ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মুক্তিযুদ্ধের গাছে ধর্মান্ধতার ফল

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৩
মুক্তিযুদ্ধের গাছে ধর্মান্ধতার ফল

সিডনি থেকে: আমাদের গর্বের জায়গাগুলো এখন আক্রান্ত। আমাদের দেশের তারুণ্যকে আমরা চেতনা ও আদর্শের প্রতীক মনে করলেও আজ আর তা সঠিক কিছু নয়।

রাজনৈতিক মতাদর্শে তফাত থাকলেই যে নিন্দা করব তেমন নয়, আসলে আন্দালিব রহমান পার্থের মত তরুণরাই আজ আমাদের দেশের হিরো্। ‌ হঠাৎ ঝলসে ওঠা পার্থ ও আওয়ামী লীগে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে খ্যাতি পাওয়া গোলাম মাওলা রনিদের কাছে ইমরানরা ফুটো বেলুনের মত মিইয়ে পড়েছেন। যেমনটি মিইয়ে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন।

 এই লেখা যখন লিখছি শাহবাগে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের গালে জুতা মারার স্লোগান দেয়া হয়েছে। জুতা মারা আর মারতে চাওয়ার ভেতর খুব বেশি তফাৎ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। যেভাবে চলছে তাতে আগামী নির্বাচনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন কোথায় গিয়ে পালাবেন তার একটা হিসাব নিকাশ করে ফেলাটাও বোধ করি অমূলক হবে না।

এই যে ঘুরে যাওয়া বাস্তবতা এটা কি আসলে অপ্রত্যাশিত কিছু? আমাদের বয়স কম কিছু নয়। পঁচাত্তর পরর্বতী রাজনীতির উত্থা-পতন দেখে বড় হওয়া  আমাদের জন্য এটা বড় এক আঘাত হলেও চমক কিছু নেই এতে। বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী সব সময় দেশ ও জাতির আগে আগে চলতে ভালোবাসেন।

এরা কিতাব পুস্তকের ভাষায় কথা বলেন, টিভির পর্দা কাঁপাতে জানেন, কথায় কথায় এদেশে এর-ওর ঠাঁই নেই বলে ফাল পাড়েন। অথচ এরা কাজের বেলায় ঠুঁটো জগন্নাথ।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা প্রাণ গেলেও মাঠ ছেড়ে যান না। গোলাম আযম আর কাদের সিদ্দিকী-- এ দু’জনকে দেখুন। আমাদের রাজনীতির বিপরীতে থাকলেও গোলাম আযমের নীতি-কৌশলের প্রশংসা না করে উপায় নেই। ফাঁসি থেকে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে ও তিনি তাঁর ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত কিছু নন। বরং এখনো বলছেন, যা করেছিলেন ঠিকই করেছিলেন। মানবতাবিরোধী ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যার সাথে থাকার পরও তিনি আছেন তাঁর নিজের মতে অটল।

অন্যদিকে ‘বঙ্গবীর’ উপাধি নিয়ে গলায় গামছা জড়ানো মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকে দেখুন। কে বলবে ইনি বছরের পর বছর পশ্চিমবঙ্গে থেকে এসেছেন? ভারতপ্রেম আর ভারতে থেকে দেশে যুদ্ধ চালানোর হঠকারী সিদ্বান্ত নেয়া এই মানুষটির ভাষা-ভাব-আচরণ সবই আজ অনাধুনিক আর প্রগতিবিরোধী। কথায় কথায় ‘হাজির-নাজির’ জাতীয় শব্দ বলেন আর জামাতের পদলেহন করে প্রমাণ করতে চান তিনি কত বড় ধার্মিক। কে বলবে এই মানুষটি রেসকোর্সে বেয়নেট চার্জ করে রাজাকার হত্যা করেছিল? তাজউদ্দীন আহমেদ না থাকলে তার জন্য আমাদের সদ্যপ্রাপ্ত বিজয় পড়তো বড় ধরণের বিপদে।   মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর বদলে যাওয়া চেহারা আমাকে বলে দেয়, একাত্তরে কোথাও বড় ভুল ছিল।

এই ভুলগুলো নির্ণয় করা খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু আমরা লজ্জাবশত বলি না। মূলত: ভারতীয় সৈন্যদের কাছে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ মুসলিম লীগ আদলের চরিত্রের বাঙালির ভালো লাগে নি। ভালো লাগেনি সর্ব ধর্মের মর্যাদা দেয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিষবৎ তা হজম করলেও আজ তা সুদে মূলে বের করার চেষ্টায় মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মূলত: এক অতীত। সন্দেহ নেই এর দায় নিতে হবে আওয়ামী লীগারদেরই। আমি চটৃগ্রামের মানুষ। আমাদের এলাকায় একজন বিএনপি নেতাও  আওয়ামী লীগের মত পোশাকে মুসলিম লীগের আকৃতি ধারণ করেন নি। আল নোমান, মির নাসির বা আমীর খসরু সবাই সুদর্শন ও স্যুটেড বুটেড। অন্যদিকে, মহিউদ্দীন চৌধুরী পুরাদস্তুর টুপি আর দাড়িতে একাকার। খোরশেদ আলম সুজনকে চেনার তরিকাই তার ধর্মীয় তিলক। ধর্ম বা ধর্মীয় পোশাক সম্মানের। কিন্তু বিষয়টা মানুষ নিতে পারছে না। তাই আধুনিক বেশধারী বিএনপির নেতাদেরই আপন মনে করছে। আওয়ামী নেতারা তাদের পোশাক, আচরণ আর নীতির বিপরীতে না পারছেন আস্থা কুড়াতে, না পারছেন নিজেরাই স্বস্তিতে থাকতে।

এভাবে আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে দেশের প্রগতির বারোটা বাজিয়ে এখন রনিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পার‍্ছে না। সে দল কি করে মুক্তিযুদ্ধের হেফাজত করবে? তাই আমাদের উচিৎ হবে হেফাজতের কাছে ধর্না দেয়া। তাদের মার্জনা আর করুণা নিয়ে দেশ ও জাতিকে অন্তত কিছুটা হলেও শান্তি দেয়া।

যে যাই বলুক মুক্তিযুদ্ধ প্রগতি ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে লড়াই হওয়া সত্ত্বেও তাতে ধর্মান্ধতার ফল কেন ধরলো? এ প্রশ্নের জবাব পাবার আগে মুক্তি মিলবে বলে মনে হচছে না। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, একদিন মুখে আল্পনা এঁকে গালে পতাকা এঁকে খালি পায়ে ঘুরে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল গীতি গাইলেই প্রগতিশীল হওয়া যায় না। এ সারাজীবনের সাধনার বিষয়।     

বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৩
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।