ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা বনাম রাজনৈতিক অনৈক্য

জাহিদ নেওয়াজ খান, সংবাদকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৩
আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা বনাম রাজনৈতিক অনৈক্য

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, এরপর গণতন্ত্রের লড়াই; দীর্ঘ এই লড়াই-সংগ্রামে এক উজ্জ্বল পুরুষ মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। বারবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাঁর দল এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখেছেন তাঁর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার মতো।

তাঁকে সেই সংগ্রামে সাহস যুগিয়েছেন, রাজনীতিতে কমরেড এবং সহধর্মিনী আইভি রহমান, যাঁকে বর্বর গ্রেনেড হামলায় জীবন দিতে হয়েছে।

১০ মার্চ সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার পর, জিল্লুর রহমান আবারো আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, সেই প্রার্থনা এবং অপেক্ষা ছিলো দেশবাসীর। তিনি ফিরেছেন, তবে এভাবে ফেরা কেউ চায় নি। হিমশীতল কফিনে জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত হয়ে শেষবারের মতো দেশে ফিরেছেন তিনি। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের মধ্যে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বাংলাদেশ। শুক্রবার তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন সেই বনানী কবরস্থানে যেখানে জঙ্গিবাদ আর দুর্নীতিবাজের অশুভ আঁতাতে গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভি রহমান ঘুমিয়ে আছেন। ঠিক স্ত্রীর কবরের ওপরই।

শোকের এই সময়ে কিছু প্রশ্ন না তুলতে হলেই ভালো হতো। কিন্তু আমলাতন্ত্রের অদক্ষতায় মানুষ ওই প্রশ্নগুলো তুলছে। আমলাতন্ত্রকে দায়ী করা হচ্ছে এই কারণে যে রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে সরকারের নীতি-নির্ধারণী  শীর্ষ পর্যায় যখন শোকাহত; তখন পরামর্শ দিয়ে অনুমোদনসহ কিছু কাজ আমলাতন্ত্রের দায়িত্বের মধ্যেই ছিলো। তারা তা পারে নি, বা করে নি।

প্রথমেই আসা যাক রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণার বিষয়ে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর কয়েক মিনিটের মাথায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজ ছিলো রাষ্ট্রপতির প্রয়াণ। কোথাও কি দেখেছেন সরকারি পর্যায়ে কাউকে উদ্ধৃত করে ওই ব্রেকিং নিউজটি দেওয়া হচ্ছে? না। অফিশিয়াল কনফার্মেশন ছিলো, কিন্তু আন-অফিশিয়ালি।

স্বাভাবিক যে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদে উদ্ধৃত হতে কোনো কর্মকর্তা রাজি হবেন না। তবে সেই অনুমোদন নিতে তারা দীর্ঘ সময় নিয়েছেন। এরপর বঙ্গভবন এবং তথ্য অধিদপ্তর থেকে শুধু সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়েছে।

অথচ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিলো। যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী না হন, অন্তত: তথ্যমন্ত্রীতো হতে পারতেন। রাষ্ট্রপতির মতো মহামান্য পদের জন্য সেটাই উচিত ছিলো। নিদেনপক্ষে রাষ্ট্রপতির সচিব/ সামরিক সচিব (যদি সিঙ্গাপুরে না হয়ে তাদের অবস্থান দেশে হয়ে থাকে) অথবা প্রধান তথ্য কর্মকর্তা কিংবা রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদটি জানাতে পারতেন।

রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার বিষয়টিও আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে জানানো হলে যেসব প্রশ্নের উত্তর তখন জানা ছিলো না, তা জানা যেতো। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার পর আমরা অনেকেই টেলিফোনে জানতে চেয়েছি বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি হবে কি না।

কোনো উত্তর দেওয়া হয় নি। পরদিন মন্ত্রিসভা বৈঠকে যখন সরকারি ছুটির সিদ্ধান্ত হলো তখন অফিস-আদালতে কয়েক ঘন্টা কাজ হয়ে গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মর্নিং শিফটের ক্লাস শেষ, ডে-শিফটের ছেলে-মেয়েরা আসতে শুরু করেছে।

রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধাপর্ব নিয়েও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছে কয়েকবার। অথচ রাষ্ট্রপতির মৃত্যুসংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সবকিছু চূড়ান্ত করে সংবাদ সম্মেলনে সেগুলো জানানো যেতো। আর রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এলেই আরও ভালো হতো। একই কথা বিরোধীদলীয় নেতার ক্ষেত্রেও।

বিরোধীদলীয় নেতা অবশ্য কিছু নাটকীয়তার পর তার গুলশানের রাজনৈতিক অফিস থেকে পাঠানো শোক বিবৃতিতে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে বা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমরাও মনে করি, সেটা হলেই ভালো হতো। তবে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বলে বেগম জিয়া যে প্রশ্ন তুলেছেন, সে বিষয়ে পাল্টা প্রশ্নও আছে।

এর আগে সরকারি লাল টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করে অন্য মানুষের কণ্ঠ পেয়েছেন, যেটা কোনোভাবেই উচিত নয়। লাল টেলিফোন মানে লাল টেলিফোন; যার জন্য বরাদ্দ তিনি ছাড়া অন্য কেউ তুলতে পারেন না। এবারও যে তা হয়নি সেই নিশ্চয়তা কোথায়!

আর দিনের পর দিন তিনি সংসদে যান না, তাই বিরোধীদলীয় নেতার অফিসটিও খুব কার্যকর নয়। তিনি নিশ্চয়ই বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দাবি করেননি যে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির মৃত্যুসংবাদ জানাতে হবে। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে এই দাবি তার। তিনি যদি নিয়মিত বিরোধীদলীয় নেতার অফিসে বসতেন তাহলে হয়তো সেখানে বসেই দু:খজনক সংবাদটি জানতে পারতেন। ওই সংবাদটি পাওয়ার সময় সংসদ ভবনে স্পিকারের অফিসেই ছিলেন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা স্পিকার। বিরোধীদলীয় নেতা ওই সময় সংসদ ভবনে তার অফিসে থাকলে হয়তো অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিই তাকে ডেকে নিয়ে খবরটি জানাতে পারতেন।

বেগম জিয়া যেহেতু বিরোধীদলীয় নেতার অফিসে প্রায় একেবারেই যান না, তাই সরকার বা সংসদ সচিবালয় থেকে এই দাবি করা হতেই পারে যে বিরোধীদলীয় নেতার অফিসকে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়েছে, কিন্তু তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও সেখানে ছিলেন না অথবা ওই অফিসের সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় নেই বলে তিনি সরকারিভাবে মৃত্যু সংবাদটি জানতে পারেননি। বলা হতে পারে, মন্ত্রীদের মতো বিরোধীদলীয় নেতাকেও ফ্যাক্স বার্তায় রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়েছে। বিরোধী নেতার অফিসে কেউ না থাকায় কেউ তা পড়েও
দেখেননি।

তবে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা কিছু বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাইলেও রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শেষ পর্যন্ত একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিশাল একটি দলের চেয়ারপার্সনের মতোই মনোভাব দেখিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। বঙ্গভবনে শ্রদ্ধার মিছিলে তিনি যোগ দিয়েছেন। এটিই যদিও স্বাভাবিক, তারপরও আমাদের রাজনীতি আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে রাষ্ট্রপতির মরদেহে বিরোধীদলীয় নেতার শ্রদ্ধা জানানোও যেনো বিশেষ কিছু।

এ কারণেই বিএনপি ঢাকা জেলার হরতাল প্রত্যাহার করায় রাতের টকশোগুলোতে অনেকে প্রশংসার ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছেন। বাংলাদেশের অস্বাভাবিক রাজনীতিতে এটাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে সাধারণ বিষয়গুলোও বিশেষ কিছু মনে হয়। অথচ পাশের দেশের শত সমালোচনার পরও রাজনীতিতে শ্রদ্ধার সেই জায়গাটি অটুট।

ভারতীয় গণমাধ্যমে ২০০০ সালে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু বা জন্মবার্ষিকী পালনের একটি ছবি দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছিলো রাজঘাটে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া সেসময়ের ভারতীয় বিরোধীদলীয় নেতা সোনিয়া গান্ধী অবনত মস্তকে বসে আছেন। কিন্তু পায়ের সমস্যার কারণে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী যেহেতু বসতে পারেন না, তাই সোনিয়ার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর পায়ের কাছে এভাবে বিরোধীদলীয় নেতার বসে থাকাতো দূরের কথা, এমনকি এক সশস্ত্র বাহিনী দিবস ছাড়া তাদের একই অনুষ্ঠানে যাওয়াটাও যেনো নাজায়েয।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতারও অবশ্য আলাদাভাবে একই জায়গায় যাওয়ার নজীর আছে। ভারতীয় ফরেন সার্ভিস একাডেমি ওইরকম এক জায়গায়। প্রতি বছর কয়েকশ আইএফএস অফিসার সেখানে প্রশিক্ষণ নেন। তাদের পাসিং আউটের আগেরদিন তাদের সঙ্গে কথা বলেন বিরোধীদলীয় নেতা, আর পাসিং আউটের দিন প্রধানমন্ত্রী। দু’জনই নবীন অফিসারদের কাছে একই সুরে ভারতীয় জনগণের প্রত্যাশার কথা জানান।

সেই প্রত্যাশার উদাহরণ দেখেছিলাম মালদ্বীপে ভারতীয় মিশনে। ভারত হয়ে মালদ্বীপ গিয়েছিলাম এবং ভারত হয়েই ফিরতে হবে তাই ডাবল এন্ট্রি ভিসা দরকার ছিলো। আমার ভিসা যেহেতু সিঙ্গেল এন্ট্রি তাই মালেতে ভারতীয় দূতাবাসে ভিসা আনতে গিয়েছিলাম। পাসেপোর্ট জমা দিয়ে গরম কফির সঙ্গে যে কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলাম কিছুক্ষণ পর তিনি অনুরোধ করলেন আমি যদি পাশের সোফায় বসে তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেই। ওই রুম ছেড়ে বাইরে বসবো কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন, তার দরকার নেই।

একটু পর খুবই সাধারণ পোশাকের এক মহিলা সেখানে এলেন। আন্তরিকতার সাথে তার সঙ্গে কথা বললেন দূতাবাস কমর্কর্তা। হিন্দি পুরোপুরি না বুঝলেও কিছু শব্দে বুঝলাম, ওই মহিলা মালেতে কোনো বাড়িতে কাজ করেন, বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। মহিলা চলে যাওয়ার পর দূতাবাস কর্মকর্তাও তাই জানালেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হলো, এই সাত-সকালে এসব সমস্যা নিয়ে না ভেবে তিনি তো আরামসে কফি খেতে খেতে আমার সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির আররও কিছু মশা-মাছি মারার আড্ডা চালিয়ে যেতে পারতেন। জবাবে তিনি বললেন, সেটা তিনি পারেন না; কারণ এই মেয়েটি এখানে রোজগার করে দেশে ডলার পাঠাচ্ছে, আর বিদেশে তিনি খরচ করছেন সেই ডলার।

বিদেশে আমাদের শ্রমিকদের এমন সুখের অনুভূতি আছে কি না জানি না; তবে আমাদের আমলাতন্ত্রের যোগ্যতাতো আমরা পদে পদে দেখি। বিপরীতে অন্য দেশের আমলাদের তাদের নিজেদের স্বার্থে যে যোগ্যতা তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি গল্প সাংবাদিকদের অনেকেরই জানা। প্রয়াত সাংবাদিক আতাউস সামাদ এই গল্পটি বলেছেন। আমি অবশ্য সরাসরি তাঁর কাছ থেকে শুনিনি, শুনেছি সাংবাদিক সফিকুর রহমানের কাছ থেকে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার সময় আতাউস সামাদ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে ইন্দিরা গান্ধী আপনাকে এতো সমর্থন দিলেন, আপনি সৌজন্য না দেখিয়ে প্রথম দেখাতেই কিভাবে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, কবে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। জবাবে নাকি একটি প্রভুভক্ত প্রাণীর নাম উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় ৫০০ .... (আমলা) রেখে গেছে। তার ১০০ ছিলো পাকিস্তানে, আর ভারতে ৪০০। সেই ১০০’র খপ্পড় থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত হতে ২৩ বছর লেগেছে, ৪০০’র খপ্পড়ে পড়লে কতোদিন লাগবে!

কারও ভালো নাও লাগতে পারে, কিন্তু অন্য দেশের আমলারা নিজ স্বার্থে এরকমই দক্ষ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেও এক বা একাধিক দেশের আমলাদের হাত ছিলো বলে বিশ্বাস আছে। বিপরীতে একজন রাষ্ট্রপতির স্বাভাবিক মৃত্যুর পরও কিছু নিয়ম-আচার ঠিকঠাক করতে পারলো না আমাদের আমলাতন্ত্র।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই ([email protected]);

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।