাই। আর পরিশুদ্ধ মানুষ হবার পথে সংস্কৃতিবান হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই। সংস্কৃতিবান মানুষ মাত্রই উৎকৃষ্ট ধার্মিক। তার থাকে বিবেক, বিবেচনার স্বচ্ছ সুদুরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তার পথ অনেক। এর বিপরীতে অন্যরা হয় বোকা নয়তো অন্ধ বর্বর।

যাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, যারা অন্যের বলায় লোক দেখানো ধর্ম প্রতিপালন করে। তাই অন্যের সামান্য উস্কানিতে ধর্ম লংঘন করতেও দ্বিধা করে না। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধিই তাদের উদ্দেশ্য।

ধর্ম কী রাজনৈতিক হাতিয়ার, না মনুষ্যত্ব বিকাশের? এটাই এখন প্রশ্ন। উস্কানি দিয়ে ধর্মীয় উদ্মাদনা সৃষ্ঠি করা যায়। কিন্তু শান্তি ও মৈত্রীর জন্য, মানবতার জন্য আমাদের ভূমিকা কতো টুকু রাখতে পাচ্ছি, বিবেকের কাছে সে প্রশ্ন করি ।

তাই সকলেই আসুন দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম, জীবপ্রেমময় শিক্ষায় নিজেকে আলোকিত করি। জগতে নিজের ও অন্যের বাসযোগ্য সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিয়োজিত হই।

লেখক: সম্পাদক, সৌগত Email: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।