ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্মরণ করছি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের

জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৩
স্মরণ করছি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের

১৯৭১ সালে প্রিয় এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য যারা নিজের জীবন, সংসার, আপনজন কোনো কিছুর পরোয়া না করে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছেন, ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়, আমরা তাদের সেদিনের সেই অবদান আজীবন কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ইতিহাস মানেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং যুদ্ধ চলাকালীন ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার ‘বীরাঙ্গনা’ নারী।



আজ এই স্বাধীনতা দিবসে আমি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করতে চাই তাদের কথা, যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ। আমি আজ লিখছি বীরাঙ্গনাদের কথা।  
 
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে যাদের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভূষিত করা হয় ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে। যদিও এখনকার প্রজন্মের অনেকেই বীরাঙ্গনা না বলে তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষপাতী। আমি আজ সেই তর্কে-বিতর্কে যাব না। আলোচনার সুবিধার্থে তাদের অফিসিয়াল বীরাঙ্গনা নাম নিয়েই লেখাটি লিখে যাব।

বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লিখতে বসে বাংলাভাষায় মুক্তিযুদ্ধের উপর তথ্য নিয়ে তৈরি উইকিপিডিয়াতে এর ব্যাখ্যা দেখে চমকে উঠলাম। উইকিতে বীরাঙ্গনার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এভাবে, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কয়েক লাখ নারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এইসব নারীদের বীরাঙ্গনা অভিধায় অভিহিত করা হয়ে থাকে। ”
 
আসলেই কি তাই? এটাই কি বীরাঙ্গনার প্রকৃত ব্যাখ্যা? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিপীড়িত ও নির্যাতিত নারী কি শুধুই পাকিস্তানি বর্বরদের কাছেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন? তাদের বীরাঙ্গনা করার পিছনে কি ঘৃণ্য রাজাকারদের অবদানের কথা আমরা বিস্মৃত হব? মাথায় টুপি, তসবি হাতে নিয়ে সব সময় আল্লাহ রাসূলের নাম নেওয়া সেসব রাজাকারদের কাছে কি তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্যাতনের শিকার হননি?

গ্রামেগঞ্জে কার বাসায় কোন বয়সী নারী আছেন সেসব খবর দেওয়া ছাড়াও জোরজবরদস্তি করে হিন্দু-মুসলিম মা-বোনদের দানবের হাতে এরাই তুলে দিয়েছিল। ধর্ষণের শিকার সেসব নারীদের আর্তনাদ তারা বন্ধ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সুরমা চোখে, তসবি জপে শুনেছিল আর পাকিদের রাতের মনোরঞ্জন নিশ্চিত করতে পেরেছিল ভেবে আল্লাহর কাছে শুকরানাও আদায় করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকারদের কাছে নারী নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯৭১ সালের ২০ জুন প্রকাশিত সানডে টাইমস-এ লেখা ‘পাকিস্তানে সঙ্ঘবদ্ধ নির্যাতন’ শিরোনামের প্রতিবেদনে।
 
সংবাদে বলা হয়, ‘হত্যা ও নির্যাতনের বাইরেও এখন রাজাকাররা তাদের অপারেশন বিস্তৃত করেছে। তারা মেয়েদের ধরে নিয়ে পতিতা বানাচ্ছে। ধরে নেওয়া তরুণীদের দিয়ে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের রাতের মনোরঞ্জনের জন্য চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা একটি ক্যাম্প বানিয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা বলে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের মধ্যে অনেকেই ফিরে আসেননি। নামকরা বাঙালি সংগীতশিল্পী ফেরদৌসীও এরকম পরিস্থিতি থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। ’
 
হায়েনাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর আমাদের সেসব মা-বোনদের কী দশা হয়েছিল তার প্রমাণ আমরা অনেকের লেখাতেই পাব।
 
ডা. এম এ হাসান লিখিত “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থে বলেছেন,

“২৬ মার্চ ১৯৭১, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ধরে আনা হয়। মেয়েরা আসা মাত্রই সৈনিকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি মহিলা এবং বালিকার পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে ধর্ষণে লিপ্ত হতে থাকে। …পাকসেনারা ধর্ষণ করেই থেকে থাকেনি, সেই মেয়েদের বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দেয়, মাংস তুলে নেয়। মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বুক, পিঠ ও কোমরের অংশ তাদের কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিন। যেসব মেয়েরা প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করত তাদের স্তন ছিড়ে ফেলা হত, যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। বহু অল্পবয়স্ক বালিকা উপর্যুপরি ধর্ষণে নিহত হন। এর পরে লাশগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দেওয়া হত। ”

এতে আরও আছে “হেড কোয়ার্টারের দুই, তিন এবং চার তলায় এই মেয়েদের রাখা হত, মোটা রডের সঙ্গে চুল বেঁধে। এসব ঝুলন্ত মেয়েদের কোমরে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা হত প্রায় নিয়মিত, কারো কারো স্তন কেটে নেয়া হত, হাসতে হাসতে যোনিপথে ঢুকিয়ে দেওয়া হত লাঠি এবং রাইফেলের নল। কোন কোন সৈনিক উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ মেয়েদের বুকে দাঁত লাগিয়ে মাংস ছিড়ে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত, কোনো মেয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তখনই হত্যা করা হত তাদের। কোনোকোনো মেয়ের সামনের দাঁত ছিল না, ঠোঁটের দু’দিকের মাংস কামড়ে ছিড়ে নেওয়া হয়েছিল, প্রতিটি মেয়ের হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে থেতলে গিয়েছিল লাঠি আর রডের পিটুনিতে। কোনো অবস্থাতেই তাদের হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হত না, অনেকেই মারা গেছেন ঝুলন্ত অবস্থায়। ”
 
মহান মুক্তিযুদ্ধে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সবদিক থেকে দুর্বিসহ কষ্ট সহ্য করেছেন আমাদের নারীরা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় দেশ স্বাধীন হওয়ার এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও সেদিনের সেই বীরাঙ্গনাদের আমরা প্রকৃত সম্মান দিয়ে বীরের মর্যাদা দিতে পারেনি। যাদের মাথা উঁচু করে আজ স্বাধীন বাংলায় চলার কথা, অথচ তারা আজ দু’বেলা খাবারের জন্য ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে অন্যের দ্বারে হাত পাতেন।

এ লজ্জা সম্ভ্রম হারানো মায়েদের নয়, এ লজ্জা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া আমাদের সবার।
 
মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম নেওয়া এই প্রজন্ম জানুক একাত্তরে সেসব নারীদের কষ্ট গাঁথা। হৃদয় দিয়ে অনুভব করুক তাঁদের নির্যাতিত হওয়ার যন্ত্রণা। ওই সময়ের সাহসী নারীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসুক আমাদের। সঠিক ইতিহাসের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের নারীদের অবদান। হানাদার আর রাজাকারদের দ্বারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার তাদের পবিত্র শরীরের প্রতিটি কোষ সেই সময় অস্ফুট ভাষায় এদেশের মুক্তি কামনা করেছিল।

যাদের কারণে দুর্বিসহ জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন আমাদের মায়েরা সেই রাজাকার নামক নর্দমার কীটগুলোর বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো সেসব বীরাঙ্গনা মায়েদের সরকারিভাবে প্রকৃত সম্মাননা প্রদান করা হোক।

বীরাঙ্গনাদের তালিকা করে তাঁদেরকেও মুক্তিযোদ্ধাদের মত প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করা হোক। বীরাঙ্গনার সন্তানেরাও যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের মতই সর্বক্ষেত্রে সুবিধাভোগ করতে পারে সরকারিভাবে সে সিদ্ধান্ত জারি করে কার্যকর করা হোক। তাদের আত্মীয় পরিজন যেন মাথা উঁচু করে বলতে পারে আমার পরিবারেও আছেন একজন মহান বীরাঙ্গনা।

আমরা যদি মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের স্বীকৃতি না দেই তবে তাদের নির্যাতিত হওয়ার সেই মুহূর্তের আর্তনাদ থেকে এই দেশ কোনোদিন মুক্তি পাবে না।

zinia-zahidজিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।