ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়নে হবে বাসযোগ্য রাজধানী

মো. শাহ জালাল মিশুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২১
পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়নে হবে বাসযোগ্য রাজধানী

নগর পরিকল্পনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। একটি দেশের সার্বিক অবস্থা মাথায় রেখেই নগর পরিকল্পনা করতে হয়।

আর সেই পরিকল্পনায় জনসংখ্যা, মাটির ধরন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ আরো অনেক কিছু বিবেচনায় রাখতে হয়। বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনার কথা বললে প্রথমেই মাথায় আসে রাজধানী ঢাকার কথা। চারশ’ বছরের পুরনো শহর আমাদের রাজধানী ঢাকা। তাই এর উন্নয়নের বিষয়ে ভাবনা-চিন্তার সূচনাও সম্ভবত এ শহরের সমান বয়সী। শত বর্ষের কথা না হয় থাক। গত ৬০-৭০ বছরে যেসব পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা, উদ্যোগ, আয়োজন করা হয়েছে সেগুলোও একেবারে কম নয়। কিন্তু তাতে ঢাকা কি বাসযোগ্য নগরী হয়ে উঠেছে?

১৯১৭ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডিস ঢাকা শহরের জন্য একটি প্ল্যান করেছিলেন। এরপর ১৯৫৯ সালে ঢাকা, ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম, ১৯৬৬ সালে খুলনা এবং ১৯৮৪ সালে রাজশাহী শহরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। এই মাস্টারপ্ল্যান ছিল ২০ বছর মেয়াদি। এইসব মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। কিন্তু পুরো পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের রাজধানী মেগাসিটি ঢাকা শহরকে নিয়ে ১৯৫৯ সালে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেটা ছিল ১৫ লাখ মানুষের জন্য। ১৯৭৪ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা হলো প্রায় ২০ লাখ। ১৯৮০ সালে ৩৫ লাখ। ১৯৯১ সালে ৬৫ লাখ। ২০০১ সালে এই মহানগরের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটির বেশি। আর এখন প্রায় দুই কোটি। ১৫ লাখ লোকের জন্য যে পরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা দিয়েই মূলত এখনো ঢাকা শহর চলছে। পরে যেসব পরিকল্পনা হয়েছে, তা সামান্যই বাস্তবায়ন হয়েছে। আশির দশকে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে দেশের ৫০টি জেলা ও ৩৯২টি উপজেলা শহরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন হলেও তা বাস্তবে কোনো কাজে লাগানো হয়নি। ১৯৫৩ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট  ট্রাস্ট (বর্তমানে যা রাজউক) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকার পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য। ১৯৮১ সালে প্রণীত ‘ঢাকা মহানগরী এলাকার সমন্বিত পরিকল্পনা' বাস্তবায়নের এখতিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল না। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত আরবান প্ল্যান তৈরি করা হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১০ সালে ড্যাপ (ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) তৈরি করা হয়। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশি পরিকল্পনাবিদরা এই ড্যাপ তৈরির কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কিন্তু সেই ড্যাপও বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই এখন চলছে ড্যাপ সংশোধনের কাজ।

১৯৯৫-২০১৫ সালের পর ২০১৬-২০৩৫ বিশদ নগর-পরিকল্পনার খসড়া তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এর নানা সংশোধন আনা হয়েছে। নতুন খসড়াটি ঢাকা ও তার আশপাশে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার ভূমি ব্যবহার, আবাসন, পরিবহন, পানি নিষ্কাশন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, সামাজিক ও নাগরিক সেবা ইত্যাদি প্রদানের জন্য একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা। আধুনিক নগর–পরিকল্পনার ধারণাগত বিচারে এই ড্যাপে বেশ কিছু নতুনত্ব আনা হয়েছে। এর মধ্যে মেট্রো স্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), ব্লক ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর), ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় শহরের মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করবে। কোনো শহরের জনঘনত্ব একরপ্রতি ১২০–এর ওপর গেলে বাসযোগ্যতা কমতে থাকে, সেখানে ঢাকার অনেক এলাকাতে একরপ্রতি জনঘনত্ব ৫৫০–এর বেশি। এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণ করার মাধ্যমে নগর–পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নগর এলাকার ভবনগুলোর ভেতর সূর্যের আলো, বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে ইমারত–সংশ্লিষ্ট আইন, বিধিবিধান ও নগর–পরিকল্পনা প্রণয়ন করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

রাজউকের খসড়া ড্যাপ যুগোপযোগী ও নাগরিক বান্ধব করতে গেলে, এখানে বেশ কিছু সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ। পাশাপাশি ইউএনএফপিএর তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন নতুন যুক্ত হয় ১৭০০ জন মানুষ। কিন্তু ড্যাপে ২০৩৫ সালের প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ধরা হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ যা বাস্তবসম্মত নয়। পাশাপাশি প্রস্তাবিত বিশদ পরিকল্পনা অবশ্যই উচ্চতর কাঠামো পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং ড্যাপের আগে কাঠামো পরিকল্পনার আইনি বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্তাবিত ড্যাপে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ব্যাপকভাবে মিশ্র ভূমি ব্যবহার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নাগরিকদের জনস্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা ও পরিবেশগত সমস্যাকে প্রকট করবে। অন্যদিকে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় কত শতাংশ অনাবাসিক ব্যবহার প্রয়োজন তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই ঢালাওভাবে মিশ্র ব্যবহারের অনুমোদনের ফলে অনাবাসিক ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে আবাসন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

রাজধানী ঢাকায় রাস্তা প্রশস্তকরণের বাধ্যবাধকতা না রেখে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিলে দুর্যোগকালে সেই এলাকায় জরুরি সাহায্যও পৌঁছানো যাবে না। শহরের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সংশ্লিষ্ট ভূমি ব্যবহার সুস্পষ্টকরণ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শ্রমজীবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসনের স্থান নির্ধারণ এবং তার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জোরালোভাবে আসা উচিত। পাশাপাশি বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ও কৃষিজমি সংরক্ষণের বিষয়ে কাঠামো পরিকল্পনায় গুরুত্বসহকারে থাকলেও প্রস্তাবিত ড্যাপে ব্লু-নেটওয়ার্ক তৈরি, ওয়াটার রিটেনশন পন্ড ও বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল যথাযথভাবে গুরুত্ব পায়নি। শহরের পানি নিষ্কাশনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঢাকার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি খসড়া ড্যাপে কৃষি এলাকার কথা বলা হয়েছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প, ইকো রিসোর্ট করার কথা বলা হয়েছে। এসব কোন অঞ্চলে হবে, সেটাও সুনির্দিষ্ট করতে হবে।

মোর্দাকথা হলো, রাজধানী ঢাকাকে নাগরিক বান্ধব ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে একটি ভালো পরিকল্পনার প্রয়োজন। তবে সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে আমাদের সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে হবে। যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামাজিক সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শহরের অন্তর্ভুক্তিমূলক জনবান্ধব পরিকল্পনা তৈরি হবে। তাই প্রস্তাবিত ড্যাপ গণশুনানির মতামত ও অংশীজনদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-২০৩৫) চূড়ান্ত করা হবে এবং এর পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক বাস্তবায়নের ফলে নাগরিক বান্ধব ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে রাজধানী ঢাকাকে নগরবাসী পাবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।