ঢাকা, রবিবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ জুন ২০২৪, ১৫ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

এরশাদের ‘কপট’ বক্তৃতা ও যুদ্ধ প্রসঙ্গ

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১
এরশাদের ‘কপট’ বক্তৃতা ও যুদ্ধ প্রসঙ্গ

অতঃপর মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ করার জন্য বললেন এরশাদ! বৃহস্পতিবার ঢাকার বাইরের এক সমাবেশে তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আবার যুদ্ধ করতে বলেছেন! নিজে সৈনিক থাকতে যুদ্ধ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুযোগ পেয়েও পাকিস্তানিদের সেবা করেছেন।



অবরুদ্ধ পাকিস্তান থেকে কর্নেল তাহেরসহ অনেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও সুবিধাবাদী এরশাদ তা করেননি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছুটিতে বাড়ি এসেও না! ইনারাই পরবর্তী বাংলাদেশে নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে শুধু মোটাতাজা হয়েছেন! আর সময়-সুযোগ পেলেই জ্ঞান দেন মুক্তিযোদ্ধাদের! মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনজয়ী যুদ্ধের কারণে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল বলে একেকজন স্বাধীনদেশে এমনও কামিয়েছেন যে কয়েক পুরুষ বসে খেলেও তা ফুরাবে না! প্রেসিডেন্টস পার্ক’সহ এসব কোথা থেকে এসেছে? আর যাদের যুদ্ধ করতে বলা হচ্ছে সে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা কী?
 
সাম্প্রতিক সময়ে এমন খালেদাও মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধের কথা বলেছেন! তার সঙ্গে সব মুক্তিযুদ্ধের শত্রুসমগ্র! তাদের বগলদাবা, সুশীতল ছায়াতলে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের নসিহত করে বলেন, যুদ্ধ করো, যুদ্ধ করো। কেন কার জন্য আবার যুদ্ধ করবে মুক্তিযোদ্ধারা? কাকে দেখে কার কথায় করবে? তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও দেশে এখনও দিনমজুর, রিকশা শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান পাওয়া যায় কেন? মুক্তিযুদ্ধের আগে একেকজনের কী অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল, আর এখন কী? গুলশানের বাড়ির মাসিক ভাড়া কত, আর ভাতা কত মুক্তিযোদ্ধার? শহীদ পরিবারগুলোর কান্না কী কোনদিন শোনার চেষ্টা হয়েছে? মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদের মতো চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীর ঢাকায় প্লট বরাদ্দের সুপারিশে খালেদা জিয়া ‘দেশ ও জাতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য’ কথাটি লিখেছিলেন। বাংলাদেশের জন্য কী অবদান ছিল ওই স্বাধীনতা বিরোধীদের? আর তাদের পক্ষে সুপারিশকারীর কথায় যুদ্ধ করবে একাত্তরের মুক্তিসেনার দল?

এমন যার যার সুবিধামতো এমন কথাবার্তা আওয়ামী লীগার অনেকেও প্রায় বলেন! তাদের অনেকে আবার মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধারা আর যাবে কই? বিপদতো সেখানেই। যাবার জায়গাও যে নেই! অথচ আমাদের রাজনীতির ধারাবাহিক সুবিধাবাদী কপট চরিত্রের কারণেই স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে এসেও দেশের বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবারগুলো দুঃস্থ চিহ্নিত! গত চল্লিশ বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা ছিলেন আর আছেন, এর জন্যে এদের সবাই দায়ী। মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া বাংলাদেশ, লালসবুজ পতাকাটি ছাড়া কার্যত আর কিছুই নেই দেশে। একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল স্বপ্ন। জিয়া-এরশাদ মিলে সে স্বপ্নকে সাড়ম্বরে কবর দিয়েছেন। বিসমিল্লাহ, আর রাষ্ট্রধর্মের আড়ালে স্বাধীন দেশটির পাকিস্তানিকরনের সবই তারা করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন জিয়া। এরশাদ তাকে করেন পূর্ণ-টইটু্ম্বুর! তাদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক স্বপ্ন থেকে পথ হারায় বাংলাদেশ। যা অব্যাহত রাখেন খালেদা জিয়া। এসব নিয়ে জিয়া-এরশাদের অন্তত গোপনীয়তা লাজ-শরম যা কিছু ছিল খালেদা জিয়া সে ধারও ধারেননি। বা এখনও আজও তিনি এসব নিয়ে মোটেও শর্মিন্দা নন।

আর ১৯৯৬-২০০১ তে প্রথম, সবশেষ ২০০৮ এ ক্ষমতা পেয়ে কী করেছেন বা করছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের পার্লামেন্টে তার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এবার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগানো হলো না! দেশটাকেতো আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে আনার দরকার ছিল। সেখান থেকে হাতটা যেত ভবিষ্যতের পথে। জিয়া-এরশাদের সাম্প্রতিক আবর্জনার সবটুকু বহাল রেখেই শেখ হাসিনার আমলে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে! আর বক্তৃতায় সুযোগ পেলে সবাই চেতনা চেতনা বলে মাইক্রোফোন ফাটান! এই বাংলাদেশ কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ? আজ পর্যন্ত দেশে কেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো না। মেধার ভিত্তিতেই মানুষের মূল্যায়ন, মানুষের অধিকারের কিছুই নিশ্চিত হলো না দেশে। বন্ধ হলো না ধর্ম-ব্যবসা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। কূপমণ্ডুক ধর্ম ব্যবসায়ীরা এখনও সারাদিন মুক্তিবুদ্ধির মানুষজনকে মুরতাদ-ধর্মদ্রোহী-দেশদ্রোহী বলে শাসায়! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের নামে দলীয় লোকজনের চুরি-দুর্নীতির বৈধতা দেওয়া চলে না। এবার ক্ষমতায় ফিরে ছাত্রলীগসহ দলীয় নামধারী কিছু গুণ্ডা যেসব সন্ত্রাস চালিয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার মতো কোন পদক্ষেপ কী কেউ কখনো দেখেছে? বা মন্ত্রী দুর্নীতিতে ধরা পড়লেও তাকে ধরা হয়নি কেন? এসব কী ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন? এতো গেল দুয়েকটি উদাহরণ মাত্র।

বা এসব চলতি নানা কিছুর সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের পার্থক্যটা কী? স্বাধীন বাংলাদেশ এমন বেপরোয়া চলবে, স্বাধীন দেশে এমন ঔদ্ধ্যত্ব চলবে স্বাধীনতা বিরোধীদের, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র আগাম ধারণা থাকলে কী মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ যুদ্ধে যেতেন? এসবের উত্তর কেউ কোনদিন দেননি। কিন্তু উত্তর যে দিতে হবে না সে গ্যারান্টি কে দিয়েছে?

আজ মুক্তিযোদ্ধাদের গড় বয়স ষাট বা এরও বেশি। জরাজীর্ণ, রোগেশোকে ভরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষয়িষ্ণু জীবন! আর সেই যুদ্ধের উপকারভোগী, মূল চেতনা আত্মসাৎকারীরা তাদের আবার যুদ্ধে যাবার কথাটি যখন বলেন, তখন তা রাজনৈতিক বাকোয়াজি তা সবাই জানেন-বোঝেন, পাশাপাশি তা উপহাসের মতোও শোনায়। আমাদের ক্ষমতাভোগী আর ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা এমন কপট, ধৃষ্ট যে এসব কার-কাদের সঙ্গে করছেন তা তারা জানেন না। অথবা জ্ঞানপাপীর মতো না জানার ভান করে চলেন! যারা এসব বলেন তারা ইতিহাসটাও ঠিকমতো জানেন কী? ইতিহাস হচ্ছে কোন একটি জাতির এক জেনারেশন দুবার যুদ্ধ করে না। আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শ্রেষ্ঠ অবদানটিই জাতিকে দিয়েছেন। তা এই বাংলাদেশ। আগামী যে জেনারেশন মুক্তিযুদ্ধ করবে তা নতুন আরেকটি দেশ স্বাধীন বা সৃষ্টির জন্য না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে যেসব কপট দুর্বৃত্ত আত্মসাৎ করেছে সে যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শিক শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করার যুদ্ধ। অতএব এখন যারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার নামে কপট বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, যা খুশি করে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সে যুদ্ধে এদের কেউ ছাড় পাবেন না। কারণ নতুন প্রজন্ম অনেক চাঁছাছোলা, মুক্তবুদ্ধির, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক। এই ভণ্ডরা কী সে আশংকায় অনেকটা প্যাশন-ফ্যাশনের মতো মাঝে মাঝে বলেন তেমন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার গল্প?

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।