ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এ কোন সামরিক সৌরভ ছড়ালেন খালেদা জিয়া!

জাহিদ নেওয়াজ খান, সংবাদকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৩
এ কোন সামরিক সৌরভ ছড়ালেন খালেদা জিয়া!

বাংলাদেশে সর্বশেষ সামরিক শাসন জারির রজত জয়ন্তীর দিন সামরিক সৌরভ ছড়ালেন বেগম খালেদা জিয়া, যার পতি এক প্রয়াত সেনাপতি। বেগম জিয়ার স্বামীর উত্তরসূরি হিসেবে সেনাপতি এরশাদ তারই পতির প্রতিষ্ঠিত দলকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যখন সামরিক শাসন জারি করেন, খালেদা জিয়া তখন শুধুই অন্তঃপুরবাসিনী।

তাই তার প্রতিক্রিয়া কিংবা সামরিক শাসন জারির খবরে অন্ততঃ তার মুখের অভিব্যক্তি কি ছিলো ইতিহাসের পাতায় তার স্থান নেই। তবে বেগম জিয়া রাজনীতিতে নামার পর থেকে তার সঙ্গে ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্কের শেখ হাসিনা ’৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখলের খবরে বলেছিলেন, তারা অখুশি নন।

ওয়ান ইলেভেনের পরও শেখ হাসিনা বলেন, তাদের আন্দোলনের ফসল জরুরি সরকার। সেনাসমর্থিত জরুরি ওই সরকার যেহেতু একদলীয় নির্বাচনে খালেদার আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বন্ধ করে তার সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছিলো, তাই স্বভাবতই নাখোশ ছিলেন খালেদা জিয়া, তার কাছে ‘ফুলের বাগানে সাপ’ মনে হয়েছিলো ওই সামরিক হস্তক্ষেপ।

চার বছর ধরে শেখ হাসিনার ক্ষমতার এতো সুখও তিনি সইতে পারছেন না। তার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, ওয়ান ইলেভেন না হলে, ২০০৬ সালে তার ক্ষমতা ছাড়ার পর নির্বাচন হলে; আর সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও এতোদিনে আরেক নির্বাচনে তারই তো ক্ষমতায় থাকার কথা।

পাঁচ বছরের জায়গায় জরুরি সরকারের দুই আর শেখ হাসিনার চার মিলে ছয় বছর পার হয়ে যাওয়ায় তিনি আর ধৈর্য্ ধরতে পারছেন না। যথেষ্ট হয়েছে মনে করে তিনি তাই দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকির সঙ্গে সামরিক বাহিনীকেও তার ইচ্ছায় দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন। তবে এক্ষেত্রে অধৈর্য্য বেগম জিয়া কিছুটা ধৈর্য্ ধরেছেন। সেনাবাহিনী ‘সময়মতো’ই দায়িত্ব পালন করবে বলে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগাভাগি থেকে দূরে থাকা তার নেতা ও কর্মীবাহিনী এবং গরাদের আড়ালে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের আশ্বস্ত করেছেন।

ওই যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতো খালেদা জিয়ারও মিল-মহব্বত-ইয়ার-দোস্তি দীর্ঘ দিনের। তাদের বিচার তাই তার তখত-এ-তাউশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। তবে তিনি আশায় আশায় ছিলেন, নানামুখি চাপে শেখ হাসিনার সরকার শেষ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করতে পারবে না বা করবে না।

কিন্তু গণআকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে বিচার প্রক্রিয়া যখন একটা পর্যায়ে এসেছে; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এক পলাতকসহ দুই জনের ফাঁসির আদেশ আর এক জনের যাবজ্জীবনের আদেশ হয়েছে; তখন তিনি বাইরের কারও ওপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না। আঠারো দলীয় জোটের নেত্রী হিসেবে নিজেই তাদের বাঁচানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের বিরোধীদলীয় নেত্রীর এই কথিত রাজনৈতিক লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ধর্মীয় উস্কানি। একসময় তিনি বলতেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে আযানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে।

এমন অপপ্রচারে যেহেতু বারবার কাজ হয় না, তাই এবার তিনি নতুন অস্ত্র হিসেবে বলছেন, যারা যুদ্ধারাধীদের ফাঁসি দাবি করছে তারা সবাই নাস্তিক, এই নাস্তিকদের দুধ-কলা দিয়ে পুষছে আওয়ামী লীগ। তার এই ধর্মীয় উস্কানির সঙ্গে যোগ হয়েছে সাঈদীকে মহাপূণ্যবান বানিয়ে চাঁদে দেখা যাওয়ার মতো গুজবের প্রচার।

এমনই অপপ্রচারে, মসজিদের মাইক থেকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে গত ৩ মার্চ খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়ায় তুলকালাম কা- ঘটানো হয়।

দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী: ‘বগুড়া সদর ও আশপাশের উপজেলায় ৩ মার্চ জামায়াত-শিবির তিনটি থানা, সাতটি পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদের সব দপ্তর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, গণমাধ্যমের কার্যালয়, রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ও দলীয় দপ্তরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে।
এ সহিংসতা থামাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ১৫ জন মারা যায়। বিএনপির নেতা-কর্মীরাও এসব সহিংসতায় অংশ নিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। ’

এরকম প্রেক্ষাপটে ঘটনার তিন সপ্তাহ পর বগুড়া সফরে যান বেগম খালেদা জিয়া। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে যে আদালতে, সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার কার্যক্রমের তিন বছর শেষ করার দিন বগুড়ার সমাবেশে তিনি বলেন: ‘সেনাবাহিনীরও দেশের প্রতি কর্তব্য আছে। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না। মানুষ খুন করবে আর তারা চেয়ে চেয়ে দেখবে? কাজেই সেনাবাহিনী সময়মতোই তাদের দায়িত্ব পালন করবে। ’

শাজাহানপুরে সহিংসতা এবং সেনানিবাসের পাশের থানা আক্রমণের পর মাঝিড়া সেনানিবাস থেকে রাস্তায় এসে সেনাবাহিনীর টহল দেওয়া প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন: ‘সেনাবাহিনী সেদিন এ-পর্যন্ত এসেছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীকে আমি ধন্যবাদ দেব। তারা জনগণের ওপর কোনো কিছু করে নাই। ..... সেনাবাহিনী ইউএন (জাতিসংঘ মিশনে) যায়, কাজ করে।

শান্তি রক্ষার জন্য তারা বিদেশে যায়। যেদেশের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করছে, সেদেশে যদি শান্তি না থাকে তাহলে বিদেশিরা বলবে, তারা কীভাবে শান্তি রক্ষায় কাজ করবে? কাজেই চিন্তার বিষয় আছে। আপনাদের সবাইকে এটা চিন্তা করতে হবে। ’

দায়ভার নিতে সেনাবাহিনীর আগাম অস্বীকৃতি
এই চিন্তায় চিন্তিত খালেদা জিয়ার কাছে সেনাবাহিনীর সময়মতো দায়িত্ব পালনের ব্যাখ্যা কী তা শুধু তিনিই বলতে পারবেন। তবে সেনাবাহিনীর কী দায়িত্ব ‘সময়মতো’ই তারা তা জাতিকে জানিয়ে রেখেছে। এবারতো শুধু জঙ্গিবাদী জামায়াতকে রক্ষার আহ্বান, এর আগে যখন ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকার উচ্ছেদের চেষ্টা হয়েছে তখন সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে আগের মতো রাখঢাক না করে সংবাদ সম্মেলনে তা জাতির সামনে প্রকাশ করে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থার কথা জানিয়ে রেখেছে সেনাবাহিনী।

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়: ‘গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অধীনে থেকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত হয়ে সুনির্দিষ্ট ফোর্সেস গোল ২০৩০ এর আওতায় সমর সরঞ্জাম অর্জন ও সুবিন্যস্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে গুণগত মানের উচ্চ ধাপে উঠাতে সদাব্যস্ত, তখনই ঝেড়ে ফেলা অতীত ইতিহাসের ক্রমধারায় আবারও একটি চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় অতিক্রম করছে। ’
পালিয়ে যাওয়া মেজর জিয়া, আরও দুয়েকজন মেজর এবং কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের অভ্যুত্থান চেষ্টার কথা উল্লেখ করে জানানো হয়, ‘ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা’কে ব্যবহার করে ‘সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার একটি বিফল প্রয়াস চালানো হয়। এই অপপ্রয়াসটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা হয়েছে’।

সেই প্রতিহত করার প্রক্রিয়ায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে মেজর জিয়া দুটি ই-মেইল ছড়িয়ে দেন। একে কেন্দ্র করে দু’একটি গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান জানায় সেনাবাহিনী। সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়: ‘এই বিষয়টি নিয়ে গত ০৩ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াসে পলাতক মেজর জিয়ার ইন্টারনেট বার্তাটি প্রকাশ করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ০৮ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে নিষিদ্ধঘোষিত ধর্মান্ধ “হিজবুত তাহরীর” সংগঠন পলাতক মেজর জিয়ার ইন্টারনেট প্রেরিত বার্তাটিকে ভিত্তি করে দেশব্যাপী উস্কানিমূলক লিফলেট ছড়ায়।

তার এক দিন পর গত ০৯ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে দেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলও উপরোক্ত মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও প্রচারণামূলক সংবাদের সাথে তাল মিলিয়ে সেনাবাহিনীতে “গুমের ঘটনা ঘটছে” বলে অভিযোগ করে। যা সেনাবাহিনী তথা সকল সচেতন নাগরিকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত উস্কানিমূলক বিতর্কের সৃষ্টি করে। ’

খালেদা জিয়ার বগুড়া বক্তব্যও নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে সেনাবাহিনী কোনো বক্তব্য দেবে কি না তা সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে থাকা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনীর বিষয়। তবে পলাতক মেজর জিয়ার অভ্যুত্থান চেষ্টার পর সেনাবাহিনী গত বছর সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছিলো সেখানে তাদের অবস্থান স্পষ্ট।

২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর লিখিত বক্তব্যে বলা হয়: ‘গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি গুণগত মানে সমৃদ্ধ বাহিনী হিসেবে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াসে লিপ্ত তখনই অতীতের গণতন্ত্র ধ্বংসের বিভিন্ন “অপশক্তি” দেশপ্রেমিক একটি রাষ্ট্রীয় শক্তি “সেনাবাহিনীর উপর সওয়ার হওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত।

তারা নিকট ও দূর অতীতের ন্যায় এবারও ধর্মান্ধের অনুভূতি, অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে। এই ঘৃণ্য চক্রান্তকারীদের দোসর হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন পালনে হঠাৎ অতিমাত্রায় কট্টর এবং পারিবারিক বন্ধন, চাকুরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন জঙ্গি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্ম। ’

খালেদা জিয়া এবং তার উপদেষ্টারা ‘পলাতক মেজর জিয়া ঘটনা’র পর সেনাবাহিনীর ৫ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পড়েছেন কি না জানা নেই। তবে ওই বক্তব্যে সেদিন বলা হয়েছে: ‘মুক্তিযুদ্ধের মাঝেই জন্ম নিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করা “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী”র কাঁধে ভর করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অতীতে বিভিন্ন অপশক্তি রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করেছে কিংবা ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাগতভাবে দক্ষ এবং সুশৃঙ্খল সেনা সদস্যদের বক্তব্য এই যে, “আমরা আর এ ধরনের দায়ভার আমাদের সংগঠনের কাঁধে নিতে চাই না”। ’

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই ([email protected])
বাংলাদেশ সময় ১২০১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।