ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

'পোস্ট ট্রুথ' যুগে গণতন্ত্র ও রাজনীতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭
'পোস্ট ট্রুথ' যুগে গণতন্ত্র ও রাজনীতি ছবি: প্রতীকী

‘পোস্ট ট্রুথ’, আজকের যুগটাকে এ নামেই ডাকছেন অনেকে। ২০১৬ সালে বিশ্বের আলোচিত শব্দ ছিল এটি। ২০১৭ সালে তার ছায়া দেখতে পাওয়া গেছে সর্বত্র। বিশেষত, 'পোস্ট ট্রুথ’- এর আওতায় গণতন্ত্র আর রাজনীতি লাভ করেছে নবতর অবয়ব ও প্রত্যাশা।

পোস্ট ট্রুথ’ নামক সমকালে সত্যের সংজ্ঞাটা কেমন যেন বদলে গিয়েছে। নির্মোহ ভঙ্গিতে সত্যকে খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস অন্তর্হিত অনেকটাই।

সত্যের চেয়ে বাস্তবতাই বরং গুরুত্ব পাচ্ছে অনেক বেশি। বাস্তবে যা শুনতে ভালো লাগে, যা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি, যা আমার পক্ষে সুবিধাজনক, তাকেই ‘সত্য’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা হলো 'পোস্ট ট্রুথ'- এর মূল কথা।  

এ যুগে গণতন্ত্র বা রাজনীতি বাস্তবে আমাকে কি দিচ্ছে, সে দিকেই তাকিয়ে আছে মানুষ। কতটুকু গণতন্ত্র আছে কি নেই, রাজনীতির মাঠে তার পরিমাপ করার আগে বিবেচনা করা হচ্ছে, গণতন্ত্র আমাকে কি দিল বা গণতন্ত্র থেকে আমি কি পাচ্ছি।

গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই যে, মতাদর্শটি ব্যক্তিকে মূল্য দেয়। ব্যক্তির স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করে। ২০১৭ সালে এ চেতনা আরও শাণিত হয়েছে। ২০১৮ সালে আরও হবে। কারণ, পোস্ট ট্রুথ মানুষকে গণতন্ত্রের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ ও অধিকারের প্রশ্নটি জোরালো করেছে। গণতন্ত্রের নামাবলী চাপিয়ে দল আর নেতাদের আখের গোছানোর রাজনৈতিক ধারা অনেক কমেছে এ বছর।

সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজে মতানৈক্য বা মতবিরোধ থাকবেই। কিন্তু সে সব উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়াসও নিরন্তর বহাল থাকবে, আলাপে-আলোচনায় সমঝোতা সূত্রে বা মতান্তর নিরসনের সূত্রে কার্যকর উপসংহারে পৌঁছানোর প্রয়াসও সর্বদা জারি থাকবে। কেননা, যাবতীয় মতান্তর বা মতানৈক্যও অভিন্ন এক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই, যে লক্ষ্যটি হলো জনগণের কল্যাণ ও উন্নতি।

ব্যক্তি ও জাতির অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, শ্রী-বৃদ্ধিই হলো মূল লক্ষ্য। যে কোনো দায়িত্বশীল মতাদর্শ ও রাজনৈতিক দলের কাছে এমনটিই প্রধান কর্তব্য হওয়ার কথা। কোন পথে এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে, মতান্তর মূলত তা নিয়েই হয়ে থাকে। তাই তর্কে-ঘোরে পথ হারিয়ে ফেলা নয়, চর্চায়-আলোচনায় পথ খুঁজে বের করার উপরই দৃষ্টি স্থির হওয়া উচিত। অতএব, ২০১৭ সালের অভিজ্ঞতায় সমাগত ২০১৮ সালের প্রত্যাশাটি এমনই।

মতানৈক্য এড়িয়ে নানা পক্ষই যদি ইতিবাচক রাজনীতি সচল রাখার পথে পা বাড়ায়, তা নিশ্চয়ই ব্যক্তি ও জাতির অর্জন বলেই বিবেচিত হবে। অর্জনের রাজনীতিই নেতা আর দলকে বাঁচিয়ে রাখবে। বিসর্জনের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কিছুই দিতে পারবে না।  

দ্বন্দ্ব ও নেতিবাচকতার আবহ থেকে একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে নিরন্তর, অস্বস্তিটা তাই কাটতে চাইছে না। রাজনীতির সদর ও অন্দরে যেভাবে  বিবাদে জড়িয়েছিল নানা পক্ষ, তার সঙ্গে জাতির অগ্রগতির কোনও সম্পর্ক কিন্তু নেই। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সৌজন্যের অবিশ্বাস্য উলঙ্ঘন ঘটিয়েছিলেন বিভিন্ন দল ও নেতা। দেশের প্রতি দায়বদ্ধ নন এবং তারা ব্যক্তিস্বার্থের কাণ্ডারি, এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডে। তাদের আচরণে  জাতির স্বার্থের বদলে  নিছক ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের প্রতিফলন ঘটেছিল।

রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলার তাগিদে আদ্যন্ত ভিত্তিহীন অভিযোগ ও বিষোদগার তুলে পরিস্থিতি যে ইতিবাচক করা সম্ভব নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে এমন বাস্তবতা অনুধাবনের তাগিদ সামনে বছরে আরও জোরালো হবে। কারণ  বিতর্কের আগুন উস্কে দিয়ে ইতিবাচক রাজনীতি ও পারস্পরিক  শ্রদ্ধাশীলতা অর্জন করা মোটেও সম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত সত্য। অতীতে এ পথে নানা পরীক্ষার ফল রাজনীতিবিদগণের জন্য লাভজনক হয় নি। অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ বা শব্দচয়নের কারসাজিতে জনসাধারণের ভাবাবেগ নিয়ে খেলা না করে মানুষ ও গণতন্ত্র বাস্তবে কি প্রত্যাশা করে, দল ও নেতাদের সে দিকেই মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কারণ, এখন মানুষ ‘সত্য’কে নিজের মনের মতোন করে গড়ে-পিটে, সাজিয়ে-গুছিয়ে নিচ্ছে। চাপিয়ে দেওয়া সত্যকে গ্রহণ করছে না। এ প্রবণতা মানুষের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে 'পোস্ট ট্রুথ' হয়ে দাঁড়াচ্ছে মূল্যায়নের মানদণ্ড। তাই বিকৃত বাস্তবকে কিংবা নেতিবাচক বা ব্যক্তিস্বার্থ ভিত্তিক অভিব্যক্তিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কখনওই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। আমজনতা থেকে সর্বোচ্চ প্রশাসক, সবারই বোঝা দরকার এ কথা।  

কিন্তু বোঝা-না বোঝার প্রশ্নে আমজনতা আর সর্বোচ্চ প্রশাসকের মধ্যে বিস্তর ফারাকও রয়েছে। কোনও এক সাধারণ নাগরিক বিকৃত বাস্তবকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করলে তার ফল খুব সুদূরপ্রসারী হয় না। কিন্তু দেশের বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদগণ যদি নিজের মনের মতোন করে সাজিয়ে নিতে চান ‘সত্য’, তা হলে গোটা জাতিকে মারাত্মক বিভ্রান্তির দিকে ধাবিত হতে হয়। একবিংশ শতকের সমৃদ্ধির পথে সম্মিলিত পথযাত্রা তখন হয় সুদূরপরাহত।

বিভ্রান্তির নিরসনে ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক পন্থা উদ্ভাবনে আগত ২০১৮ সালে সব দলের নেতারা সফল হবেন এবং বিভ্রান্তির উপরে দাঁড়িয়ে যে কার্যসিদ্ধিটি হয় না, তা গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করবেন। অতীতের ভুল থেকে নৈতিক দংশন অনুভব করে তারা  অন্তঃসারশূন্যতার রাহু গ্রাস থেকে বের হয়ে আসবেন, এমনটিই সবার কাছে প্রত্যাশিত।  

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা যদি পোস্ট-ট্রুথ যুগের বাসিন্দা না হয়ে উঠে থাকেন এখনও, তা হলে রাজনীতি ও জনগণের কাছ থেকে পিছিয়ে পড়বেনই, এ হুঁশিয়ারিটিও তাদের মনে রাখতে হবে সামনের ২০১৮ সালে।

বাংলাদেশ সময়: ০১৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
এমপি/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।