ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংস্কার কাজ চলছে

শাখাওয়াৎ নয়ন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৩
সংস্কার কাজ চলছে

২০১৩ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি একদিন।

ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকম হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেশে একটি অন্য রকম অবস্থা বিরাজ করছে। এসবের মধ্যেই ঢাকা শহরটাকে একটু হেঁটে হেঁটে দেখার ইচ্ছা হলো।

এক পর্যায়ে রমনা পার্কের মধ্যে চলে এলাম। পার্কের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। একটা পলাশ ফুলের গাছ চোখে পড়লো। গাছ ভর্তি ফুল। গাছটির কাছের একটি বেঞ্চে বসলাম। বসে বসে ভাবছি, ঢাকা শহরে এখনো এতো সুন্দর ফুল ফোটে! ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে আসলো। হঠাৎ একটি কোকিলের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। অনেক দিন পর কোকিলের ডাক শুনে বসন্তের কথা মনে পড়লো।  

আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। মৎস্য ভবনের লাগোয়া একটি গেট দিয়ে রমনা পার্ক থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তায় প্রচুর যানজট। মৎস্য ভবনের সামনে শাহবাগ যাবার রাস্তাটি ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম কিংবা নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যতীত কোনো ধরনের যানবাহন শাহবাগের দিকে যেতে দিচ্ছে না।

কিন্তু একের পর এক হাজার হাজার মানুষের মিছিল সেদিকেই যাচ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলামঃ
-ব্যারিকেড দিয়েছে কেন?

কয়েকজন তরুণ সমস্বরে স্লোগানের ভঙ্গিতে উত্তর দিলঃ
-রাস্তা সংস্কারের কাজ চলিতেছে।
সেরকম কোনো সরঞ্জামাদি না দেখে ভাবলাম, মজা করছে। তাই আবার জিজ্ঞেস করলামঃ
-এ শহরে আমি অনেকদিন পর এসেছি। আমাকে ঠিকমত বলুন, প্লিজ।

তারা আবার একই ভাবে স্লোগানের ভঙ্গিতেই বললোঃ
-রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। ৪২ বছরের ভাঙ্গা রাস্তার সংস্কারকাজ চলছে।
-এই রাস্তার কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত সংস্কার করা হবে?  
-বাংলাদেশের সকল রাস্তার সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি রাস্তাই সংস্কার করা হবে। শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত কোনো রাস্তাই বাদ পড়বে না।  
-কিন্তু এতো বড় কাজ কিভাবে করবে? তোমরা তরুণ, তোমাদের তো অভিজ্ঞতা নেই।
-প্রথমেই আমরা সেই সব রাস্তা ভেঙ্গে ফেলবো। যে সব রাস্তা দিয়ে যুদ্ধাপরাধী ঘাতকেরা এদেশের ক্ষমতার মসনদে বসে। যে সব রাস্তা দিয়ে এদেশে একজন ঘাতক রাজাকার মন্ত্রী, এমপি এমনকি রাষ্ট্রপতি হয়ে যায়।

যে সব রাস্তা দিয়ে টাকা এনে এখনো এদেশের মানুষকে হত্যা করা হয়, এদেশের কোমলমতি একজন কিশোরকে জঙ্গি বানানো হয়। যেসব রাস্তা দিয়ে এসে এখনো বাংলাদেশকে অস্বীকার করে, শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে, জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। নতমস্তকে হাইকোর্টের দিকে হাঁটা দিলাম। দোয়েল চত্বরে এসে দেখি একই দৃশ্য। এখানেও ব্যারিকেড। একই ভাবে জিজ্ঞেস করলামঃ
-ব্যারিকেড কেন?

একই ভাবে অনেকে এসে মিছিলের শব্দে বললোঃ
-বাঙালি জাতির সংস্কারের কাজ চলছে। হাজার বছরের গৌরব ফিরিয়ে আনতে পুরো জাতিকে সংস্কারের কাজ চলছে। ৪২ বছরের সকল পাপ, সকল কলঙ্ক ধুয়ে মুছে ফেলা হচ্ছে। পুরো জাতিকে পুণ্যস্নান করানো হচ্ছে।  
-কী বলো এসব? এটা কি সম্ভব?
-কেন সম্ভব নয়? আমরা তরুণরা এই মহান কাজটি হাতে নিয়েছি।
-যদি কেউ বাধা দেয়, তবে?  
-বাধ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যই তো জেগেছি আজ। সারা বাংলাদেশের শিশু কিশোরদের মননে চেতনায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছি। মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির বীজ বপণ করছি। আজকের শিশুরাই একদিন বাংলাদেশকে সৌরভে ভরিয়ে দিবে।    

আমি আবার নতমস্তকে হাঁটা দিলাম। পলাশীর কাছে এসে মীর জাফর এবং ঘষেটি বেগমের কথা মনে পড়লে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কাঁটাবন মসজিদেও কাকরাইল মসজিদের মতোই পরিবেশ লক্ষ্য করলাম। কাঁটাবন থেকে শাহবাগের ফুলের মেলায় যাওয়ার রাস্তায়ও ব্যারিকেড।  

এখানে কোনো কথা বললাম না। পরীবাগের মধ্যে দিয়ে রূপসী বাংলা হোটেলের কাছে গিয়ে থামলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে তাকালাম। বাংলাদেশের দীর্ঘতম লাল সবুজের পতাকায় আমার দৃষ্টি আটকে গেল। পতাকাটির এক প্রান্ত বারডেমে হাসপাতালে অন্যপ্রান্ত বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে।

এতো সুদীর্ঘ পতাকা আগে দেখি নি। পতাকার ছায়াতলে লাখ লাখ মানুষ একই সুরে আওয়াজ তুলছে “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। “ অনেকে গলা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই বিখ্যাত গান করছে-‘জয় বাংলা, বাংলার জয়। ‘ আমার মাথা থেকে সব রকমের ‘কিন্তু’ ‘যদি’, ‘তবে’ মুহূর্তেই উবে গেল।  

শিশুপার্কের দিকে তাকালাম। শহীদ জননী জাহানারা ঈমাম তাঁর লাখো সন্তানের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি তাঁর চোখের দিকে তাকালাম। আমার শক্তি বেড়ে গেল বহুগুণ। তাঁর সেই মহান বাণীটি চোখে পড়লো ‘জয় আমাদের হবেই। ’

কখন জানি নিজের মনেই বলা শুরু করলামঃ

সংস্কার কাজ চলিতেছে। ৪২ বছরের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা সংস্কারের কাজ চলিতেছে। একটি জাতির শুদ্ধ সংস্কারের কাজ চলিতেছে। সংস্কারের কাজ চলিতেছে। সংস্কার কাজ চলিতেছে।         

লেখকঃ ব্লগার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, পিএইচডিরত গবেষক। ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া।

 বাংলাদেশ সময়: ১১০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।