বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনে একটা গতি নিয়ে আসার চেষ্টায় বিএনপি। এই শীতে বিভিন্নভাবেই কর্মীদের সচল-সরব রাখতে উদ্যোগ আছে দলটির।
মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশকে কেন্দ্র করেই ঢাকায় ককটেল বিস্ফোরণে নিহত তরুন আরিফুুজ্জামানের মৃত্যু নিয়েও সেই একই পুরনো কথা। পরিবার বলে ছেলে রাজনীতির সাথে নেই, বিএনপি বলে তাদের কর্মী। সব কিছুর মধ্যেই আছে রাজনীতির গন্ধ।
দু’দলের সহিংসতা, দলীয় কোন্দল, অভ্যন্তরীণ মারামারী, সেই চুলোচুলি। বিএনপি’র গত রোডমার্চের সময় দেখেছি আমরা সিলেটে ইলিয়াছ-মকবুল দ্বন্দ্ব। চেয়ারে বসার মূল্য কিভাবে ২০ লাখ টাকায় পৌঁছেছিলো এবং কিভাবেই পরে তা মিডিয়া ফোকাস হয়ে দ’ুজনের চুলোচুলির খবর চাউর হয়ে যায় সারা দেশব্যাপী। দ্বন্দ্ব আছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, সবদলেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটা কোনো অশুভ ঈঙ্গিতও নয়। ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা নির্বাচনে শেষপর্যন্ত দু’ভাইয়ের লড়াইয়ে একসময়ের ব্রিটেনের মন্ত্রীকে হারিয়ে তার ছোটভাই এড মিলিব্যান্ড এখন পার্টির নেতৃত্বে।
২)
বাংলাদেশের দল এবং দলীয় কোন্দল দেশ ছেড়ে বিদেশে। লন্ডনে-নিউইয়র্কে। ব্রিটেনের প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই এই কোন্দল যেন একটা নিত্যদিনের ব্যাপার। বাঙালি অধ্যুষিত বড় বড় শহর লন্ডন-ম্যানচেস্টার-বার্মিংহাম-ওল্ডহ্যামসহ ছোট শহরগুলোর প্রত্যেকটিতেই দুটো বড় দলের আছে নির্বাহী কমিটি । দলীয় অনুমোদন নিয়েই এগুলো কাজ করে। অন্যদিকে ঐ কমিটিতেই আসীন নেতা-কর্মীদের আছে আবার নিজস্ব গ্রুপ। সভায়-সমাবেশে এ গ্রুপগুলো বক্তৃতা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয় , হয় অভ্যন্তরীণ লড়াই।
লড়াইটা হোক এতে আমাদের খুব একটা ক্ষতি নেই। সাধারণ বাঙালিদের এতে যায় আসে না। কিন্তু তখনই কথা ওঠে, যখন ঐ কোন্দলের রাজনীতি সহিংসতায় রুপ নেয়। সহিংসতায় রুপ নেওয়া মানেই আইনশৃংখলা বাহিনীর জড়িয়ে পড়া। থানা-আদালত দৌড়াদৌড়ি। এরকমই একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবছরেরই প্রথম দিকে, হয়েছে লর্ডসে আওয়ামীলীগ-বিএনপি’র চেয়ার ছোড়াছুঁড়ি। মন্ত্রী-সাবেক মন্ত্রীদের সভার মাঝখানে রেখেই লর্ডসে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনাটি শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়, তাও শুধুমাত্র কার নেতা মঞ্চে উঠবেন ঐ নিয়ে। যদিও শেষপর্যন্ত দু’জন কর্মীর সাজাভোগের মধ্য দিয়ে এ নাটকটির যবনিকা ঘটেছিলো।
ঠিক এভাবেই ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। এবার বিএনপি’র ভেতরেই সংঘটিত হয়েছে তা। গত ১২ ডিসেম্বর সংগঠনটি এক সভার আয়োজন করেছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখা, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, টিপাইমুখ ইস্যু, শেয়ার বাজার কেলেংকারি ও ঢাকা বিভক্তিকরণের প্রতিবাদে পূর্ব লন্ডনে এ সভায় আয়োজন করে যুক্তরাজ্য বিএনপি।
এ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। যথারীতি সভা শুরুই হয়। কিন্তু বক্তৃতা নিয়ে শুরু হয়ে যায় পুরনো সব কাণ্ড। এক গ্রুপের নেতা বক্তৃতার জন্যে দাঁড়াবার জায়গা না পাওয়ায় শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তার অনুসারীরা ‘অমুক ভাই অমুক ভাই’ (সাবেক সাধারণ সম্পাদক) বলে বলেই সভাটি পণ্ড করতে থাকে।
এমনকি শেষ পর্যন্ত জয়নুল আবদিন ফারুক আর বলতেই পারেননি সরকারবিরোধী কথাগুলো। বলতে পারেননি সারা বাংলাদেশেই চলছে তাদের বক্তৃতার ভাষায় আওয়ামী দুঃশাসন। দুঃশাসনের কথাতো বলতেই পারেননি, বরং তার দলের কর্মীরাই পুলিশ ডাকে। বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা জেনে কুকুর নিয়ে আসে পুলিশ, মানুষের সন্ধান করতে চলে কুকুরের ছোটাছুটি।
বিএনপি’র দু’পক্ষের এরকম পাল্টাপাল্টি অনেক বছরের পুরনো। বিএনপি’র প্রয়াত সভাপতি কমর উদ্দিন ছিলেন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত তারেক জিয়ার খুবই ঘনিষ্ঠজন। সেজন্যেই কমর উদ্দিন তাকে খুব সহজেই সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত ঐ নেতা বিএনপি লিমিটেড কোম্পানি করে বিএনপি নামটি তার নিজস্ব করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মূলস্রোতের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কমর উদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যু তাকে বিএনপি’র কাছে আসতে সহায়তা করে। তারেক জিয়ার অনুকম্পাও কিছুটা পান। কারণ তারেক জিয়া ব্রিটেনে চেয়েছেন একটা শক্তিশালী বিএনপি গড়ে তুলতে। কিন্তু পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে তারেক জিয়ার সেই অনুকম্পা কি আর আছে? তাইতো আবারও সন্ত্রাস-মারামারি শুরু হয়েছে যুক্তরাজ্য বিএনপি’তে। ইতিমধ্যে বিএনপি’র বর্তমান নেতৃত্বও সংবাদ সম্মেলন করে বলে দিয়েছে যারা সন্ত্রাস করেছে, এরা বিএনপি’র অপশক্তি এবং সরকারের দালাল।
এভাবেই একের পর এক ঘটনা এই ব্রিটেনে ভিনদেশিদের কাছে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে নুতন পরিচয়ে। ভিন্ন ভিন্ন সময় বাংলাদেশি রাজনীতির নাম নিয়ে দু’দলের কর্মীরা সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়। সময়ে-অসময়ে দুটো দলই তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রয়োজনে কখনো পার্লামেন্টের সামনে কখনোবা ডাউনিং স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখায়। যে দলই ক্ষমতায় আসে, তার বিরোধী দলটি প্রত্যেকবারই এই কাজটি করে। অর্থাৎ এটা যেন রাজনীতির এক সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র। তারা কোনও না কোনোভাবে সরকারের বিরোধিতা করে ধর্ণা দেয় এই পার্লামেন্ট কিংবা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে। অর্থাৎ এরা প্রকারান্তরে সমস্ত বাংলাদেশের একটা ব্যর্থতাই তুলে ধরার তৎপরতা চালায়। এতে করে কোনোভাবেই যেন এই ব্রিটেনে আমাদের পজিটিভ দিক ফুটে উঠছে না। সৃষ্টি হচ্ছে গোটা বাংলাদেশের ইমেজ সংকট।
৩)
সেকারণেই কি ব্রিটেনের বাঙালিদের পাশাপাশি ইংরেজিভাষী জনগণকে দেখতে হচ্ছে ১২ পাতার বিজ্ঞাপন? ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিকে যেন পাঠক মুখ (ছবি) দেখছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী কিংবা লন্ডনস্থ হাইকমিশনারের। কি এমন প্রয়োজন, লাখো-কোটি টাকা খরচ করে ইমেজ-সংকট সমাধানের।
বিজ্ঞাপনে ব্যবসা হয়, ইমেজ-সংকট সমাধান হয় না। বিশেষত একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে এই বিজ্ঞাপন কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে দেড়কোটি টাকা খসে গেছে রাষ্ট্রের। অথচ একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করতে চাই, ব্রিটেনের সব জায়গায় কিন্তু এই ক্রোড়পত্রটি পাওয়াও যায়নি। কিছু কিছু অঞ্চলের দ্য টাইমস্-এ ছাপা হয়েছে এভাবে যে, বাংলাদেশ নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র আছে ঠিকই তবে তা ওয়েবসাইটে দেখার জন্যে বলা হয়েছে। ম্যানচেষ্টারে অনেক খোঁজাখুজি করে আমরা টাইমস্-এ পাই নি এই ১২ পাতার প্রচারণা। অথচ ম্যানচেস্টার-ওল্ডহ্যাম-হাইড লিভারপুল তথা নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে কম করে হলেও পঞ্চাশ হাজার বাঙালির বসবাস। এমনকি ম্যানচেস্টারকে ব্রিটেনের দ্বিতীয় শহর হিসেবেও মনে করা হয়। অথচ এই অঞ্চলের টাইমস্-এ এই বিজ্ঞাপন পায়নি মানুষ। দেখা গেছে শুধু একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা। তাহলে কি ধরনের বিজ্ঞাপন হয়েছে এটা। না-কি এখানেও বাণিজ্য হয়েছে ?
৪)
আমরা দেখছি কি ঘটছে দেশে দেশে বিশেষত পশ্চিমের দেশগুলোতে। দলবাজি করতে গিয়ে কি করছে তারা। এই ব্রিটেনে আছে বাঙালিদের অনেক প্রাপ্তি, মূলধারার রাজনীতিতে। এমপি-নির্বাহী মেয়র-কাউন্সিলার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় আছে অনেক অনেক চোখ ধাঁধানো সফলতা। অথচ এসব ম্লান করছে ঐ দলবাজ রাজনীতিকরা সময়ে সময়ে। দলবাজ রাজনীতিকদের কারণেই বাংলাদেশের এই ইমেজ সংকট এই ব্রিটেনে। এই ইমেজ সংকট কোটি টাকায় কি ফিরে আসবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ফারুক যোশী : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক