ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একদিন প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভেতরে

জারা খান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৪
একদিন প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভেতরে

সামনের দরজা হাটখোলা হয়ে রয়েছে। প্রবেশ পথে কোন বাধা নেই।

ভেতরে একজন সোফায় বসে, কানে হেডফোন লাগিয়ে দেশে নিকট কারো সঙ্গে বেশ উচ্চগ্রামে কথা বলছেন। আমাদের দেখে তার মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। প্রথম পর্যায়ে গলার স্বর একটু নামালেও পরবর্তীতে অপরপ্রান্তের অসুবিধার কথা ভেবে স্বাভাবিকভাবেই চড়িয়ে দিলেন গলার আওয়াজ।

ভেতরে প্রবেশ করেই আমার সঙ্গী নাক সিটকালেন। দর্শনার্থীদের বসার জন্য কয়েকটি চেয়ার এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঝের কার্পেটে ময়লার স্তর জমে আছে। দেয়ালে নিতান্ত অবহেলায় ঝুলছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ ছবি। দেয়ালে রাখা জতির জনকের ছবিটি যেন রাখতে হয় জন্যই রাখা হয়েছে। জাতির জনকের পরিচিতিমূলক কোন লেখা ফরাসী বিংবা খোদ বাংলায়ও নাই। বাংলায় লেখা রয়েছে দূতাবাসের সময় সূচি। রয়েছে একটি শোকেস, যেখানে বাংলাদেশি পণ্যের প্রদর্শনী হওয়ার কথা, সেখানে অত্যন্ত নিম্নমানের কিছু জুতো এবং চটের বস্তা নিজেদের গৌরবের স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। একমাত্র টেবিলটিরও জীর্ণদশা। এক কথায় নিজেদের দৈন্যতার অপূর্ব প্রদর্শনী চারিদিকে।

সঙ্গী নেলি পেশায় শিক্ষক। বাংলাদেশে যাবেন বেড়াতে। তাই ভিসা সংক্রাস্ত তথ্যের জন্য এসেছেন। আমাকে নেয়া হয়েছে অনুবাদে সহায়তার জন্য। গত ৩ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটায় ফ্রান্সস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে নেলি গিয়েছিলেন ভিসা আবেদনের জন্য। সেখানে বিশ মিনিট একটানা দাঁড়িয়ে থাকার পরও অফিসের দায়িত্বশীল কাউকে দেখা যায়নি। হেডফোন কানে লাগানো সে ভদ্রলোক অবিরাম কথা বলে চলছেন।

প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্য নেলি টয়লেটে গিয়েই ফিরে এলো। তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলে ইশারা করলো দেখে আসার জন্য। টয়লেটে গিয়ে যে কোন বাংলাদেশি বা ফরাসী নাগরিকের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবার কথা। বেসিনের পাশেই শোভা বর্ধন করছে একটি টেলিভিশন সেট। টয়লেটের কমোডের জলের মাঝে খেলা করছে লাল রংয়ের খুচরো সেন্ট। যেন ফরাসীসহ বাংলাদেশের ভিসা প্রত্যাশীদের গৌরবের সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছে তোমাদের কাচা পয়সাকে আমরা টয়লেটে রাখি। নেই কোন পরিচ্ছন্নতার আবহ। এটিই আমাদের দেশের প্রতীক দূতাবাসের অভ্যন্তরের চিত্র।

বিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর কাউকে না পেয়ে নেলিকে ফিরে যেতে বললো। যাওয়ার পথে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের চিত্রের সঙ্গে আমাদের দূতাবাসের তুলনা করে বললো, ওই দূতাবাসে কেউ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারে না। বাইরে রয়েছে নিরাপত্তারক্ষী। ভেতরে ঢোকার সময়ে সঙ্গে রাখা ব্যাগ চেক না করে ঢুকতে দেবে না। আর তোমার দেশের দূতাবাসে যে কেউ যখন তখন ঢুকে যেতে পারছে।

নেলির ভাষায়, দূতাবাস একটি দেশের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়। তোমাদের দূতাবাসের ভেতরের অপরিচ্ছন্ন অবস্থা দেখার পর আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছি। আমি আর বাংলাদেশে যাবোনা। যে দেশের দূতাবাস অরক্ষিত, অপরিচ্ছন্ন সে দেশের বাস্তব অবস্থা কতোটা জীর্ণ হতে পারে তা আর বলার দরকার নেই। এ কথা বলে নেলি আমাকে বিদায় করলো।

ভগ্নহৃদয়ে দূতাবাসের এ জীর্ণ বিষয় নিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রদূতকে টেলিফোন করার চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রমজানের কারনে দূতাবাসের সময়সূচিতে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। দুপুর বারোটার পর বিকাল তিনটা পর্যন্ত কনস্যুলার সেকশনে কোন পাসপোর্ট জমা ও ফেরত দেয়া হয়না। তিনটার পর আবার কাজ শুরু হয়। দূতাবাসের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য একজন কর্মী রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, হয়তোবা কোন কারণে তিনি বাইরে ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদ হানিফ নামের এ নিরাপত্তা রক্ষীকে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে। দূতাবাসের স্বাভাবিক কর্ম দিবসে সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত থাকার কথা থাকলেও সেদিন তাকে পাওয়া যায়নি। মিশন প্রধান কোন একটি বাণিজ্য মেলা পরিদর্শনের জন্য সেদিন দূতালয়ে ছিলেন না।
জারা খান: ফ্রান্সে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।