ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আত্মোপলব্ধি প্রয়োজন

শাহরিয়ার পাভেল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫১ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৩
আত্মোপলব্ধি প্রয়োজন

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে চার নতুন নগরপিতার আবির্ভাব হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, চাররজনই বিরোধীদল থেকে এসেছেন।



সরকারি দলের এমন পরাজয়ে সবাই বেশ বিস্ময় প্রকাশ করছেন। কিন্তু, বিস্ময়টি কেন? জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন না হওয়ায়, নাকি সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীদের পরাজয়ে?

বস্তুত, বাংলাদেশের কোনো সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনে এর আগে ক্ষমতাসীনদের এমন গণহারে পরাজয় জাতি দেখেনি। এবারই প্রথমবারের মতো শতভাগ ব্যর্থতা দেখা গেলো। আরো মজার বিষয়, নির্বাচনের আগে আগে অনেকেই বলাবলি করছিলেন, সরকারের হুট করে চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দেওয়ার উদ্দেশ্য নাকি নগরগুলো দখলে রাখা, যাতে পরবর্তীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় না আসলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হয়।

এ ধরনের আগাম ধারণার পেছনে অবশ্য নিম্নোক্ত দু’টির যেকোনো একটি কারণ থাকতে পারে -
১। সরকার যেকোনো মূল্যে পছন্দের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করবে
২। সরকারের জনপ্রিয়তা এখন যেরকম আছে, তাতে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয় নিশ্চিত ধরে নেওয়া

কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম করার ঝুঁকি অন্তত এই সময়ে নেওয়ার কথা নয়, বিশেষ করে বিরোধী দল যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার। তাই, সরকারের জনপ্রিয়তার প্রতি হয়ত অনেক বিশ্লেষকের আস্থা ছিল।

অথচ নির্বাচনের ফলাফলে তাদের অনুমান প্রতিফলিত না হওয়ায় এখন নতুন আরেকটি বিষয় বেশ চাউর হয়েছে - সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বিরোধীদলের প্রার্থীদের জয়ী করেছে। নিজেদের মনোনীত প্রার্থীদের এহেন বলিদানের(!) পেছনে যুক্তিটি হচ্ছে, বিরোধী দলের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে অগ্রাহ্য করে দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনটি করিয়ে নেওয়ার ভিত্তি শক্ত করা। নির্বাচনোত্তর এমন বিশ্লেষণও উপরে উল্লেখিত দ্বিতীয় কারণকেই জোরালো করে। অর্থাৎ সরকার এতই জনপ্রিয় যে তাদের প্রার্থীর পরাজয়ে জনগণের মতের প্রতিফলন নয়। বরং অন্য কোনো ষড়যন্ত্রই মূখ্য। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? সরকার কী আসলেই এখনও জনপ্রিয়?

গত বছরের শেষ নাগাদ, এমন কি এ বছরের শুরুতেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান মহাজোট সরকারের মহা ভরাডুবির কথাই আকাশে-বাতাসে ভাসছিল। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে জেগে উঠা তারুণ্য আর দেশব্যপী নজিরবিহীন গণজাগরণে সরকার প্রায় একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ায়। জামায়াত-শিবির তথা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর দায়ে বিএনপি ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে। আগামী নির্বাচনে জয় দূরে থাক, রাজপথে বিএনপির কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে জনসম্পৃক্ততাও ছিল আশাতীত। কার্যত বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।

এমন একটি অবস্থায় রাজনৈতিকভাবে সরকার বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় চলে আসে। বিএনপির একের পর এক ষড়যন্ত্র তাই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তারা মোকাবেলা করতে সমর্থ হয়। এছাড়াও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার দলীয় মনোনীত প্রার্থীরা সবাই নির্বাচিত মেয়র ছিলেন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ শহরে বেশ কিছু ভাল কাজ করেছেন বলে প্রচার রয়েছে। ফলে প্রার্থীসহ সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলে জানা যায়।

কিন্তু সরকার গণজাগরণ মঞ্চের চেতনার লালন করবে নাকি হেফাজতীদের হেফাজতে মনোযোগী হবে - এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়। অপরপক্ষে সরকারের দমন-পীড়নে বিরোধীদলের সাংগঠনিক অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, দলের মুখপাত্র নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়াটা কেবল বাকি ছিল। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে প্রকৃত অবস্থা বুঝে উঠা সত্যি কঠিন।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক থেকে শুরু করে ডেসটিনি কারসাজি, পদ্মাসেতুর স্বপ্নভঙ্গ, দলীয় বিবেচনায় শাস্তিপ্রাপ্তদের শাস্তি মওকুফ ও শাস্তিযোগ্য সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় না আনা ইত্যদি নানান বিষয়ে দেশের মানুষের সীমাহীন ক্ষোভ জানানোর মাধ্যম তো একটাই - নির্বাচন। তার উপর দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কর্তৃক ভোটের মাঠে প্রচুর অর্থ লেনদেনের কথা শোনা যাচ্ছে। এসব মিলিয়ে সিটি করপোরশনের নির্বাচনে ফলাফল সরকারের বিপক্ষে গেছে। বলা যায়, চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে স্থানীয় নয়, বরং জাতীয় বিবেচনায় জনগণ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী এই নির্বাচনের ফলাফল সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা।

এখন এই সতর্ক সংকেতকে আমলে নিয়ে সরকারি দল কতটুকু কি করতে পারে, তাই দেখার বিষয়। সময় যদিও ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, তারপরও সরকারের উচিত জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কার্যকর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসরদের ইসলাম কার্ডের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার কাজটিও এই সরকারকেই করতে হবে এবং যারা এ কাজে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসতে চায়, তাদের কূটকৌশলে দমন না করে আস্থায় আনতে হবে। নইলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আরো একবার লাঞ্ছিত হবে, বাংলাদেশ আবার পেছনে হাঁটবে। কেননা, এ কথা কারো অজানা নয় যে জনগণের কাছে আর বিশেষ কোনো পছন্দ অবশিষ্ট নেই।

বর্তমান সরকারের ব্যর্থতায় অবধারিতভাবে জনগণকে জামায়াত-বিএনপি নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোটে আস্থা রাখতে হবে, যার প্রমাণ অতীতে পেয়েছি, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও পেলাম। অথচ জামায়াত-বিএনপি জোট ইতোপূর্বে ক্ষমতায় এসে যে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে তারও নজির মেলা ভার।

উপরন্তু, স্বাধীনতার সুদীর্ঘকাল পর জাতির কলঙ্কমোচনে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা জামায়াত-বিএনপি জোটের কাছে মোটেও নিরাপদ নয়। জামায়াত-বিএনপি এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ তো করবেই, বরং অভিযোগ প্রমাণিত অনেক যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে পারে এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো আরো অনেক দেশদরদী, স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী আত্মত্যাগীদের সীমাহীন অপমানে জর্জরিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।

তাই এরকম একটি ভয়ানক পরিস্থিতি এড়াতে জনগণ ও সরকার উভয়কেই সচেতন হতে হবে যেখানে সরকারের ভূমিকাই কার্যত মূখ্য।

লেখক: সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৬ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।