ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাই কার্যকর উদ্যোগ

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৩
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাই কার্যকর উদ্যোগ

প্রতি বছর ধান কাটার মৌসুমে বিভিন্ন প্রিন্ট ও চলমান মিডিয়ার সংবাদ শিরোনামে যে খবরটি বেশি দৃশ্যমান হয় তা হলো যে, “ধানের ন্যায্যদাম পাচ্ছেন না কৃষক”। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং ধান কাটা শেষে সরবরাহের তুলনায় চাহিদার পরিমাণ কম থাকায় ধানের দাম নেমে যায়।

যদিও প্রতি বছর কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকদের কৃষি উপকরণ প্রদানের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের দুর্নীতির কারণে মাঠ পর্যায়ে সেই সুবিধা অনেক সময় পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

যার ফলে অধিকাংশ প্রান্তিক ও বর্গাচাষী, কৃষি উপকরণ কেনার জন্য মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে বা দাদনে ঋণ নিয়ে কৃষি উপকরণ কিনে ধান চাষ করে থাকেন। ধান ঘরে উঠতে না উঠতেই পাওনাদারেরা টাকা পরিশোধ করার তাগিদ নিয়ে আসেন। দাদনদাতাদের চাপে অধিকাংশ সময় কৃষকেরা অনেক কম দামে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়ে থাকেন।
 
প্রশ্ন হলো- আমাদের কৃষকেরা কেন বছরের পর বছর একই অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন? এত কষ্ট করে ধান চাষের পর কেন তারা ন্যায্যমূল্য-বঞ্চিত হচ্ছেন? সমস্যা কি এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব কি?
 
আমাদের দেশে একটি বিষয় এখন কম বেশি সবাই জ্ঞাত যে, ধান-চালের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারি ক্রেতা আছেন যাদেরকে আমরা ফড়িয়া বলে থাকি। তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট অত্যন্ত সক্রিয়। প্রতি বছর সরকার ঘোষিত যে প্রকিউরমেন্ট দাম ধানের জন্য বেধে দেওয়া হয়, এই সব মধ্যস্বত্ত্বভোগী ফড়িয়ারা তা মানে না।

এদের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কৃষক সরকারের কাছে ধান বা চাল ন্যায্যদামে কখনোই বিক্রি করতে পারেনা। এদের দাপটের কারণে কিংবা যোগসাজসে সরকারি কর্মকর্তারাও অনেক অঞ্চল আছে যেখান থেকে ধান কখনো সংগ্রহ করার জন্য যায় না।
 
যেহেতু দরিদ্র কৃষকের ধান সংরক্ষণের কোনো সুব্যবস্থা নেই, এই সব মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে অনেকটা পানির দরেই ধান বিক্রি দিতে তারা বাধ্য হয়। যার ফলে একদিকে কৃষকেরা দাম না পেয়ে লোকসানের মুখে পড়ে, অন্যদিকে ন্যায্য দামসহ কৃষি উপকরণের জন্য নির্ধারিত বিপুল পরিমাণ সরকারি ভর্তুকি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি লোকসানের মুখে পড়ে।

তবে সব থেকে হতাশার কথা হল এই যে, পাইকারী বাজারে ধানের দাম কমে গেলেও খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাম্পার ফলনের সুফল না কৃষক, না ভোক্তা কেউই পাচ্ছে না। চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও নিঃসন্দেহে দায়ী করা যায় মধ্যস্বত্বভোগী সেই শক্তিশালী সিন্ডিকেটকেই।

দেশে “বাম্পার ধানের ফলন হয়েছে” স্বস্তির হাসি থাকে উত্পাদক, ভোক্তা এবং দেশের সরকার সবার মুখে। কিন্তু বাম্পার সেই ফসলের সুবিধা যখন আমরা কেউ ভোগ করতে পারিনা, তখন নিশ্চয় তা উত্পাদক-ভোক্তার কাছে অভিশাপ হয়েই দেখা দেয়।
 
লক্ষ্যণীয় যে, দেশে উত্পাদন বেশি থেকেও শুধুমাত্র ধারণ ক্ষমতা না থাকায় সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে ভবিষ্যৎ চাহিদানুযায়ী ধান-চাল ক্রয় করতে পারে না। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল কেনার পর সরকার আর ধান-চাল কিনবে না বলে ঘোষণা দেয়, এর ফলে বেশিরভাগ সময় অতিরিক্ত ধান নিয়ে কৃষক বিপাকে পড়ে যায় এবং লোকসানের মুখে পড়ে।
 
সংরক্ষণের অভাবে লিন পিরিয়ডে আমরা প্রায় প্রতি বছর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে চাল আমদানি করে থাকি। আর এক্ষেত্রে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়ে যায় আর তার প্রভাব পরে সকল ভোক্তাদের ওপর।
 
বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে ১২ থেকে ১৫ লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য ধারণ করা সম্ভব হয় না। যদিও ২০২১ সালের মধ্যে সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে ধারণ ক্ষমতা ৩০ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার,কিন্তু ২০৩০ সনে সম্ভাব্য ১৯ কোটি জনসংখ্যার জন্য বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি টন খাদ্য প্রয়োজন হবে। আর সেক্ষেত্রে উত্পাদন বাড়াতে না পাড়লে বা কৃষক উত্পাদন বিমুখ হলে নিঃসন্দেহে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
 
মনে রাখা দরকার যে, ২০০৭-২০০৮ এর বিশ্বমন্দার সময় খাদ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি ও সেই সাথে ভারতের খাদ্য রপ্ন্তানি বন্ধের কারণে বাংলাদেশ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছিল।
 
একদিকে জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমি হ্রাস, বৈরী আবহাওয়াজনিত সমস্যা আর তার ওপর যদি দিনের পর দিন কৃষকেরা ধান চাষে ন্যায্যদাম বঞ্চিত হয় তবে একসময় কৃষক ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য কোনো ফসল বা অন্য কোনো পেশায় ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হবে। আর সেক্ষেত্রে ভাত প্রধান বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়বে তা বলা বাহুল্য।
 
কাজেই ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকেরা যাতে বিমুখ না হয়, সে দিকে সরকারকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাসহ সকল উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দেশের কৃষকদের বঞ্চিত করে ভারত থেকে সস্তায় নিম্নমানের চাল কিনে বেশি দামে বিক্রয় করে দেশের উত্পাদন প্রক্রিয়া ব্যহত হবে। কাজেই কিছু ব্যবসায়ীদের বিশেষ অনৈতিক সুবিধা প্রদানের দ্বারা সমগ্র দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য সরকারকে আন্তরিক ও কঠোর হতেই হবে।
 
এছাড়াও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে আমাদের অবশ্যই উচ্চধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন খাদ্য সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে হবে। দেশের কত শত টাকাই তো কত অনুত্পাদনমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় হয়, অথচ এককালীন ব্যয়ে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার গড়ে আমরা পর্যাপ্ত মজুতের দ্বারা যেমন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি, তেমনি আমদানি বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় বন্ধ করতে পারি।    
 
খাদ্য নিরাপত্তা এতই সেনসিটিভ একটু ইস্যু যা আমাদের দেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। ধানের দাম কম হলে কৃষকের অসন্তোষ, চালের দাম বেশি হলে ভোক্তাদের অসন্তোষ। কাজেই এত নাজুক একটি বিষয় সরকারের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করা দরকার।  
 
আমাদের কৃষকরা যাতে ধান উৎপাদন থেকে সরে না আসে সেদিকে সর্বাগ্রে খেয়াল রাখতে হবে সরকারকে। নতুবা খাদ্যে আমদানি নির্ভর দেশ হতে খুব বেশিদিন হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না! আর সেক্ষেত্রে বিশ্ব বাজারে খাদ্য যোগানের ওপর কোনো রকম সংকট তৈরি হলে, চড়া দামে খাদ্য কিনতে গিয়ে দেশের সঞ্চয়ের ওপর চাপ বাড়বে। সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে মারাত্মক ভাবে। কাজেই সুদুর প্রসারী খাদ্য পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করে তার লক্ষ্যে কাজ না করলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মারাত্মক খাদ্য ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  

writereজিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকোনোমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।