এক. ধারণা করা হয়, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই প্রথম ‘বাবা দিবস’ পালিত হয়। আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় প্রথম এই দিনটি পালিত হয়।
সেনোরা ছিলেন ৬ ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা ইলেন স্মার্ট যখন মারা যান তখন সেনোরার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নেন। সারাক্ষণ তিনি তাদের দেখে শুনে রাখতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবা উইলিয়াম সন্তানদের মায়ের অভাব এতটুকু বুঝতে দেননি।
১৯১০ সালে সনোরার প্রচেষ্টায় বিশেষ এই দিনটি উদযাপিত হয়। শুরুতে এটি বিশেষ সফলতা পায়নি। তবে, ১৯৩০ সালে নিজ শহর স্পোকারে ফিরে তিনি আবার বাবা দিবস উদযাপন ও প্রসারে প্রচারণা শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্থায়ীভাবে বাবা দিবসকে রাষ্ট্রীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাৎপর্যের সঙ্গে পালিত হচ্ছে বাবা দিবস।
দুই. কবি গোলাম মোস্তফার ‘জীবন বিনিময়’ কবিতাটির সারকথা আমাদের সবার মনে আছে। পুত্র হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত। রাজ্যের সব বিজ্ঞ চিকিৎসকরা তাকে সারিয়ে তোলার কাজে সদা নিয়োজিত। কিন্তু এই অজ্ঞাত রোগ থেকে রাজকুমারের পরিত্রাণ হচ্ছিল না। অস্তমিত সূর্যের মতো তার জীবন প্রদীপটা ক্রমশ নিভে আসছে।
বাদশাহ বাবর হেকিমদের ডেকে জানতে চাইলেন, এই রোগ থেকে আদরের শাহজাদা মুক্তি পাবে কি? উত্তরে সবাই নীরব। এমন সময় জনৈক দরবেশ বললেন, বাদশাহ যদি তার শ্রেষ্ঠ ধন মহান আল্লাহর উদ্দেশে উৎসর্গ করতে পারেন, তবেই আল্লাহর রহমতে শাহজাদার প্রাণ রক্ষা পেতে পারে। তখন বাবর নিজ গৃহে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে আল্লাহর দরবারে নিজ জীবনের বিনিময়ে পুত্রের রোগমুক্তি কামনা করেন। আল্লাহ পাক তার প্রার্থনা কবুল করলেন।
সেই দিন থেকে পিতা বাবরের রোগ লক্ষণ দেখা দিল এবং পুত্র হুমায়ুনের রোগ মুক্তি হল। মহান পিতার মৃত্যুর অতল জীবন ফিরিয়ে দিল পুত্রের নতুন ঊষার আলো। আবার, ফারসি মহাকবি ফেরদৌসী তাঁর মেয়ের সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য গজনীর সুলতান মাহমুদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার শর্তে পৃথিবীর অন্যতম মহাকাব্য শাহনামা ৭টি বৃহৎ খণ্ডে ৬০ হাজার শ্লোক ৩০ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে রচনা করেন।
তিন. এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুইটি বন্ধ করুন। বাবার হাতের আঙুল ধরে হাঁটার অনুভুতি একবার মনে করার চেষ্টা করুন কিংবা বাবার চওড়া কাঁধের উপর উঠে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিগুলো। যারা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, প্রত্যেকে একবার ভেবে দেখুন বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবার দিনটির কথা। আমরা অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য, মানুষ করার জন্য প্রত্যেকের বাবাকেই দিন রাত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
অথচ এখনও অনেক বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানদের কিসের নেশায় পেয়েছে বোঝা দায়। যে বাবা সন্তানের অসুস্থতার সময় চিকিৎসা খরচ যোগাড় করতে দিন রাত এক করে পরিশ্রম করেছেন। আজ তার চিকিৎসার সময় সন্তানের নানা অজুহাত। বৃদ্ধ বাবার মৃত্যু কামনা করে এমন সন্তানও আছে, আমাদের সমাজে। কত নির্বোধ আমরা!
চার. আমার বাবা মো. মজিবর রহমান শেখ পেশায় শিক্ষক ছিলেন। অনেকগুলো বছর যশোর বোর্ডের প্রধান পরীক্ষক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবা শিক্ষক হবার কারণে আমাদের তিন ভাইকে বাইরের শিক্ষকের কাছে যেতে হয়নি। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পরেও সন্ধ্যার পর আমাদের নিয়ে বসতেন। খুব সকালে পড়ার টেবিলে যেতে দেরি হলে কিছু বকাঝকা মায়ের উপরও যেত। পাড়ার সমবয়সী কারো সঙ্গে আমাদের ঝগড়া কিংবা মারামারি হলে প্রতিবেশীরা বাবার কাছে নালিশ দিতে আসতেন।
কে দোষ ত্রুটি করেছে সেটা বাদ দিয়ে আমাদের উপরই বাবার শাসন ব্যবস্থা কায়েম হতো। তখন বাবার উপর খুব অভিমান হতো। এখন মন থেকে ধন্যবাদ দেই। সেদিন যদি বাবা আমাদের শাসন না করতেন কিংবা আমাদের পক্ষ নিতেন, আমাদের দূরন্তপনা কিংবা উচ্ছৃঙ্খলা আরও বেড়ে যেতো। বাবার বয়স এখন চৌষট্টি বছর। তার হাতে এখনও সংসার প্রধানের দায়িত্ব। বাবার কারণে আমরা ভাইয়েরা এখনও নির্ভার জীবন যাপন করছি।
যখনই আমরা ভুল করি, বাবার ভালোবাসা এবং শাসন প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভুলগুলো শুধরে দেয়। বাবার জন্যই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আজও উপভোগ করতে পারছি।
পাঁচ. জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস। দিনটি আমাদের অনেকের জন্য বেমানান। কারণ বাবাদের ভালোবাসার ছায়াতলে আমরা সবসময় আছি এবং আমৃত্যু থাকব। প্রতিটি দিনই আমাদের কাছে বাবা দিবস। তবে, দিনটি যেহেতু বিশ্বের অনেক দেশে একযোগে পালিত হয়, মনের মধ্যে আলাদা ভাবেই একটা ধাক্কা দেয়। গত দুই দিন ধরেই ভাবছি, আমি আমার বাবার সঙ্গে অনেক সময় একটু বাঁকা করে কথা বলে থাকি। মনে মনে বাবা হয়তো নিজের বার্ধক্যকে ধিক্কার দেয়। অনেক সময় বলেই ফেলে, চাকরি না থাকলে কেউ মূল্য দেয় না।
বাবাকে কি করে বোঝাই আপনার জন্যই আজ আমি মাটির উপর শিরদাড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছি। পৃথিবীর কেউ কখনও চোখ রাঙিয়ে কথা বলার সাহস পায়নি। আজও পায় না। আপনি আছেন বলেই আমার অস্তিত্ব আছে। আপনার পরিচয়েই আমার পরিচিতি।
ছয়. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। ’ ইবাদত যতই করি আল্লাহ সন্তুষ্ট না হলে সবই বিফলে যাবে। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে পিতাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে। পিতা, বাবা কিংবা আব্বু যে শব্দেই তাকে ডাকি, তার মূল পরিচয় হলো তিনি আমাদের জন্মদাতা। মনে রাখতে হবে প্রতিটি সন্তানের ওপর তাদের পিতার হক রয়েছে।
পিতার সন্তুষ্টির ওপর আমাদের জীবনে সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তার অবাধ্যতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাই বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছামতো বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন, কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুনাহ মাফ করেন না; বরং এ গুনাহগারকে পার্থিব জীবনে মৃত্যুর আগেই শাস্তি দিয়ে থাকেন। ’
লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৫৬ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৬
পিসি/