ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গ্রামীণ ব্যাংক-ব্র্যাক কতটা নারীর ক্ষমতায়ন বান্ধব?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৬ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৩
গ্রামীণ ব্যাংক-ব্র্যাক কতটা নারীর ক্ষমতায়ন বান্ধব?

নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে কাজ শুরু করা ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা এ ধরনের দেশীয় ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থাগুলো আসলে কতটা নারীর ক্ষমতায়ন বান্ধব?  এ প্রশ্নটা তোলার এখনই উপযুক্ত সময়।

ক্ষমতায়ন মানে কি? নারী তার পরিবারে সব ব্যাপারে মতামত দেবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে- মোটা দাগে এই হলো ক্ষমতায়নের মূল কথা।

আরো অনেকগুলো বিবেচ্য বিষয়তো আছেই। সেদিকে যাচ্ছি না, সীমাবদ্ধ থাকছি মতামত দেওয়া ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা- এই দুই জায়গাতেই।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে কাজ করার মহৎ উদ্যোগ নিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গোড়ার দিকে নারীদের ক্ষমতায়ন করতে চাইলেন তারা। ভাবলেন, কাজ করতে হবে পরিবার নিয়ে। তাও নারী নিয়ে। মেয়েরা যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, তাহলে সংসারে তার কদর বাড়বে, মর্যাদা বাড়বে, বাড়বে গুরুত্ব। সে কারণেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া দরকার বলে মনে করলেন তারা। আর এ অর্থই নারীদের স্বাবলম্বী করবে, হবে নারীর যথাযথ মূল্যায়ন, ক্ষমতায়ন।

এই চিন্তা থেকেই এলাকা র্নিধারণ, পরিবার নির্ধারণ ও তাদের প্রয়োজনও নির্ধারণ করলো প্রতিষ্ঠানগুলি। টাকা দরকার এমন কিছু নারীকে চিহ্নিত করলেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। গেলেন তাদের কাছে, বোঝালেন নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ কি। কত অবহেলিত তারা। কেবল টাকাই পারে তাদের এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে। সংসারে নারীর মূল্য বাড়াতে ‘টাকা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠলো বাধ্যতামূলকভাবে।

কিন্তু নারী কেন পছন্দ করলেন প্রতিষ্ঠানগুলো। এরও কারণ আছে, যা তারা কোনো সমিতির মিটিংয়ে বলেন না, কিন্তু বলেন কর্মী সভায়। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বলেন, পুরুষের নামে টাকা দিলে সেটা আদায় করা কঠিন। যে বাইরে, বাইরে থাকবে। কিন্তু নারীদের বাড়িতেই পাওয়া যাবে। তাই টার্গেটেড গ্রুপ হলো নারী।

ব্যবসায়িক এই হিসাব তো আর নারীদের বলা ঠিক হবে না, তাই বলতে হবে ক্ষমতায়নের কথা। বোঝাতে হবে নারীর গুরুত্বের কথা। পরিবেশনটাই আসল। আর এ পরিবেশনের দায়িত্ব দিলেন নারীদেরকেই। নারীদের মুখেই নারীদের উন্নয়ন, ক্ষমতায়নের কথাটা বেশ পরিবেশন যোগ্য। যদিও ক্ষমতায়নের পুথি পরিবেশনকারী সেসব নারীদের শোষণকাব্য ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে আলোচনা হবে অন্যদিন।

যা বলছিলাম, একইভাবে গ্রামের মহাজনরাও টাকা দিতো। অবশ্য মহাজনরা তখনও নারীকে কেন্দ্র করে তাদের মহাজনী ব্যবসা করার কথা চিন্তাও করেননি। বলা চলে নারীকে লেনদেনের যোগ্যই মনে করতেন না মহাজনরা। বরং লেনদেনে কখনও কখনও নারীকেই পণ্য করে তুলতেন মহাজনরা। আরও একটা বড় পার্থক্য মহাজনী ব্যবসা আর ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে। সেটা হলো, কখনই মহাজনরা জোর করে টাকা ধার দিতেন না। কেউ প্রয়োজনে পড়ে তাদের কাছে গেলে তবেই তারা সুদের কথা বলে টাকা দিত।

পক্ষান্তরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে ঋণদানকারী বেসরকারি সংস্থাগুলো নিজেরাই এলাকা বাছাই, প্রয়োজনীয়তা বাছাই এবং সুদের হার বাছাই করেন। কোনো নারীকে প্রথম পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ঋণ শুরু করলে সে আরও বেশি ঋণী হয়ে যান। পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ঘরের টিন, লোটা, বাটি-ঘটি বিক্রি করেও শোধ হয় না সে ঋণ। আত্মমর্যাদা কিংবা সামাজিক মর্যাদা তো দ‍ূরের কথা। কখনও কখনও মৃত্যুই হয় তাদের করুণ পরিণতি।

অথচ যাদের উন্নয়নের কথা বলে, যাদের ক্ষমতায়নের কথা বলে উৎপত্তি, তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি না হলেও সেসব সংস্থা আজ মহীরুহ। ঢাকার বুকে গড়ে ওঠা ছোট একটি কার্যালয় এখন বিরাট ভবন। বুক ঠুকে জানান দেয়, আমি নারীর ক্ষমতায়নের রক্তে মাংসে গড়া ইট-পাথরের দেয়াল। চিৎকার করে বলে, তোমাদের ক্ষমতায়নের জন্যই আমি আজ বিশাল অট্টালিকা। সেসব দালানের গেটেও এখন প্রবেশ করতে পারেনা প্রান্তিকের সেইসব তথাকথিত ‘ক্ষমতায়িত’ নারীরা।

কার লাভ কার ক্ষতি সে বিবেচনার ভার তো আমজনতার। এটা সবাই জানেন, বোঝেন কিন্তু কেউ কথা বলেন না। কারণ একটাই- কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তো হয়েছে, তাতেই তৃপ্ত তারা।

প্রান্তিক নারীদের ক্ষমতায়নে আসলে কি টাকাটাই মুখ্য, নাকি অন্য কিছু। কিংবা অর্থই সব অনর্থের মূল, বিতর্কিত সে প্রশ্নেও যাব না। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের নাম করে শুরু হওয়া ছোট ছোট সংগঠনের আজকের এই উত্থান কতটা নারীর ক্ষমতায়ন বান্ধব সে বিবেচনার ভারও রাখছি আমজনতার উপরই।

সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো পরিবর্তনে সরকারের কোনো ইচ্ছা নেই জানিয়ে সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পদত্যাগের পর গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্যারান্টি নিয়ে বিদেশি ঋণে সামাজিক বিনিয়োগ ইস্যুতে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মধ্যে গ্রামীণফোন অন্যতম। এ থেকে ড. ইউনূস এ পর্যন্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘ডিভিডেন্ট’ পেয়েছেন। অথচ এ টাকা গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহকদের পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এক টাকাও তারা পায়নি বলে অভিযোগ করেন মন্ত্রী।

ব্যাংকের একজন পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই লভ্যাংশ যদি গ্রাহকদের দেওয়া হতো, তাহলে বাংলাদেশে দারিদ্র্য থাকত না। এ বিষয়গুলোর তদন্ত চলবে বলেও সংসদে জানান অর্থমন্ত্রী।

এটাই আশার কথা। দেরিতে হলেও যদি নারী তার প্রাপ্য অধিকার পান তা হলেও সান্ত্বনা। একজন থেকে শুরু হওয়া নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পে যখন যোগ দেয় ৮৪ লাখ নারী, তখন তার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সংকট তো দেখা দেওয়ার কথা না। তারপরও কেন এত সংকট, কেন এত বিড়ম্বনা, কেন এত নির্যাতন-লাঞ্ছনা-বঞ্চনা?

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি দেশে কাজ করা দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর ভূমিকাই বা কি! কি করলেন এতদিন তারা? তারা কি বলতে পারবেন দেশের নারীরা কতটা ক্ষমতায়িত! কিংবা আদৌ নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে কি না?

লেখক: সাজেদা হক
সহকারী বার্তা সম্পাদক
বৈশাখী মিডিয়া লিমিটেড।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।