ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রিপোর্টার, তোমার সীমান্ত কোথায়?

তুষার আবদুল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৩
রিপোর্টার, তোমার সীমান্ত কোথায়?

রিপোর্টারের কাজের সীমানায় কাঁটাতার তোলা হয়নি। খবরের যারা ভোক্তা সেই পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের জন্য রিপোর্টার যে কোনো উপায়েই হোক খবর তুলে নিয়ে আসবেন।

কিন্তু এই যে বলা হলো যে কোনো উপায়, সেখানেও একটা সীমারেখা টানা আছে। সেই রেখাটি হচ্ছে নৈতিকতা। কখনো কখনো তার নাম পাল্টে হয়ে যায় বিশ্বস্ততা। যে খবরটি প্রকাশ করে বা যে উপায়ে সংগ্রহ করা হচ্ছে খবরটি, তাতে রিপোর্টার তার ভোক্তা এবং যার কাছ থেকে খবরটি নেয়া হলো, তার যেকোন একটি পক্ষের কাছে বিশ্বস্ততা হারানোর আশংকা থাকলে রিপোর্টটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ রিপোর্টারকে ঐ প্রান্তে এসে থামতে হবে। মুশকিল হচ্ছে, আমরা যারা খবরের ফেরিওয়ালা বা টোকাই, তাদের অনেকেই থামতে ভুলে গেছি। আমরা ভেবে নিই, রিপোর্টার হিসেবে অসীম সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সব মুক্তোই ঘরে তুলে আনতে পারি, এবং করতে পারি তার প্রদর্শনী। কিন্তু একজন রিপোর্টারের কাছে সকল খবরই আসবে। কোন খবরকেই তিনি অগ্রাহ্য করবেন না। কিন্তু যখন সেই খবর ভোক্তা’র পাতে তুলে দেবেন, তখন ভেবে দেখবেন এই খবরটি ভোক্তার থালায় মুক্ত হবার পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কিনা। একই ভাবে রিপোর্টারকে আস্থা’য় এনে, তাকে বিশ্বাস করে অনেকেই অনেক খবর দিতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সব খবর প্রকাশের জন্য তিনি হয়তো বলছেন না। তাই কোন খবরটি  তিনি প্রকাশের জন্য বলছেন, সেটা রিপোর্টারকে বুঝতে হবে। যদি কোনো সংশয় থাকে তাহলে খবরটি যিনি দিচ্ছেন, তার কাছে খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করেও নেয়া যেতে পারে।
 
খবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে রিপোর্টারকে গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়। এটা সাংবাদিকতার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং স্বীকৃত উপায়। কোনো অপরাধী বা এমন কোনো ব্যক্তি’র বক্তব্য গোপনে ধারন করতে হয়, যেটা তিনি স্বাভাবিক ভাবে দিতে রাজি হবেন না। এই গোপনে ধারণ করা ছবি বা বক্তব্যের সবই যে প্রকাশের জন্য তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো রিপোর্টারের হাতে খবরটির যথার্থতা প্রমাণের জন্য ঐ গোপন বক্তব্য নিয়ে রাখতে হয়। কখনো এমন ঘটনাও ঘটে যে খুবই সাধারণ একটা বিষয় যেমন- ঈদে বাড়ি ফেরার টিকিট কবে থেকে দেয়া শুরু হবে বা আজ লোডশেডিং কতো? এই জাতীয় কথাও অনেকে সাদামাটাভাবে বলতে রাজী হন না অজানা ভয়ে। সেইক্ষেত্রে রিপোর্টার কখনো-সখনো গোপনে বক্তব্য ধারণ করে প্রচার করেন। যেহেতু খবরের দিক থেকে এর তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা থাকে না, তাই একে প্রশ্রয়ও দেয়া হয়।

আবার এমন ঘটনারও রিপোর্টারের প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয়, সেটা হচ্ছে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ আর ‘অন দ্য রেকর্ড’। যার বক্তব্য নেয়া হচ্ছে তিনি রিপোর্টারের সঙ্গে অনেক কথাই বলতে পারেন, যা তিনি প্রকাশ করতে রাজি নন। এ পর্যায়ে প্রায় রিপোর্টারের প্রতি অনুরোধ আসে- রেকর্ডার বা ক্যামেরা অফ করার। অফ হলো কিনা তা নিয়ে সাক্ষাৎকারদাতা অস্বস্তিতেও থাকেন। তাই রিপোর্টারকে নিশ্চিত করতে হয় কথা রেকর্ড হচ্ছে না। তখন সাক্ষাৎকারদাতা একটু খোলাখুলিভাবে কথা বলতে শুরু করেন। এই অংশটি প্রকাশ করার অনুমতি না পাওয়া গেলেও, আমার কাছে অন দ্য রেকর্ডের চেয়ে অফ দ্য রেকর্ড অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কারণ এই অংশটি থেকে যে ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য নেয়া হলো, ঐ ঘটনার পটভূমি এবং আগামীতে কি ঘটতে যাচ্ছে সেই সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা বা আভাস পাওয়া যায়।

দ্বিতীয়ত, ঐ বিষয়টির বাইরেও অনেক খবরের উৎসের সন্ধান মেলে। এবং তৃতীয়ত হচ্ছে ঐ যে তিনি অফ দ্য রেকর্ড যা বলেছেন, তা প্রকাশ না করে রিপোর্টার ঐ ব্যক্তি’র বিশ্বস্ততা অর্জন করলো। যেটা তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও সহায়ক। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই-যখন রিপোর্টার তাৎক্ষণিক বাহবা পেতে ঐ অফ দ্য রেকর্ড কথাগুলো প্রকাশ করে ফেলেন। দেখা যায়, রিপোর্টার কৌশলে ক্যামেরার অ্যাংগেল ঘুরিয়ে দিয়ে বা অন্য উপায়ে বক্তব্যটি ধারণ করেই ফেলেছিলেন। এবং ঐভাবে নেয়া বক্তব্যটিও বাজারে বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো বা ঘটিয়েছে। কিন্তু এতে রিপোর্টার ঐ তাৎক্ষণিক বাহবা পাবেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যার বক্তব্যটি প্রচার করছেন তার কাছে বিশ্বস্ততা হারাবেন চিরকালের জন্য। এবং একটি পর্যায়ে যখন তিনি বারবার এভাবে বিশ্বাস ভঙ্গের নিদর্শন রাখবেন, তখন পাঠক, শ্রোতা, দর্শকও আর তার প্রতি আস্থা রাখতে পারবেন না।
 
প্রসংগটি আলোচনায় এলো আমার এক অগ্রজ সহকর্মী নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকালে সাক্ষাৎকার নেবার পর তাঁর অফ দ্য রেকর্ড বক্তব্য গোপনে রেকর্ড করার কারণে। তিনি প্রধানমন্ত্রী’র বক্তব্যের অফ দ্য রেকর্ড বক্তব্যের অংশটি তাঁর অনুমতি না নিয়েই গ্রহণ করেছেন। যাই হোক বিষয়টটি আঁচ করতে পেরে, ধারণ করা টেপটি নিয়ে নেয়া হয়েছে অগ্রজ ঐ সহকর্মীর কাছ থেকে। হয়তো প্রধানমন্ত্রী অফ দ্য রেকর্ডে অনেক কথাই বলেছেন যা প্রকাশ পেলে তিনি বা সরকার হয়তো বিব্রত হতে পারতো। আমার সেই অগ্রজ সহকর্মী ভুলে গিয়েছিলেন কোথায় তার থেমে যাওয়া দরকার। তিনি এর আগেও এমন অনেক ঘটনা’র অবতারণা করেছিলেন। গণমাধ্যমে এসব আলোচিতও হয়েছে। স্বস্তা বাহবা পাওয়া বা আদায়ের হয়তো নেশা থাকতে পারে তার। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী’র সংগেও তিনি একই কৌশল অবলম্বন করবেন খবর সংগ্রহে, একজন জ্যেষ্ঠ্ রিপোর্টার দিব্যি ভুলে যাবেন কোথায় তার এক্সক্লুসিভ খোঁজার সীমান্ত?
 
লেখক: বার্তাপ্রধান, সময় টেলিভিশন
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৩
এডিএ/জেএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।