ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ইলেক্ট্রনিক আড্ডায় হারিয়ে গেছে সেই মধুর দিনগুলো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৬
ইলেক্ট্রনিক আড্ডায় হারিয়ে গেছে সেই মধুর দিনগুলো

কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আর নেই। মান্না দে’র এই গানের ভেতর ফুটে উঠে আড্ডার মর্মাথ।

কলকাতার কফি হাউজ ঠিকই আছে, আছে আড্ডাও। হ্যাঁ, তারপরও কফি হাউজের ‘সেই’ আড্ডা হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে।

আমাদের ঢাকা শহরেও নানান স্থানের নানামুখি আড্ডা যেমন হারিয়ে গেছে, আবার গড়ে উঠেছে নতুন নতুন আড্ডাস্থল। তবে একথা স্বীকার্য, ইন্টারনেট আসার পর প্রকৃত নির্মল আড্ডা হ্রাস পেয়েছে অনেকাংশে।   কারণ, বেশির ভাগ মানুষ এখন ফেসবুকে ইলেক্ট্রনিক আড্ডায় মেতে থাকে। আড্ডার জন্য আড্ডাস্থাল যাওয়ার আর দরকার পড়েনা!
‘আড্ডা’ শব্দটা অনেকটা নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়। মানে যাদের কাম-কাজ নেই, অখণ্ড অবসর; তারা সময় পার করার জন্য আমোদ-প্রমোদের গল্প-গুজব করে, হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করে, পরচর্চা করে। এই ধারণা আসলে ভুল। বাঙালির জীবন জুড়ে আড্ডা জড়িয়ে থাকে সারা জীবন। প্রাণখোলা বিশুদ্ধ আড্ডা আমাদের ক্লান্তিকর জীবনে এনে দেয় নতুন প্রাণ শক্তি। আড্ডার অর্থ বহুমাত্রিক। তা নিয়ে ‘বাঙালির আড্ডা’ নামে কলকাতার গাংচিল প্রকাশনী বইও বের করেছে। কিন্তু আমাদের ঢাকার আড্ডা নিয়ে কোনো বই নেই!
সত্তর দশকের শেষে ঢাকায় আসি ‘কবি’ হবার জন্য। এসে খুঁজতে থাকি কোথায় কোথায় লেখকদের জমজমাট আড্ডা হয়। তখন পুরনো ঢাকার বাংলাবাজারের ‘বিউটি বোর্ডিং’য়ে অথবা সিকানদর আবু জাফরের পর হাসান হাফিজুর রহমানের সমকাল অফিসে কিংবা পুর‍ানা পল্টনে শহীদ কাদরীর বাসায় ম্যারাথন আড্ডার শেষ দিনগুলোতে আমাদের আড্ডার সূচনা হয়।

সাহিত্যের বাইরে মাঝে মধ্যে কূটনৈতিক আড্ডা, রাজনৈতিক আড্ডা, ব্যবসায়ীদের আড্ডা, ঢাকা ক্লাবের আড্ডা, আমলাদের আড্ডা, মহিলাদের আড্ডা, সিনেমা জগতের আড্ডা, শেরাটন-সোনার গাঁয়ের আড্ডায় যেতাম। কিন্তু তাতে মজা পেলাম না! ফলে আমার আকর্ষণ ছিলো সাহিত্যকেন্দ্রিক আড্ডাগুলোয়। কখনো কখনো কবিতা পড়া আর আড্ডামারার জন্য ছুটে যেতাম নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, টাঙ্গাইল, এমন কি কলকাতাতেও। আমাদের সময়ে নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিনের নিয়মিত আড্ডা ছিলো জমজমাট।
কেউ না কেউ প্রতিটি আড্ডার মূল আকর্ষণ বা প্রাণকেন্দ্র। এক সময়ে বাংলা একাডেমিতে রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, ফরহাদ খান, মুহম্মদ নূরুল হুদা, ওবায়দুল ইসলাম- এদের প্রত্যেকের রুমে সব সময় ঘিরে থাকলো আড্ডাবাজেরা। অফিস টাইম শেষ হলেও আড্ডাবাজদের দখলে থাকতো তাদের কক্ষ! রুমে রুমে মির্মল আড্ডা দিতে দিতে সারাদিন কোত্থেকে ফুরিয়ে যেতো বলা মুশকিল।

বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সময় তো লেখক-পাঠক-প্রকাশকের আড্ডা থাকেই। তবে আমাদের সময় এক অদ্ভূত দিনরাতের ম্যারাথন আড্ডা ছিলো; যা হারিয়ে গেছে। যেটা শুরু হতো ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে। রাত ন’টায় বইমেলা শেষ হলেও আমরা মেলায় থেকে যেতাম। ১২টা ১ মিনিটে টিএসসি চত্বরে আমাদের ছোটকাগজের আয়োজনে কবিতা পাঠ আর সেই সাথে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর ঢল শেষ হলে আমরা শেষ রাতে ঢুলু ঢুলু চোখে ফিরে যেতাম বাংলা একাডেমির বইমেলার প্রাঙ্গণে। মাতাল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ খালি গলায় দরদ দিয়ে গাইতো- ‘অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই’ অথবা ‘ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো দিও তোমার মালা খানি। বাউলের এই মনটারে ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’।

গান শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম বট গাছের নিচে, বর্ধমান হাউজের বারান্দায়, কোনো পরিচিত বুকস্টলের চটের বিছানায়, চায়ের দোক‍ানের চেয়ারে, বাংলা একাডেমির মঞ্চের আড়ালে। আমাদের এই নিশি যাপনের সাথে থাকতো দু’চার জন পাহারারত পুলিশ।

বাংলা একাডেমিতে এই রাত্রি বাসের কারণ, সকাল সাড়ে সাতটায় সকাল-সন্ধ্যা কবিতা পাঠের আসর। ফজরের আজানের সুরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বাংলা একাডেমির মূল গেটের পাশে ছাপড়া করা চায়ের দোকানে ডিম-পরোটা-ডাল-ভাজি নাস্তা আর গরম গরম ঘণ দুধের চা।   এসব এখন আমাদের ছাত্র জীবন এবং লেখক জীবনের মধুর স্মৃতি!
সেই সময়ে আমাদের ছাত্র জীবনের প্রতিদিনের আড্ডার আখড়া ছিলো- টিএসসি চত্বর, মধুর ক্যান্টিন, আর্ট কলেজের আঙ্গিনা, নিউ মার্কেটে বইয়ের দোকান নলেজ হোম।
আশি দশকের শুরুতে আমাদের আড্ডা ছিলো পত্রিকা অফিস ঘিরে। মনে হতো সারাদিন ধরে চলছে লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের উৎসব। সন্ধ্যাবেলা পত্রিকা অফিস থেকে বিদায় নিতে হতো। কারণ, পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি। সবাই মহা ব্যস্ত। সাংবাদিক বন্ধুরা নিউজ প্রিন্টের প্যাডে নিউজ লিখছেন, মনে হতো- প্রত্যেকেই ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরীক্ষা নিচ্ছেন নিউজ এডিটর। রিপোর্টাররা প্যাডের পাতা ছিঁড়ে ফ্লোর ভাসাচ্ছেন, চা খাচ্ছেন। বিএসএস থেকে অদ্ভূত ইংরেজিতে বিদেশি নিউজ প্রিন্ট হচ্ছে, সাব এডিটরেরা তা অনুবাদ করছেন, পাশে পায়ে চাপ দেয়া হ্যান্ড কম্পোজের প্রুফ দেখছেন প্রুফ রিডারেরা। সব মিলিয়ে সে এক এলাহী কাণ্ড!

১ নং রাম কৃষ্ণ মিশন রোডের ইত্তেফাক, পূর্বাণী, রোববারে দাদাভাইকে ঘিরে, রাহাত খানকে ঘিরে, আল মুজাহিদীকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনেই চলতো আড্ডা। আড্ডা যেনো মৃত্যুঞ্জয়ী শালসা।

১ ডিআইটিস্থ দৈনিক বাংলার চার তলায় হাবীব ভাই (আহসান হাবীব), আফলাতু ভাই, তিন তলায় আমাদের ‘মৈনাখ’এর কক্ষে অর্থাৎ শামসুর রাহমানের দপ্তরে এবং বিচিত্রা অফিসের অফুরন্ত আড্ডা এখন শুধু অতীতের স্মৃতিময় ইতিহাস!

বিচিত্রার উল্টো দিকে হারূন এন্টারপ্রাইজের দোতলায় ছিলো ফজল শাহাবুদ্দিনের আড্ডাখানা। সেখানে বেশির ভাগ প্রতিক্রিয়াশীল আর আমলা লেখকরা আসতেন। তখন আমার ছিলো সচিবালয়ে। দুপুর ২টায় ছুটির পর ছুটে যেতাম কোনো কোনো পত্রিকার অফিসে কারো সাথে দেখা করা অথবা কবিতা দেয়ার জন্য কিংবা ত্রিশ-চল্লিশ টাকার লেখার বিলের জন্য। আবার কোনো কোনো দিন গুলিস্থান থেকে নবাবপুর রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে অথবা মুড়ির টিনে চড়ে যেতাম বাংলাবাজার। প্রকাশক বন্ধুদের সাথে দেখা করা ছাড়াও বুলবুল চৌধুরীর প্রেসে কম পয়সায় বা বাকীতে লিটিলম্যাগ বের করার জন্য। সেখানে বাড়তি ছিলো বিপ্লব দাসদের মতো মজার মানুষের বিচিত্র আড্ডা। ফেরার পথে শক্তি সাধনা ঔষধালয়ের মেথর পট্টিতে মুস্তফা আনোয়ার, শেখ আব্দুল হাকিমের সাথে খাঁটি বাংলা মদ!

আমাদের অগ্রজ অনেকেই ছিলেন সেই সব আড্ডার প্রাণব্যক্তি। যেমন আড্ডার জীবন্ত কিংবদন্তী শহীদ কাদরি এখন নিউইয়র্কে। ফোনে তার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হয়। তার সময়ের আড্ডার কথা শুনলে মনে হয়, ঈর্ষা হয় যেনো, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতামের মত। তারা তাদের সময়ে সারারাত এখান থেকে সেখানে, এ জায়গা থেকে সে জায়গায়, এ রেস্টুরেন্টে সে রেস্টুরেন্টে চলমান আড্ডা দিতেন। ফলে পুলিশ থেকে নিশাচর মানুষেরা জানতো, এরা খাঁটি আড্ডাবাজ, এরা কবি।

আড্ডার আরেক কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তি শামসুর রাহমান। তিনি সব সময় কম কথা বলতে। শুনতেন, হাসতেন, উপভোগ করতেন। মাঝে মধ্যে তাল দিতেন। তিনি দৈনিক বাংলা থেকে চলে যাবার পর আমাদের আড্ডা বসতো তার বাসায়, কখনো পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাস ভবনে। আড্ডাবাজ ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। বেলাল ভাইয়ের ঝুলি ভর্তি আড্ডার বিচিত্র মালমশলা। ধানমন্ডিস্থ তার ভারত বিচিত্রা অফিস কিংবা পল্টনস্থ সচিত্র সন্ধানী অফিস ছিলো আড্ডাখানা। আরো দু’টি আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে। একটি হচ্ছে- রেডিও অফিস এবং অপরটি হচ্ছে- বাংলাদেশ টেলিভিশন; কর্মরত লেখকদের ঘিরে।

অনেক স্মৃতির ভীড়ে মনে পড়ে আবদুল মান্নান সৈয়দকে ঘিরে গ্রীন রোডে আমাদের দীর্ঘ দিনের বৈঠক। মান্নান ভাই ছিলেন খুব রাগী, রগচটা। সিলেক্টের অর্থাৎ পছন্দের মানুষ ছাড়া অন্যদের জন্য তাকে ঘিরে আড্ডা ছিলো অনেকটা নিষিদ্ধ!

আমরা আশি দশকের শুরুর দিকে লিটিল ম্যাগাজিন শব্দটিকে বাংলায় ব্যবহার করি- ‘ছোটকাগজ’ হিসেবে। (আমি, ফরিদ কবির ও মাহমুদ মান্নান মিলে ‘ছোটকাগজ’ নামে ক’টি সংখ্যা পত্রিকা বের করি। আমরা ছোট কাগজ থেকে সর্ব প্রথম কবিদের স্বকণ্ঠে কবিতা ক্যাসেটও বের করি। )

‘ছোটকাগজ’ শব্দটি মান্নান সৈয়দ পছন্দ করেন। আমরা যারা লিটিল ম্যাগ করতাম, তারা প্রতি শুক্রবার সকাল দশটা-এগারোটায় মান্নান ভাইয়ের বাসার কাছের একটি সিলেটি চায়ের দোকানে সমবেত হতাম। তাতে থাকতেন ফারুখ মাহমুদ (সম্পাদক/ বিকাশ), শহীদুজ্জামান ফিরোজ (সম্পাদক/ঢেউ), আশরাফ আহমেদ (সম্পাদক/স্বকাল), হারুণ রশিদ (সম্পাদক/ নতুন কবিতা), মান্নান সৈয়দ(সম্পাদক/চারিত্র), সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল (সম্পাদক/ সূচিপত্র)। আমরা কোনো পরচর্চা করতাম না। পত্রিকা বের করার পরিকল্পনা, সাহিত্যালাপ, কবিতা পাঠ আড্ডায় প্রাধান্য পেতো। একদিন আড্ডা দিতে দিতে মান্নান ভাই লিখে ফেললেন এক দারুণ কবিতাঃ ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’:

“এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
আধ্যাত্মিক কবিতা, পার্থিব কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতা ও আমরা বাজারে ছাড়াছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙ্গুল, পায়ের আঙ্গুল,-
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে
স্বদেশী ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প
শব্দ ও ছন্দ,
অন্তমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মত আরে অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল! কিন্তু,
আপনি তো জানেনই
আমাদের কোম্পানি ইতিমধ্যে বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ,আপনার অর্ডার দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্কুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে
একছুটে নিয়ে আসবার জন্য
একখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে”।

কবিতা পাঠের পর ‘কেমন লিখলাম?’ বলেই মান্নান ভাইয়ের প্রাণখোলা হাসি। সেই হাসি আজো কানে বাজে।

সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নেতার পর আমি আজিজ মার্কেটে অফিস শুরু করি ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ দশ বছর আজিজ মার্কেটের স্বরব্যঞ্জনে সারাক্ষণ আড্ডার মধ্যেই নিমজ্জিত ছিলাম। কত দেশ-বিদেশের খ্যাতমানেরা আসতেন আমার ছোট্ট সেই অফিস কক্ষে স্বরব্যঞ্জনে কিংবা পাঠশালায়! সে স্মৃতি আমাকে সারা জীবন আলোড়িত করবে।
এক সময় আজিজ মার্কেট ছিলো সাংস্কৃতিক মার্কেট আর বইপাড়া বলে খ্যাত। তারও আগে পিজি মার্কেটের দক্ষিণ কোনায় এটায় সাইকেল, মোটর সাইকেল ঠিক করার ভাঙ্গাচুরা ভাসমান গ্যারেজ, ফুটপাতে অস্থায়ী চায়ের দোকান আর পাশে রেখায়ন। শিল্পী রাগীব আহসান চৌধুরীর বিজ্ঞাপনী সংস্থা সেই রেখায়নের সান্ধ্যকালী আড্ডা সময়ের গতি ধরে চলে যায় আজিজ মার্কেটে। গড়ে উঠে বইপাড়া। কিন্তু সেই বইপাড়া এখন হুমকির সম্মুখীন। কলকাতার নন্দনের আদলে ছিলো আমাদের আজিজ মার্কেট- বইপত্র, লিটল ম্যাগ, চা-আড্ডা, কবিতা পাঠের আসর, নাটকের রিয়ার্সাল, সেমিনার, শর্টফিল্মের কোর্স, আবৃত্তির ক্লাশ, গানের আসর, বিজ্ঞান চেতনায় তাত্ত্বিক আলোচনা, প্রকাশনা, পত্রিকার অফিস, লেখকদের পদচারণা, তরুণদের নানান কর্মকাণ্ডে জমজমাট থাকতো সারাবেলা, ভ্রাম্যমাণ নবীন-প্রবীণ সাংস্কৃতিককর্মীদের মিলনমেলায়।

‘সন্ধ্যা হলেই আরো জমে উঠে আজিজ মার্কেট, জেগে উঠে নতুন মাত্রায়। বই-এর দোকানে ঘুরে গেলেন মুহম্মদ হাবিবুর রহমান কিংবা হাসনাত আবদুল হাই, দোতলায় বসে প্রুফ দেখছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, নিচে নাটক লিখছেন মান্নান হীরা, প্রবাসী এক লেখকের সাথে দেখা করতে এসেছেন নির্মলেন্দু গুণ, সাথে অসীম সাহা, কোনো ঘরে অতিথি হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা, পাবনার সুচিত্রা সেন সম্পর্কিত নতুন তথ্য নিয়ে এসেছেন অনুপম হায়াৎ, কলকাতার জয় গোস্বামী এসে তরুণ কবিদের আড্ডা দিচ্ছেন পারভেজ হোসেনের চা-স্টলে, আস্তে-ধীরে সিঁড়ি ভেঙে দু’তলা থেকে নিচে নামছেন ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন, একজোড়া তরুণ-তরুণী এসেছে অন্তরে, শ্রাবণে আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল নাসির আলী মামুনের, নতুন লিটল ম্যাগ খুঁজছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন, এভাবে প্রায় সারা সারাবেলায় জমজমাট থাকে আজিজ মার্কেট’। (দ্রঃ  দৈনিক সমকাল,  জানুয়ারি ২৪, ২০১০, ঢাকা)।

এক সময় দুপুর ফুরায়, বিকেল গড়িয়ে রাত হয়। ঘরের টানে সবাই বাসায় ফেরে। আজিজ  মার্কেট থেকে শেষ বাস ধরে আমিও মীরপুরে যাই। যাবার পথে পিজির ভেতরের বট গাছের গোড়ায় বসে কয়েক জন যুবক এবং এক জন তরুণী আড্ডা মারছে। তাদের মাথার উপর গোল পাকাচ্ছে ধোঁয়ার কুন্ডুলি। সেই তরুণ কবি বন্ধুরা এখন দেশ-বিদেশে এবং তারা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত। সেই ঘোর লাগা নেশা জড়ানো আড্ডা থেকে দু’একজন আর ফিরে আসতে পারেনি। তারাও ধোঁয়ার গোল পাকানো কুন্ডুলির সাথে মিশে গেছে!  
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০১৯ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৬
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।