ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশের প্রয়োজন শক্তিশালী ইউনিয়ন, বিদেশি চাপ নয়

ফজলে হাসান আবেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৩
বাংলাদেশের প্রয়োজন শক্তিশালী ইউনিয়ন, বিদেশি চাপ নয়

আমার দেশ বাংলাদেশ ফের কাঁদছে। গত সপ্তাহে রাজধানী ঢাকার অদূরে দুর্বলভাবে নির্মিত একটি ভবন ধসে পড়েছে, যেখানে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল।

৩০০ জনের অধিকের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এবং চূড়ান্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

প্রাকৃতিক হোক আর মানুষের সৃষ্ট হোক উভয় বিপর্যয়ের সঙ্গে পরিচিত বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এখনও এটি আমাদের দুঃখজনক অধ্যায়গুলোর একটি কেননা এই বিয়োগাত্মক ঘটনাগুলো সহজে এড়িয়ে যাওয়া যেত। আমাদের সমাজের সবচেয়ে অবহেলিতরাই বিয়োগাত্মক ঘটনার শিকার হয়েছিল-পরিশ্রমী মানুষগুলো দুঃখের মধ্যে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করত। অনেকে পশ্চিমা ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।

প্রাকৃতিকভাগে ধনী দেশের মানুষরা এখনও বলছে কিভাবে তারা বাংলাদেশের ওপর এবং তার প্রস্তুতকারকদের কলঙ্কজনক নিরাপত্তা রেকর্ডের উন্নয়ন ঘটাতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

কিন্তু বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত পণ্যের দাম কমানো সমস্যার সমাধান হবে না যেটি করতে অনেকে পরামর্শ দিয়েছে। আমার দেশে সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব করতে পোশাক শিল্পের অর্থনৈতিক সুযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন পোশাক খাতে প্রায় ৩০ লাখ নারী কর্মরত রয়েছে।

চরম দারিদ্র্যকে দূরীভূত করতে আমি আমার জীবন নিবেদিত করেছি এবং আমি জানি বাংলাদেশি ব্র্যান্ড বয়কট করলে তা শুধু হতদরিদ্রদের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে দেবে কেননা বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো পণ্য তৈরির চুক্তি অন্য দেশের সঙ্গে করবে।

বাংলাদেশে পণ্য প্রস্তুতের পরিমাণ বাড়ার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অতীতে একটি নবজাতক মেয়ের ভব্যিষত সম্পর্কে গরিব পরিবারের চাওয়া ছিল, যতটা সম্ভব একজন যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে পারা, কেননা মেয়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে স্বামী পক্ষের পরিবারকে দেওয়া যৌতুকও বাড়ত।

১৯৮০ সালে যৌতুককে নিষিদ্ধ করা হলেও এখনও চলছে। একটি মেয়েকে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো এবং সে কখনও গ্রামে ছেড়ে যেত না, কখনও নিজের বা নিজের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সম্পর্কে জানত পারত না।

বর্তমানে পোশাকশিল্পে  অনেক কাজ করায় নারী ও তাদের মেয়েরা কাজ করায় দরিদ্র পরিবারগুলোর ভবিষ্যত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে যদিও পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার দৃশ্যতভাবে অনুপস্থিত থাকে।

বাইরের অনেকে শুধুই দুর্যোগ কথা চিন্তা করে যখন তারা কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, সাইক্লোন, বন্যা আর দারিদ্র্য-এর বাংলাদেশ শব্দটি শুনে। কিন্তু এটাও সত্য যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণের সূতিকাগার এবং শক্তিশালী সুশীল সমাজের দেশ। জীবনমানে দ্রুত উন্নতি করেছে বাংলাদেশ: প্রসবকালীন মাতৃ মৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের তুলনায় এক চতুর্থাংশ, শিশু মৃত্যুর হার ১৯৮০ সালের তুলনায় এক পঞ্চমাংশ এবং আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়েছি।

এসব অর্জন বিলীন হয়ে যাবে যদি আমরা সাভারের মতো ঘটনা অব্যাহত থাকতে দেই। ধনী-গরিব, ভূমিহীন শ্রমিক-ফ্যাক্টরির মালিক সবার জন্য অবশ্যই আইন কাজ করবে। অসহায়দের শোষণ করে যারা উপকৃত হচ্ছে তাদেরকে সহজে ছাড় দেওয়া আমাদের উচিত হবে না।

তাহলে এর সমাধান কি? এর পরিবর্তন অবশ্যই প্রথম বাংলাদেশের ভেতর থেকেই আসতে হবে। এ ধরনের মহাঝুঁকিতে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে ফেলছে তাদের বিচারের জন্য আমার দেশের প্রয়োজন হবে নতুন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। আমি ফ্যাক্টরি মালিকদের, আমারসহ সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর এবং পশ্চিমা ক্রেতাদেরসহ বেসরকারি খাতের সহায়তা চাই।

শ্রমিকদের মাধ্যমেই সমাধানের শুরু করতে হবে; নিয়োগদাতাদের অব্যশই অনুমোদন দিতে হবে তাদের সংঘবদ্ধ হতে (ইউনিয়ন করতে) যাতে তারা সমষ্টিগতভাবে দর কষাকষি করতে পারে এবং নিয়োগদাতাদের দায়িত্ব থাকবে শ্রমিকদের মানসম্মত বেতন ও নিরাপত্তা প্রদানের।

তাদের সংগঠিত শক্তিই একমাত্র হাতিয়ার যা রুখে দাঁড়াতে পারে ব্যবসায়ী মালিক ও রাজনীতিবিদদের গোপন সম্পর্কের বিরুদ্ধে। ফ্যাক্টরি মালিকদেরকে দাম কম না দিয়ে নিরাপত্তা মান বাড়ানোর জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া উচিত।

বিদেশের বাজারে এ বিষয়টি উত্থাপন করার জরুরি যে নিরাপত্তা মান বাড়ানো তত বেশি ব্যয়বহুল নয় যাকে ভোক্তাদের ওপর দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে দাড় করানো যায়। এবং যারা কাজের পরিবেশের কথা ভেবে বেদনাহত হয়েছেন তাদের উপলব্ধি করা উচিত, পণ্য কেনার মানদণ্ড প্রাইস ট্যাগের চেয়ে শ্রমিকরা কোন পরিবেশ কাজ করছে তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

একই সময় মালিকদেরও ছাড় দেওয়া উচিত নয়। তবে তাদের ওপর বিশ্বাস করা যাবে না যে তারা স্বেচ্ছায় সবকিছু করবে। পরিদর্শনকারী বাহিনীর আমূলভাবে বাড়াতে হবে এবং এটি অবশ্যই কঠোরভাবে নিরাপত্তা মান বৃদ্ধি করবে।

সরকারকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে উদাসীনতা বন্ধ করতে হবে, যদিও পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। কিন্তু এটি করা কঠিন হবে কেননা অপরাধ সংক্রান্ত উদাসীনতার দায় থেকে রেহাই দিতে নিয়োগকর্তা ও রাজনীতিবিদদের একটি অশুভ আঁতাতকারী চক্র রয়েছে।

‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ গর্বের প্রতীক, লজ্জার নয়। এমনটি করতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ। ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের শক্তি উপছে পড়েছিল, শোষণ থেকে মুক্তির ব্যাকুলতা। সেই শক্তি নিয়ে পোশাকের মতো রপ্তানি শিল্পগুলোর সঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণ, কমিউনিটি স্বাস্থ্য সেবা ও অন্যান্য সামাজিক উদ্যোগ কোটি কোটি গরিব বিশেষ করে নারীদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিয়েছে।

আমার দেশের মানুষগুলোর মতো আজ আমিও শোকাহত কিন্তু আমি বলতে চাই এটি আর চলতে দেওয়া যায় না। হতাহতের জন্য শোকহত হওয়ায় আমরা স্বাধীনতার চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করি।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান।

নিউইয়র্ক টাইস পত্রিকায় ২৯ এপ্রিল এ কলামটি প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ: শরিফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।