ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রঞ্জুদের ভালোবাসবেন?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১১
রঞ্জুদের ভালোবাসবেন?

নূরে আলম ভাই রঞ্জু’র খবর দেন। আহমেদ নূরে আলম।

বাংলাদেশের প্রতিথযশা এই সাংবাদিক মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে সিডনি এসেছেন। তার তিন মেয়ে থাকেন সিডনিতে। এক মেয়ে সিডনির লিভারপুল হাসপাতালের ডাক্তার। রঞ্জু’র অসহায়ত্ব দেখে প্রান কাঁদে বাংলাদেশি ডাক্তারের। বাসায় ফিরে সাংবাদিক বাবার সঙ্গে গল্প করেন। নূরে আলম ভাই ফোনে অনুরোধ করে বলেন, দেখেনতো দেশের ছেলেটির জন্য কিছু করতে পারেন কিনা।

প্রিয় বাবু ভাইকে নিয়ে একদিন লিভারপুল হাসপাতালে যাই রঞ্জুকে দেখতে। অষ্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির সক্রিয় সংগঠক আলমগীর ইসলাম বাবু ভাইর বাড়ি দিনাজপুরে। সিডনিতে আমার নানা কাজে সাপোর্ট দেন। হাসপাতালের শয্যায় সটান শুয়ে এক যুবক। ২৪-২৫ বয়স হবে। একা নড়াচড়ার সামর্থ্য নেই। হাত ধরতেই তাঁর চোখ-গলা দুটিই আদ্র হয়। যুবক কাঁদতে থাকেন। বলেন, অনেকদিন পর আমাকে দেখতে কেউ হাসপাতালে এলেন। এরজন্য অবশ্য কাউকে দোষ দেইনা। বিদেশে সবাই যার যার সংগ্রাম-শিডিউল নিয়ে ব্যস্ত।

রঞ্জু’র পুরো নাম সরদার রাজিব আহমেদ। ঢাকার দক্ষিনখানে বাড়ি। স্ত্রীর পড়াশুনার সূত্রে স্পাউস ভিসায় অষ্ট্রেলিয়া এসেছেন। এখানে সিডনিতে মোটামুটি ভালো একটা জব করতেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে পড়ে গত জুন থেকে শুয়ে আছেন লিভারপুর হাসপাতালের শয্যায়। আরও কতদিন এমন শুয়ে থাকতে হবে জানেন না।

একটি কোম্পানির মার্কেটিং’এর জব করতেন রঞ্জু। লোকজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কোম্পানির প্রোডাক্ট বিক্রির জব। গত জুনে এমন প্রোডাক্ট বিক্রি উপলক্ষে সিডনির একটি আবাসিক এলাকার ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন তারা দু’জন। অপরজনও বাংলাদেশি। হঠাৎ একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উঠে যায় ফুটপাতে। কিছু বোঝার আগেই পিছন থেকে রঞ্জুদের আঘাত করে। আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর রঞ্জু নিজেকে আবিষ্কার করেন লিভারপুল হাসপাতালের আইসিইউতে। আস্তে আস্তে সব মনে করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এরপর যা শুনতে বুঝতে অনুভব করার চেষ্টা করেন, পুরোটাই কান্নার।

দূর্ঘটনায় তাঁর বাম পা’টা কোমর থেকে ছুটে যায়। একটা ফ্র্যাকচার সৃষ্টি হয়। ঘাড়ের আঘাতটি ছিল গুরুতর। মেরুদন্ডসহ শরীরের নানা অংশের ক্ষতি হয়। হাসপাতালে এরমাঝে তার একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। ডাক্তারদের দাবি ধীরে ধীরে তার ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে। বিশেষ করে মেরুদণ্ডের বিপদ কমে এসেছে।

এমন স্টুডেন্ট দম্পতির এ্যাক্সিডেন্ট, অসুখ-বিসুখের খবর পেলে আমার ভয় করে। কারণ অষ্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসা খুবই ব্যয়-বহুল। এদেশের নাগরিকদের চিকিৎসা ফ্রী। এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসাও। বিদেশি স্টুডেন্ট বা অনাবাসী কারও ইন্সুরেন্স-মেডিব্যাংকের পেমেন্ট-কিস্তি এসব আপডেট না থাকলে বিপদ।

তাই রঞ্জুর কাছ থেকে খুঁটিয়ে প্রথম আমি তার সমুদয় জানতে চাই। দুটি পজিটিভ তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রথম হলো চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তার কোম্পানির প্রতিটি এমপ্লয়ির জীবন ইন্সুরেন্স করা।

অতএব তার হাসপাতাল ব্যয়সহ চিকিৎসার সমুদয় দেবে সংশ্লিষ্ট ইন্সুরেন্স কোম্পানি। আর অষ্ট্রেলিয়ার ওয়ার্কপ্লেস সেফটি, এমপ্লয়ির নিরাপত্তার শর্ত অনুসারে তার বেতনের একটি অংশের পেমেন্ট দিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। তবে সাপ্তাহিক এ টাকাটা তিন সদস্যের সংসার চালানোর উপযোগী না। ছোট একটি দুধের শিশু রঞ্জুদের। এরজন্য তার স্ত্রী কাজ করতে পারেননা। স্বামী হঠাৎ এমন একটি অনাকাংখিত ঘটনায় হাসপাতালবাসী হয়ে পড়াতে ক্লাস-পড়াশুনাও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন স্ত্রী।

সিডনির ম্যারিকভিল এলাকায় ডেরা রঞ্জুদের। এখন প্রতি সকালে স্ত্রী বাচ্চা-স্বামীর খাবার তৈরি করে স্ট্রলার ঠেলতে ঠেলতে ডালউইচ হিলসের এক বাসায় বাচ্চা রাখতে যান। এরপর সেখানে বাচ্চা রেখে হেঁটে আসেন স্টেশনে। ট্রেন ধরে লিভারপুর পৌঁছে আবার লম্বা পথ হেঁটে হাসপাতালে। এভাবে হাসপাতালে পৌঁছে সারাদিন স্বামীর সঙ্গে কাটিয়ে রাতে একই রুটিনে ডালউইচ হিলস ঘুরে বাসায়। ড্রাইভ না করাতে অথবা ড্রাইভিং না জানাতে এভাবে প্রতিদিন হাসপাতালে আসতে-যেতে চার-পাঁচ ঘন্টা সময় যায়।

মেয়েটি তার দৈনন্দিন জীবন-কষ্ট, অর্থ-কষ্ট, স্বামীর জীবন-ভবিষ্যত, তার স্টুডেন্ট লাইফের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। সামনে তার ৬ হাজার ডলার টিউশন ফি ডিউ হয়ে আছে। কিন্তু স্বামীর কাজ নেই। এতগুলো টাকা কোথা থেকে জোগাড় কিভাবে হবে জানেননা। ...মেয়েটিকে আশ্বস্ত শান্তনা দিতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে। আমাদের ছোট এই বোনটাকে এমন কি পরীক্ষায় ফেললেন আল্লাহ!

রঞ্জু বলেন, তাদের এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাচ্চা রাখার খরচ। বাঙ্গালি যে ভাবীর কাছে বাচ্চা রাখা হয় সেখানে ঘন্টায় ৪ ডলার করে দিতে হয়। আসলে এরচেয়ে কম টাকায় বাচ্চা রাখার সুযোগ কোথাও নেই। কিন্তু শুধু বাচ্চা রাখা বাবদই প্রতিদিন তাদের ৪০-৫০ ডলার গুনতে হচ্ছে। আরেকটি বিপদ হলো তার স্ত্রী ড্রাইভিং জানেননা। কোথাও কারো কাছে স্ত্রী অল্প টাকায় স্ত্রী ড্রাইভিং শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় কিনা এ ব্যাপারে সহায়তা চান রঞ্জু।

অষ্ট্রেলিয়ায় অষ্ট্রেলিয়ান না হলে এমন পদে পদে বিপদ। এমনিতে এদেশে চাইল্ড কেয়ার, ড্রাইভিং শেখা দুটিই খুব ব্যয়বহুল। পরিচিত যারা ড্রাইভিং শেখান, তাদের সবচেয়ে কম রেট’টি হলো ঘন্টায় ৩৫ ডলার। কিন্তু এ মেয়েটি যেহেতু কোনদিন গাড়ি চালায়নি, তার ড্রাইভিং প্র্যাকটিসে অনেকগুলো লেসন নিতে হতে পারে।

স্বজনবিহীন বিভূঁই বিদেশে দূর্ঘটনা-চিকিৎসা ট্র্যাজেডিতে পড়ে দুমড়ে গেছে রঞ্জুদের স্বপ্ন। এসব পরিস্থিতিতে সবার আগে যা করি তাহলো ফ্রি-স্টাইল। ভরসা দেই। যেমন কোন সমস্যা নেই, আমরা আছি না, আমরা ভালো থাকলে আপনি-আপনারাও ভালো থাকবেন। ইত্যাদি।

রঞ্জুর বাচ্চার চাইল্ড কেয়ারের খরচ, স্ত্রীর ড্রাইভিং শেখানোর খরচের ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। আপাতত এ দুটির ব্যবস্থা করা গেলে বিপন্ন-বিপদগ্রস্ত পরিবারটির লড়াই চালিয়ে যাবার আস্থা ফিরে আসবে। এই ইয়াং কাপলটার লড়াই করার বয়স এখন। লড়াই তারা করে যাচ্ছে। আমাদের দরকার একটু সাপোর্ট দেয়া। দয়ালু সামর্থ্যবানরা একটু হাত বাড়াবেন? খুব উপকার হবে পরিবারটির। খুউব। বিদেশে যারা পড়তে এসেছেন, বা যাদের ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন, স্বজন কেউ পড়াশুনা করে বিদেশে, তারা রঞ্জুর সংকটটি বুঝতে-ফিল করতে পারবেন। এমন সবাই যদি কিছু কিছু কন্ট্রিবিউট করেন, রঞ্জুদের আজকের সমস্যাও থাকবেনা। প্লিজ, হাত বাড়িয়ে দিন।

সাহায্য সরাসরি রঞ্জুর ঠিকানায় পাঠান। তার ব্যাংক হিসাব ডিটেলসঃ Sharder Rajib Ahmmed, BSB-062199, ACC NO-10472652, Commonwealth Bank, Australia. রঞ্জুর ফোন নম্বরঃ +61433784404 (কেউ মিসকল দিয়ে রঞ্জুকে বিব্রত করবেননা প্লিজ, কারন কলব্যাক করার সঙ্গতি তার এখন নেই)।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।