ঢাকা, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ মে ২০২৪, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

মৃত্যুহীন বঙ্গবন্ধু

হাবীব ইমন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪
মৃত্যুহীন বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

দক্ষিণ আফ্রিকার উপর একটি বিখ্যাত উপন্যাস রয়েছে- ক্রাই, দ্যা বিলাভড কান্ট্রি। কাঁদো, প্রিয় দেশ।

বাঙালির হৃদয়েও একটি স্বতঃস্ফূর্ত ক্রন্দন আছে। একে অনুধাবন করার শক্তি আমার নেই। কেননা পঁচাত্তরের আগস্ট মাসের পনের তারিখে দেশি-বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রের মদদে ঘাতকরা বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর বহু আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে। এর নাম ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি। তাঁর জন্য জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত হয়নি। রাষ্ট্রীয় শোকদিবস পালন করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টি হয়নি। দেশের জীবন থেকে তাঁকে মুছে ফেলার সব আয়োজনই করা হয়েছিল।  

পুরো জাতি যখন মহা শোকে আচ্ছন্ন, তখন পনের আগস্টের দিন মিথ্যা জন্মদিন পালন করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জাতির সামনে উপহাস করে চলেছেন। আগে থেকে নয়, গত কয়েক বছর ধরে এ বিতর্কিত জন্মদিন পালন করার হিড়িক চলছে দলটিতে। সম্ভবত ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা দেয়ার পর থেকে এই চর্চা চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর তিনটি জন্মদিনের খবর প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৬১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার নথিপত্র অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৪৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। জিয়াউর রহমানের সাথে বিয়ের কাবিননামায় জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯৪৭ সালের ৯ আগস্ট। ১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে গিয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস উল্লেখ করেছেন তবে কোন তারিখ দেন নি। সর্বশেষ ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে যে তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করেছেন তাতে তিনি জন্ম তারিখ উল্লেখ করেছেন ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট। কোনটি সঠিক, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সুযোগ রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বহুল ডিগবাজি খাওয়া ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বই ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’ [২০০৭-২০০৮] ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। ঠেলার নাম যে বাবাজি, এ বইতে আরো একবার পরিস্কার হয়েছে। এ বইয়ের ৩২৪ পৃষ্ঠায় (শুক্রবার, ১৫ আগস্ট-২০০৮, দিন-৪৯১) তিনি লিখেছেন, ‘আজ জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এ দিনে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাড়িতে স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে খুন হন। জাতির ইতিহাসে এ এক মহাশোকের দিন। বিতর্কিত একটি জন্মদিন হিসেবে আজ খালেদা জিয়ারও ৬৩তম জন্মদিন। সঠিক হলেও আমি হলে আমার জন্মদিন বোধহয় এক দিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। খালেদা জিয়া তা করলে তিনি সব শ্রেণীর জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন। তার এই উদারতা তাকে আরও বেশি মহীয়ান করে তুলত। ’

মওদুদ আহমদ ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর বিশদ মূল্যায়ন করেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে তিনি ইতিহাসের মহানতম নায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্য সব মানুষের মতোই ভালো-মন্দ মিলিয়ে এই মর্ত্যেরই মানুষ। তিনি অতিমানব ছিলেন না। কিন্তু দেশ ও কালের গণ্ডির মাঝে থেকেও তিনি ছিলেন যুগের মহামানব। সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই ‘নেতা’ কিংবা ‘নায়কের’ স্থান করে নিতে পারে না, হতে পারে না, হাতে গোনা কিছু মানুষের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব হয়। মাঝে মাঝে অসাধারণ ক্যারিশমা-সম্পন্নরা অবশ্য ‘বড় নেতা’ অথবা ‘মহানায়কের’ আখ্যায়ও ভূষিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তারা সবাই সম-সাময়িক কালের নেতা, চলতি পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটের নায়ক। কিন্তু ‘ইতিহাসের নায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদেই তার ‘নায়কের’ উদ্ভব ঘটায়, আর সেই ‘ইতিহাসের নায়ক’-ই হয়ে ওঠে ইতিহাস রচনার প্রধান কারিগর-স্থপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেশের একজন বড় মাপের নেতা ও রাজনীতির একজন মহানায়কই শুধু ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের নায়ক’। আরো সত্য করে বললে, তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের এক মহানায়ক’।

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই ‘জাতির জনক’ ছিলেন না। কিংবা তাঁর উপর এ অভিধা চাপিয়ে দেয়া হয়নি। শুরুতে তিনি ছিলেন দুরন্ত কিশোর মুজিবুর। অনেকের কাছে মুজিব ভাই। তারপর মুজিবুর রহমান, অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের পর তিনিই স্বাধীন দেশের স্থপতি, ‘জাতির জনক’। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তরণ।

তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তাঁর চিন্তাধারা-জীবন দর্শনেও উত্তরণ ঘটেছে। শুরুটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র-কর্মী হিসেবে। তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৩৬ সালের দিকে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলাম, কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশি  আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশিরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। আর স্বদেশি আন্দোলনের লোকদের সাথে মেলামেশা করতাম। ’

তিনি ১৯৩৯ সালে কলকাতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করেন। এবং মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হন।   

কিন্তু সে সময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদার-নৈতিক ও কিছুটা প্রগতিমুখিন যে প্রবণতার অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দীর অনুগামী। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে। একইসাথে তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট-এই তিন দলের ঝাণ্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে সঙ্গী-সাথী-অনুগামীসহ তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবনদীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তখন থেকেই তার মাঝে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি একটি গভীর মনের টানের দেখা পাওয়া যায়। সাথে সাথে লক্ষ্য করা যায়, অসাম্প্রদায়িক বোধের প্রাথমিক উন্মেষ।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি তাকে অতিদ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহম্ক্তু করে তোলে। সাধারণ কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে যান। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু দু’বার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আবার দলকে সংগঠিত করার জন্য মন্ত্রিত্বও ছেড়েছিলেন, এ নজিরও তিনি স্থাপন করেছেন।

নীতি-আদর্শ থেকে সরে আসার কারণে এক সময় আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ গঠিত হয়। তিনি বুঝতে পারলেন যে, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু তার নেতা সোহরাওয়ার্দীর ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। দলের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও অ্যাসেমব্লিতে ন্যাপ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একবার সাক্ষাতকালে জিগ্যেস করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো? তার উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, ‘ সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারতো! তারা জগৎ জয় করতে পারতো। they could conquer the world.

তারপর বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাঁদের প্রস্তাবে। তাঁরা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনো উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নেই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা। সে স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলো যা কমিউনাল! বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করতো। হঠাৎ একদিন রব উঠলো, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। একটু একটু করে রূপ দিই ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা। কেউ বলে, পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না, বাংলাদেশ।

তারপর আমি স্লোগান দিই, জয় বাংলা। তখন ওরা বিদ্রুপ করে বলে, জয় বাংলা না জয় মা কালী! কী অপমান! সে অপমান সেদিন হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারে নি। জয় বাংলা বলতে বোঝাতে চেয়েছিলাম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়, যা সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্বে। ’ (আমার ভালোবাসার দেশ, অন্নদাশঙ্কর রায়)।

আইয়ুবী সামরিক শাসন জারির পর প্রবল নির্যাতন ও আক্রমণের মুখে শেখ মুজিব অনেকদিন হতাশায় আচ্ছন্ন থাকার পর আবার চাঙা হয়ে ওঠেন। ’৬১ সালের শেষ দিকে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সাথে কয়েকটি গোপন বৈঠকে তিনি মিলিত হন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সূচনা করার কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। সেই ভিত্তিতে সূচিত হয় ’৬২-এর সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র-গণ আন্দোলন। ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তিনি বুঝতে পারেন, এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য জোরেশোরে নামার সময় এসে গেছে। তিনি ৬-দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনে নেমে পড়েন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো বিশিষ্ট নেতার আপত্তি অগ্রাহ্য করে, আইউব-মোনায়েম সরকারের আক্রমণ উপেক্ষা করে তিনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন বাঙালির স্বাধিকারের দাবি নিয়ে। একটি কমিউনাল পার্টিকে ন্যাশনাল পার্টিতে রূপান্তরিত করে ফেলেন। দলের কর্মীরা শুধু নয়, সমগ্র দেশবাসী এই ৬-দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর পেছনে সমবেত হতে থাকে।

সরকার মরিয়া হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে সবদিক থেকে ‘শেষ করে দেয়ার’ চেষ্টায় নামে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ইতিহাসের পক্ষে এবং ইতিহাস সৃষ্টির মতো প্রজ্ঞা, জেদ, প্রত্যয় ও দক্ষতাসম্পন্ন। পাকিস্তান সরকারের প্রতিটি আঘাত তাঁর জন্য বীরমাল্য স্বরূপ ভূষণ হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা অসামান্য উঁচু স্তরে পৌঁছে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ৬-দফাকে প্রগতিশীল কর্মসূচিতে সমৃদ্ধ করে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১ দফা। সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। মুক্ত হয়ে আসেন মহানায়ক। শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলকে নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ইয়াহিয়া খান সেই বিজয়কে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেয়। দেশের অঘোষিত সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু যেন ক্ষমতায় যেতে না পারেন সেজন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো'। ... স্বাধীনতার পথে বাঙালির যাত্রার শীর্ষ পর্যায়ের ও প্রত্যক্ষ অধ্যায়ের সূচনা সেখানে থেকেই। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি। জাতির জনক।

ইতিহাস সৃষ্টিতে ব্যক্তির ভূমিকাকেও অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা যায় না। ইতিহাসই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয়। ইতিহাসের নিজস্ব প্রয়োজনেই বিশেষ মুহূর্তে এসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ‘ইতিহাস’ নিজেই জনগণের দ্বারা রচিত হতে থাকা যুগান্তকারী ঘটনাবলীর প্রাণকেন্দ্রে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ইতিহাসের হাতে তৈরি হওয়া সেই ব্যক্তিরাই আবার ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে উপাদান ওয়ে ওঠেন। জনগণ ও ব্যক্তির ভূমিকা এভাবে পরস্পর পরিপূরক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতেই ইতিহাস রচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল সেরূপ উপাদান। জনগণের সামনে অবস্থান নিয়ে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতিরূপে। একজন ব্যক্তি পঞ্চাশ বছর বয়সে এর চেয়ে বেশি সার্থকতা প্রত্যাশা করতে পারে! 

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের যেসব ঐতিহাসিক অর্জন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার প্রতীক ও কেন্দ্রবিন্দু। এ বিষয়টিকে অস্বীকার করাটা একটি অন-ঐতিহাসিক পণ্ডশ্রম মাত্র। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করতে হয়। তিনি ওই প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকার করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সবুজ সংকেত হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

ওই প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘তারপর এলো ১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারীরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে, এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো। ’

ওই লেখার আরেকটি অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন-‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। ’ জিয়াউর রহমানের এ লেখাটি বিএনপি’র ওয়েব সাইটে রয়েছে।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে একটি ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এইরকম দেখার কিংবা ভাবার অবকাশ নেই। একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যকে চরিতার্থ করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই লক্ষ্যটি ছিল দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা থেকে কক্ষচ্যুত করে পরাজিত পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীকী পুরুষ ও কেন্দ্রবিন্দুকে, তথা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ছাড়া এ ধরনের উল্টোমুখী রাজনৈতিক ডিগবাজি সংগঠিত করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।

তাই, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা থেকে দেশকে সরিয়ে আনতে হলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করাটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এবং ঠিক সেটিই করা হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বদলে ফেলে দেশকে সাম্প্রদায়িক, সামরিক-স্বৈরাচারী, পুঁজিবাদী-লুটপাটতান্ত্রিক ও সাম্রারাজ্যবাদ নির্ভরশীলতার পথে টেনে নামানো হয়েছিল। এ ঘটনাতেই প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি মোটা দাগে সমার্থক ছিল। তা না হলে রাষ্ট্রীয় নীতি বদলানোর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে হতো না এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর রাষ্ট্রীয় নীতি বদলানো হতো না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের গতিধারাকে বহুলাংশে উল্টে দিতে পারলেও, তার সবটুকু অর্জন নিঃশেষ করা যায়নি। তার কারণ, মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর কীর্তি তেমনি তা প্রধানত ছিল জনগণের নির্মাণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হলেও জনগণকে হত্যা করা যায়নি। তাই, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা আজও জীবন্ত রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তা এখনো পূর্ণতা নিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা না পেলেও, তা নিরন্তর জাগ্রত রয়েছে কোটি মানুষের অন্তরে।

একইভাবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও চিরঞ্জীব থাকবেন কোটি জনতার অন্তরে। তা এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মিলিত কীর্তি হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতা। জনতার মৃত্যু নেই, তাই মৃত্যু নেই বঙ্গবন্ধুরও! ‘দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়/জয় মুজিবুর রহমান। ’ (বঙ্গবন্ধু, অন্নদাশঙ্কর রায়)

পুনশ্চ
১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গভীর শোকের দিন। ১৯৯৬ সাল থেকে সরকারিভাবে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কার্যকলাপ দেখলে মনে হয় এটি শোক দিবস নয়। যেন জাতীয় উৎসবের দিন। এদিন উদযাপনকে কেন্দ্র করে রঙ-বেরঙের পোস্টার ছেয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও প্যান্ডেল করে গান-বাজনায় মেতে উঠছে। গরু জবাই করে ভূরি-ভোজের মহোৎসব হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব আয়োজনের নেপথ্যে চলছে চাঁদাবাজি!!! প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কী বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু নামে জিকির তুলে তাঁকে বেচা হচ্ছে!

হাবীব ইমন: শিক্ষক, কবি, রাজনৈতিক কর্মী, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।