ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কি করে ভাবি, বাবা নেই!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৬
কি করে ভাবি, বাবা নেই!

জীবন তো আর থেমে নেই। ক্রমাগত দৌড়াচ্ছেই।

স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বসবাস করছি আমরা। বাবার স্মৃতি গুলো আমার বা আমার পরিবারের বাইরেও অনেকের কাছে জীবন্ত হয়ে আছে। লালন করছে বাবার প্রজ্ঞাকে সৃজনশীল মুক্ত চিন্তাকে। বাবা তাঁর কর্মে চেতনায় সব সময়ই ছিলেন স্বচ্ছ।

কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে বিন্দুমাত্র পিছুপা হতেন না। আমরা বাবাকে নিয়ে খুব চিন্তা করতাম। বাবা তুমি এমন কঠোর ভাষায় লিখছো, একা চলাফেরা করো, কখন কি হয়। আমাদের খুব ভয় করে। বাবা বলতেন- কি আর হবে, হয়তো আমাকে মেরে ফেলতে পারে কিংবা তুলে নিয়ে গুম করে ফেলতে পারে- এই তো। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। একদিন তো মরতেই হবে, কিন্তু আমার অস্ত্র আছে কলম, এটা কখনো থেমে থাকবে না। আমি এই অস্ত্র দিয়ে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবো। বাবা তাই করে গেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। বাবার শেষকৃত্যর পর পোস্তগোলায় সংরক্ষিত স্থানে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের নকশায় বাবার সেই অস্ত্র কলমই স্থান পেলো। কলমের জিজ্ঞাসা দিয়ে বাবার একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করা হয়েছে।

বাবা সাহিত্য তত্ত্বের উপর প্রচুর লিখেছেন কিন্তু সেগুলোর বই এর সংখ্যা খুব কম। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয় বাবাকে খুব ব্যথিত করে, কিন্তু বাবা আশা হারানোর পাত্র ছিলেন না। মানুষের সততাকে সব সময় শ্রদ্ধা করতেন। কিছুদিন আগে নিউ ইয়র্কে বাবার একজন কাছের মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমাদের নিনিদি (নিনি ওয়াহেদ)। তিনি সংবাদ-এ কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। বহুদিন হলো দেশ ছেড়েছেন। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হয়ে আমার অসম্ভব ভালো লাগছিল। নিনিদি এত আবেগ আপ্লুত হয়ে বাবার কথা বলে যাচ্ছিলেন, আমার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। নিনিদি বলছিলেন, কাকুদের আদর্শে, নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে আমাদের এখন মুশকিল হয়ে যায়, মিলাতে পারি না। এখানে সব কিছু এত অন্যায়, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অসম্ভব লাগে সব কিছু।

প্রবাসী জীবনে মাঝে মধ্যে আমরা সবাই হতাশ হই। অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা জীবন সাধ্য হয় মাঝে মধ্যে। তার মধ্যে নতুন প্রজন্মদের জন্য সেটা আরো দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজের দেশের জাতি সংস্কৃতি সম্বন্ধে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করাকে। একটা জরিপে এসেছে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে সুখী দেশ। আমার জার্মান ক্লাসে টিচার তা ব্যাখা করছিলেন, বাংলাদেশ খুব গরীব দেশ সেজন্য তারা সুখী। গরীব লোকের আকাংখা কম থাকে। অল্পতেই তারা সুখী হয়। মানতে বাধা নেই আমাদের দেশ অনেক গরীব, কিন্তু তারা স্বাধীন, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অধিকার তারা রক্ষা করতে পারে। আমাদের প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম, এদের কাছে সঠিক সুস্থ্যভাবে দেশের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মরা নিজের দেশকে লালন করতে পারবো। যেন হারিয়ে না যায় দেশের কৃতি ত্যাগী ব্যক্তিদের মহাত্ম।

বাবা মৌলবাদ নির্মূল আর গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু সমন্বয়ের কথা তাঁর লেখায় লিখতেন। বলতেন- নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেই তারা গণতান্ত্রিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে- এই সনাতনী চিন্তাধারা খুবই ক্ষতিকর দেশের জন্য, আমরা দেখেছি তার-ই ফলশ্র“তিতে বিগত দিনগুলোতে দেশের মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এখন আমরা অবশ্য আশার মুখ দেখছি। তবে মৌলবাদ-যুদ্ধাপরাধী চিরতরে নির্মূল হবে তো?

বাবার সম্পদ বলতে ছিল শুধুই বই। বাবা বই কিনতে কার্পণ্য করতেন না কখনো এবং এত দ্রুত বই পড়তেন যা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। বাসায় যতক্ষণ থাকতেন সারাক্ষণই বই পড়তেন। আমাদের টিকাটুলির বাড়িটি ছিল বেশ ছোট আর বাবার রুমটাও বেশ ছোট ছিল। এত বই ঠিকমত রাখা যেত না। যার ফলে অগত্যা এলোমেলোই থাকতো। আমরা বলতাম বাবা বই গুলোকে একটু সেল্ফে গুছিয়ে রাখা উচিত। বাবা হাসতেন, বলতেন, জানিস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বলেছেন- সংসারে বইয়ের সেলফ বুদ্ধির চেয়ে অনেক সূলভ ও প্রচুর। এই কারণে অধিকাংশ বইয়ের গতি হয় সেল্ফের তাকে, বুদ্ধিমানের ডেস্কে নয়।

খুব ছোট ছোট ঘটনা প্রায়শই মনে পড়ে যায়। আমি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাবার ঘরে যেতাম। বাবা তুমি ডিম খেয়েছো, কলা খেয়োছো। তোমার ঘরে এত সিগারেটের গন্ধ কেন? কয়টা সিগারেট খেয়েছো। বাবার ক্ষেত্রে আমার শাসনের কোন কমতি ছিল না। বাবা বলতেন, এই মেয়েটা ঘুমিয়ে থাকলেই শান্তি। সারাদিন তার উপদেশ এটা করো না ওটা করো না। আমাদের আর্থিক প্রাচুর্যতা ছিল না ঠিকই কিন্তু বাবা আমাদের সব ব্যাপারে অসম্ভব সচেতন ছিলেন। নিজে প্রচণ্ড কষ্ট করতেন, কিন্তু আমাদের তা বুঝতে দিতেন না। অসম্ভব সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। টিকাটুলীর বাসা থেকে সংবাদ অফিস যাবার সময় প্রায়ই দেখতাম বাবা বাসা থেকে মধুমিতা সিনেমা হল পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে তারপর রিকশা নিতেন। বলতেন ২ টাকা বাঁচাতে পেরেছি অথচ বাবা রিক্শাওয়ালাকে ২ টাকা বেশি দিতেন। আমি বলতাম, তাহলে কি লাভ হলো। বাবা বলতেন, ওরা কি অমানসিক পরিশ্রম করে দেখিস না।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা গুলো যেন ছিল ঠোটস্ত। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় নজরুল, জীবনানন্দ-এর কবিতাগুলোও কি গভীরভাবে পড়ে শোনাতো। যখন আমি পরে সেই কবিতা শুনতাম বা পড়তাম মনে হতো কত চেনা এই কবিতাটি। চিত্রকলা, বিশ্বসাহিত্য, নাটক কোথায় বাবার দখল ছিল না। বাবাকে বলতাম, এত কি করে পড়ো, মনে রাখো? বাবাকে বলা হতো জীবন্ত কম্পিউটার, বাবা বলতেন, ভালবাসা আর মনোযোগ থাকলে সব কিছুই সম্ভব।

আসলে ভাবতেই ইচ্ছে করে না বাবা নেই। আমাদের সব কিছুর মধ্যেই বাবা, আমাদের ঢাকার বাসায় চারিদিকে বাবার সবকিছু। বাবার বই, ছবি লেখা আর মনের মধ্যে তো বাবা সব সময়ই বাস করছে। তাহলে কি করে ভাববো বাবা নেই !

বাংলাদেশ সময় ০১০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।