ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংবাদপত্র, বাক স্বাধীনতা ও তথ্য বিভ্রান্তি

শায়লা আহমেদ লোপা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৩
সংবাদপত্র, বাক স্বাধীনতা ও তথ্য বিভ্রান্তি

মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নতুন কোনো সংবাদ পেলেই তা নিয়ে কিছু দিন মাতামাতি করা। পুরোনো সংবাদ যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেনো সেটা ভুলে যাওয়া।

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো ঠিক এই কাজ করে।

প্রতিদিন নিত্য নতুন সংবাদের আড়ালে চাপা পরে যায় পুরোনো ঘটনা। নতুন যে সংবাদ আসছে আর সেটা নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। তারপর আবার নতুন কোনো গল্প অথবা পুরানো গল্পে নতুন মশলা দিয়ে ভিন্ন স্বাদে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

সব সময়ই সাংবাদিকদের প্রবণতা থাকে কীভাবে বা কত তাড়াতাড়ি বড় সাংবাদিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। বাক স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে তারা কোনোকিছু বিচার বিবেচনা না করে যা কিছু মনে আসে তাই লিখে দিচ্ছে। তাদের মনোভাব এমন ,‘আগে তো লিখি পরে দেখা যাবে’। আর এ সুযোগে তাদের পত্রিকার কাটতি আরও কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া।

আমার ধারণা বর্তমানের নিউজ পেপারের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এ কাজগুলো করছে তারা। কিছুদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকাতে ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে এমন সব কথা লেখা হলো যে দেশে প্রায় ধর্মীয় দাঙ্গা বেধে যাওয়ার উপক্রম হলো।

কিছুদিন আগে বিখ্যাত এক লেখক শাহবাগে আন্দোলনরত এক নারী কর্মীকে নিয়ে নোংরা ভাষায় একটি গল্প লিখলেন এবং দেশের জনপ্রিয় একটি দৈনিক সংবাদপত্র তা ছেপেও দিলো। যদিও পরবর্তীতে দৈনিকটি ক্ষমা চেয়েছে। আরেকটি দৈনিক তো অন্যদেশের ঘটনার ছবিকে এডিট করে আমাদের দেশের বলে দিব্যি চালিয়ে দিলো। পরবর্তীতে উসকানিমূলক লেখা ছাপার জন্য সেই পত্রিকা সরকার বন্ধ করে দিলে কিছু সাংবাদিক আবার প্রতিবাদ করলো এই বলে যে, তাদের বাক স্বাধীনতা নাকি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে ।

এরপর আসা যাক সাভারের রানা প্লাজার ঘটনায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর একটি মেয়েকে উদ্ধার করা হলো, এই সংবাদ পেয়ে গোটা দেশের মানুষ যখন আনন্দ উল্লাস করেছে ঠিক তখনই এক টেলিভিশন রিপোর্টার উদ্ধারকারী টিম ও উদ্ধারকৃত মেয়েটিকে এমন সব প্রশ্ন করা শুরু করলো যে গোটা দেশের দৃষ্টি ১৭ দিন পরে জীবিত বের হয়ে আসা মেয়েটির দিক থেকে রিপোর্টারের দিকে ঘুরে গেলো। নেতিবাচক দিক দিয়েই হোক রিপোর্টার চলে আসলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আবার সেদিন দেখালম, এক রিপোর্টার কবরের দৃশ্য দেখানোর জন্য জুতা পায়ে দিয়েই কবরে নেমে গেছেন।

গত তিন চার দিন ধরে গোটা দেশ যে খবরটা নিয়ে ফিসফাস করছে সেটি হচ্ছে ক্রিকেট। আকসু, বুকি, ফিক্সিং এ শব্দগুলো বারা উচ্চারিত হচ্ছে আমাদের সবার মুখে। আমাদের দেশের জনপ্রিয় খেলোয়াড় আশরাফুল নাকি ম্যাচ ফিক্সিং এর সঙ্গে জড়িত, তিনি নিজের মুখে তার দোষ স্বীকার করেছে।

সাধারণ মানুষ যখন এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা, সংশয়, বিশ্বাস–অবিশ্বাসের দোলাচলে, ঠিক তখনই বোমা ফাটার মতো খবর বের হলো আশারাফুল নাকি জেরার মুখে স্বীকার করেছে আমাদের জনপ্রিয় সাবেক তিন খেলোয়াড় (খালেদ মাসুদ, খালেদ মাহমুদ ও মোহাম্মদ রফিকের) তাকে বুকিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এই সংবাদটিও ছাপা হয়েছে সেই জনপ্রিয় দৈনিকে। যেখানে ছাপা হয়েছিলো শাহবাগের নারী কর্মীকে নিয়ে নোংরা একটি গল্প।

যা হোক, গত চার/পাঁচ  দিন ধরে ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং এর সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকাতে খবর ছাপা হচ্ছে ছবিসমেত।

একবার একটা খবর শুনেছিলাম মাশরাফিকে নাকি কোন বুকি কি বলেছিল, সঙ্গে সঙ্গে মাশরাফি তার ম্যানেজমেনটকে জানিয়েছে। তাহলে আশরাফুল জানালো না কেন? কারণ আশরাফুল বুকিদের সঙ্গে জড়িয়েছে নিজের ইচ্ছায়।

যে কাজটা মাশরাফি প্রত্যাখ্যান করেছে আশরাফুল সেটা করে ফেলেছে, এজন্য কে কার সঙ্গে, কাকে পরিচয় করিয়ে দিলো তার কি সম্পর্ক থাকতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে আশরাফুলের টাকা কামানোর জন্য পাইলট, রফিক, সুজন একেবারে অস্থির হয়ে গেছে, একেবারেই  হাস্যকর এবং অগ্রহণযোগ্য।

শুক্রবার যেভাবে খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল তাতে আমরা ওই সাবেক তিন খেলোয়াড়কে এক ধাক্কায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। আজকে একটা খবরের কাগজে দেখলাম আকসু তদন্ত করতে গিয়ে রফিক ও পাইলটের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি,আকসু নাকি রেকর্ড পেয়েছে সুজন ঢাকা-চট্টগ্রাম ম্যাচের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে বলেছিলেন—আজ আমরা জিতব ( তথ্য সূত্র – ইত্তেফাক ) কিন্তু এতে কি প্রমাণ হয়?

সুজন চিটাগাং কিংসের কোচ। একজন কোচ হিসেবে সে তার খেলোয়ারদের তো পজিটিভ কিছু বলতেই পারে। এটা তো সাধারণ কথা যে, ‘আজ আমরা জিতবো , আমাদের জিততেই হবে , জয় নিশ্চিত ইত্যাদি ইত্যাদি। সব চাইতে যেটা হাস্যকর খালেদ মাহমুদ সুজন যদি ম্যাচ পাতিয়েই থাকেন তাহলে সে কি প্রকাশ্যে নাস্তার টেবিলে সেটা বয়ান করবে!

আমাদের দেশে এই একটা মাত্র ক্ষেত্র বা জায়গা যেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। দল-মত, জতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমরা এক জায়গায় এসে মিলিত হই এই ক্রিকেট দিয়ে। আমাদের ক্রিকেট প্রেম গোটা বিশ্বের আলোচনার বিষয়। আর ক্রিকেটকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য আমাদের সাবেক–বর্তমান খেলোয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। আমরা সবাই আমাদের খেলোয়াড়দের বিশ্বাস করি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই।

আমরা আশা করবো খুব দ্রুত এই ঘটনার তদন্ত হোক, এবং দোষী শাস্তি পাক। কিন্তু কোনো কিছু প্রমাণ না হওয়ার আগেই শুধুমাত্র হাওয়ার ভরে কোনো খবর ছেপে দেওয়া একেবারেই কাম্য নয়।

বস্তুনিষ্ঠ খবর আমরা সবাই আশা করি। একটা মানুষের তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্মান এক নিমিষে গুড়িয়ে দেওয়ার আগে আমাদের সাংবাদিকদের হাজারবার সেই খবরের সত্যতা সম্পর্কে যাচাই বাছাই করে নেওয়া উচিত। নয়তো কিছু সাংবাদিকের জন্য এই মাধ্যম নিয়েও অনেক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। তবে এর মানে এই নয় যে দেশে ভাল ও গুণী সাংবাদিকের অভাব রয়েছে। বস্তুত তাদের জন্যই আমরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাই।

আশা থাকবে, আমাদের ক্রিকেটারদের ওপরে লাগানো কালিমা মুছে যাক। ক্রিকেট আমাদের গর্বের জায়গা, সেই জায়গাটা থাকুক পবিত্র, কালিমামুক্ত। যদি কেউ দোষ করে থাকে সে অবশ্যই শাস্তি পাক।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।